‘‘ওই যে ওই জায়গাটায় বসে দুপুরে খাবার খেত আদিল। আর ওই দিকটায় বসে গল্প করতাম সকলে।’’ বলতে বলতে মাথায় দেওয়া চাদরটি মুখে জড়িয়ে কান্না চাপার চেষ্টা করলেন মহিলা। একটি বাড়ি মানে তো কয়েক’টা দেওয়াল নয়, প্রত্যেক গৃহস্থের ভাল-মন্দের স্মৃতি ছড়িয়ে থাকে বাড়ির কোনায় কোনায়। ওই বাড়িও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু বাড়ি আর কই? সেটা এখন ভগ্নস্তূপ। বাড়ির কোণে বসে কান্নার বেগে ভারী হয়ে আসছিল প্রবীণার গলা। কান্না চেপে অস্ফুটে বললেন, ‘‘এ বার বাড়ির বাকিদের বাঁচতে দে। আত্মসমর্পণ কর।’’ তিনি আদিল হোসেন ঠোকারের মা শেহজ়াদা বানো। পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিহানার পর যাঁর ছেলেকে খুঁজছে পুলিশ এবং সেনা।
আদিল লশকর-এ-ত্যায়বার সদস্য। পহেলগাঁও কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত। জম্মু-কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার বিজবেহারার গুরি গ্রামে তার বাড়ি। বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১২টায় সেই বাড়ি ভেঙে দিয়েছে সেনা। সেই সময় প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন মধ্যবয়সি শেহজ়াদা, আদিলের মা। তার কিছু ক্ষণ আগে স্নিফার ডগ নিয়ে এসে বাড়ির চারদিক তল্লাশির পরে বিস্ফোরক দিয়ে শেহজ়াদাদের বাড়ি ধূলিসাৎ করেছে সেনাবাহিনী।
তদন্তে উঠে এসেছে, জঙ্গি সংগঠনের সদস্য আদিল বছর দুয়েক আগে পাকিস্তান গিয়েছিল। তবে মায়ের দাবি, ছেলেকে তিনি শেষ বার দেখেছেন ৭ বছর আগে! তারিখটাও মনে আছে তাঁর। শেহজ়াদার কথায়, ‘‘২০১৮ সালের ২৯ এপ্রিলের পর ওর কোনও খোঁজ পাইনি আমরা।’’ কী ছিল ২৯ এপ্রিল? আদিলের মা বলেন, ‘‘সে দিন বাদগাঁও গিয়েছিল আদিল। বলেছিল, একটা পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। সঙ্গে মোবাইল ফোন ছিল। কিন্তু বিকেল থেকে সেই নম্বরে কত বার ফোন করেছি। পাইনি ওকে। তিন দিন ধরে ছেলের খোঁজ না পাওয়ার পর থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেছিলাম।’’
ছেলে এমন নৃশংস কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে সেটা বিশ্বাস করেন না শেহজ়াদা। আর পাঁচ জন মায়ের মতো তিনিও মনে করেন, তাঁর ছেলে কোনও নিষ্ঠুর কাজ করতেই পারে না। তবে এটাও বলছেন, যদি প্রমাণ পাওয়া যায় যে জঙ্গিদের সঙ্গে ছেলের সম্পর্ক রয়েছে, তা হলে যেন শাস্তি হয়। মহিলা বলেন, ‘‘দোষী হলে তো সেনা পদক্ষেপ করবেই।’’ খানিক থেমে আদিলের মা বলেন, ‘‘তার পর আমরা একটু শান্তিতে থাকতে পারি।’’ ডুকরে কেঁদে ওঠেন মহিলা। এক ছেলের জন্য পরিবার থেকে পাড়ার সকলে যে অসুবিধার মধ্যে পড়েছেন, তা আর সহ্য করতে পারছেন না তিনি। ৭ বছর ছেলের মুখ দেখেননি (দেখতে পাননি)। আর হয়তো দেখতে চান-ও না শেহজ়াদা। তিনি বলেন, ‘‘যেখানেই থাকিস, এ বার আত্মসমর্পণ কর। তা হলে আমারা শান্তিতে থাকতে পারি।’’
আরও পড়ুন:
শেহজ়াদা জানান, সেনানিরা তাঁকে বেশ কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছেন। তিনি যথাযথ জবাব দিয়েছেন। কিছু লুকোননি। তিনি বলেন, ‘‘বৃহস্পতিবার বাড়িতে সেনা এল। এই ঘর, ওই ঘর তন্ন তন্ন করে কী যেন খুঁজল। তার পর এক জন ভিডিয়ো কল করলেন আর্মি অফিসারকে। তাঁকে পুরো বাড়ি দেখালেন। তার পর আমার কাছে এসে সেনা বলল, ‘আপনার ছেলে বাড়িতে এসেছিল খাওয়া-দাওয়া করতে।’ আমি বললাম, ‘জানতেন তো গ্রেফতার করেননি কেন?’.... তার পর জওয়ানদের আমি বললাম যে, ছেলেকে কয়েক বছর চোখের দেখাও দেখিনি। অনেক বছর হল, বাড়ি ফেরেনি আদিল।’ তখন সেনার তরফে জানানো হল, বাড়ি ভেঙে দেওয়া হবে। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে। তাই করলাম।’’
পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিহানার পরে আদিলের বাবা ওয়ালেম মোহাম্মদ ঠোকর, ভাই জ়াহির এবং আরসালাম, সকলে জেলে। মাকে এক দিনের জন্য আটক করেছিল পুলিশ। পরে ছেড়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘আমার আর বাড়ি নেই। স্বামী-সন্তান জেলে। কত দিন আর প্রতিবেশীরা খাওয়াবে?’’ তার পর সেনার দেওয়া স্কেচের সঙ্গে আদিলের ছবি দু’হাতে ধরে মহিলা বললেন, ‘‘দেখুন, দু’জনের মিল নেই। আমাদের আদিল এই আদিল নয়।’’
প্রতিবেশীরা জানাচ্ছেন, ‘নিখোঁজ’ হওয়ার আগে পর্যন্ত এলাকার শান্ত, ভদ্র ছেলে বলেই সকলে জানত তাকে। খানাবলের সরকারি কলেজ থেকে পাশ করার পরে ইগনু থেকে এমএ করছিল আদিল। তার পর হঠাৎ করে একদিন নিখোঁজ! ছেলেবেলার এক বন্ধুর কথায়, ‘‘ছোট থেকে ও চুপচাপ। খুব বেশি কথা বলত না। কারও সঙ্গে খুব একটা মিশতও না। পড়াশোনায় কিন্তু ভালই ছিল।’’