প্রথম রাউন্ড দেখে মনে হচ্ছিল তিনিই জিতছেন। মল্লিকার্জুন খড়্গের তোলা সাত দফা প্রশ্ন যে শুধু তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন তা-ই নয়, বফর্স কেলেঙ্কারি এবং ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার প্রসঙ্গ তুলে রীতিমতো এক হাত নিয়েছেন কংগ্রেসকে। আঘাত করেছেন তাদের অন্যতম দুর্বল স্থান রাজীব গাঁধীকে। সেই মোক্ষম ‘পাঞ্চ’ খেয়ে বেশ বিহ্বলই দেখাচ্ছিল কংগ্রেসকে। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও যেন আর নেই। ‘‘৩৮ বছরের রাজনৈতিক জীবন জুড়ে আমি তপস্যা করেছি। এখন এই প্রান্তে এসে তা ভঙ্গ করব কেন?’’ —এই বলে যখন তিনি বলা শেষ করলেন, তখন পাশে বসা লালকৃষ্ণ আডবাণীর স্নেহের হাত এসে পড়ল প্রিয় শিষ্যের পিঠে।
তখনও মনে হচ্ছিল, অদৃশ্য রেফারির রায় এটাই হবে যে, কেলেঙ্কারির ইতিবৃত্তান্ত যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত সুষমা স্বরাজ আপনিই জিতলেন। কিন্তু দিনের শেষে দেখা গেল, পাশার দান উল্টে গিয়েছে। পরের রাউন্ডে পাল্টা ‘পাঞ্চে’ সমতা ফিরিয়েছেন রাহুল গাঁধী। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়ে পাশে দাঁড়াননি অরুণ জেটলি। সুষমার সম্বল ও সান্ত্বনা বলতে মোদী জমানায় দলে ব্রাত্য আডবাণীর স্নেহের ছোঁয়াটুকুই।
আগাগোড়া অচল থাকার পরে বাদল অধিবেশন শেষের আগের দিন সরকার পক্ষ আচমকা কেন কংগ্রেসের আনা মুলতুবি প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল, সেটা একটা রহস্য। সুষমা-বসুন্ধরার ইস্তফার দাবিতে অনড় থাকা কংগ্রেসও কেন মত পাল্টে আলোচনায় রাজি হয়ে গেল, রহস্য সেটাও। সরকার পক্ষ বলছে, আজ আলোচনা হয়ে যাওয়ার পরে কংগ্রেসের বিরোধিতার আর ঝাঁঝ থাকবে না। কংগ্রেসের বক্তব্য, আলোচনা না-করে শুধু বিরোধিতায় সংসদ অচল করার দায় চাপছিল তাদের উপরে। তবে অনেকেরই মতে, দু’টো যুক্তিই আধা সত্য। বিজেপি-কে তাঁদের প্রশ্ন, তা হলে এত দিন আলোচনার দাবি মানা হয়নি কেন? আর কংগ্রেসকে প্রশ্ন, একেবারে শেষ লগ্নে আলোচনা করে অচলাবস্থার দায় ঝেড়ে ফেলা কি সম্ভব?
সুষমা অবশ্য বললেন, তিনি সংসদে আলোচনার অপেক্ষাতেই ছিলেন। সেই কারণেই বাইরে আত্মপক্ষ সমর্থনে মুখ খোলেননি। কংগ্রেস সাংসদদের লাগাতার স্লোগান উপেক্ষা করেই আজ মুখ খুললেন। এবং বললেন, ‘‘রাহুল গাঁধী বলে বেড়াচ্ছেন, ললিত মোদীর থেকে আমি কত টাকা নিয়েছি? তাঁর সঙ্গে আমার কী লেনাদেনা হয়েছে? রাহুল গাঁধীর ছুটি কাটাতে যাওয়ার অভ্যাস আছে। এ বার ছুটিতে ঠান্ডা মাথায় নিজের পরিবারের ইতিহাসটা ভেবে দেখবেন। জিজ্ঞাসা করবেন, মাম্মা আমরা কুত্রোচ্চির কাছ থেকে কত টাকা নিয়েছি। ১৫ হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী যে অ্যান্ডারসন (ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনায় অভিযুক্ত ইউনিয়ন কার্বাইডের তৎকালীন কর্ণধার), তাঁকে কেন ছেড়ে দিয়েছিলেন ড্যাডি? তা হলেই বুঝতে পারবেন লেনদেন কাকে বলে!’’
সংখ্যার ভারে লোকসভায় কংগ্রেস কোণঠাসা। যদিও বিতর্কের শুরুতে পড়ে পাওয়া সুযোগ কুড়িয়ে দলকে চাঙ্গা করে দিয়েছিলেন সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী। আলোচনা শুরু করে লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা মল্লিকার্জুন খড়্গে যখন সুষমাকে সাত প্রশ্নবাণে বিঁধছেন, আক্রমণ করছেন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজেকে, তখন মাঝে মধ্যেই ফোড়ন কাটছিলেন বিজেপি সাংসদ সতীশ গৌতম। দুম করে তিনি বলেন, ‘‘আইপিএলে সনিয়ার কালো টাকাও খেটেছে। সেই টাকা আছে সনিয়ার বোনের কাছে।’’ এমনিতেই সনিয়া এ বার গোড়া থেকে সংঘাতের মুডে রয়েছেন। সতীশের কথা শুনেই তিনি ঝাঁঝিয়ে ওঠেন। তার পর নজিরবিহীন ভাবে ছুটে যান স্পিকারের আসনের দিকে। বলেন, ‘‘আমার সম্পর্কে কী যা তা বলছে! ওঁকে ক্ষমা চাইতে বলুন।’’ কংগ্রেস সভানেত্রীর এই আগ্রাসী মূর্তি দেখে বিজেপি নেতারাও চমকে যান। হট্টগোলের জেরে সভা মুলতবি করে দেন স্পিকার। তখনও রাগে
থর থর করে কাঁপছেন সনিয়া। এমনকী মা-কে শান্ত করতে রাহুল কাঁধে হাত রাখলেও এক ঝটকায় সরিয়ে দেন তিনি।
বেলা তিনটে পর্যন্ত ওই ‘ফ্রেমটাই’ হিট ছিল। বিজেপি নেতারা আফশোস করছিলেন, এর পর তো সুষমার কথা কেউ শুনবেই না! টিভিতে খালি সনিয়াকেই দেখাবে! হাল ফেরাতে নিজের বাচন দক্ষতা উজাড় করে দেন সুষমা। খোদ রাজীর গাঁধীর উপর তাঁর ক্ষুরধার আক্রমণের মুখে পড়ে স্রেফ ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকেন কংগ্রেস সাংসদরা। হেডফোন কানে চেপে ধরা সনিয়ার চোখেমুখেও অস্বস্তি। আড়ালে আবড়ালে দলের অনেক নেতা এমন মন্তব্যও করতে শুরু করেন যে, কী দরকার ছিল ললিত-কাণ্ড নিয়ে বিতর্কে রাজি হওয়ার! এ ভাবে মুখ পোড়ানোর!
রাহুল তখন সভাকক্ষে ছিলেন না। আধ ঘণ্টা পরে এসে মায়ের কাছ থেকে সবটা শুনলেন। হাবেভাবে অসহিষ্ণু দেখাল তাঁকে। বার তিনেক সভা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন, ফের ঢুকলেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে এর কিছু ক্ষণ পরেই হোয়াটসঅ্যাপে সাংবাদিকদের কাছে মেসেজ আসতে শুরু করে, ‘সুষমার মন্তব্যের জবাব সংসদেই দেওয়া হবে। অপেক্ষা করুন।’ বোঝা গেল তৈরি হচ্ছেন কংগ্রেস সহ-সভাপতি।
এর পর আসরে নেমে দলকে টেনে তোলার চেষ্টায় গত কাল সুষমার সঙ্গে তাঁর একান্ত আলোচনাকেই হাতিয়ার করলেন রাহুল। বললেন, ‘‘গত কাল সুষমাজি আমার হাত চেপে ধরেছিলেন। এই ভাবে। বলেছিলেন, বেটা আমার ওপর রেগে আছ কেন? আমি ওঁর চোখের দিকে তাকিয়ে বলি, রেগে নেই তো। আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু আমি সত্যি কথাটা বলছি। আপনি এটা (ললিত কাণ্ড প্রসঙ্গে) কেন করলেন? সুষমাজি উত্তর দিতে পারেননি। চোখ নামিয়ে নিলেন।’’
শুধু সুষমা নয়, নরেন্দ্র মোদীকেও আক্রমণ করেছেন রাহুল। বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’। আর এখন বলছেন, খাতে রহো। সুষমাজির পক্ষে দাঁড়িয়ে সংসদে মুখ খোলার হিম্মত নেই প্রধানমন্ত্রীর।’’
ঘটনা হল, এ দিন ললিত-কাণ্ড নিয়ে আলোচনার আগাগোড়াই সংসদে ছিলেন না প্রধানমন্ত্রী। সরকারের তরফে জবাব দিতে উঠে রাহুলকে কটাক্ষ করে ‘জ্ঞানহীন বিশেষজ্ঞ’ বলেছেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। পরোক্ষে গাঁধী পরিবারকে আক্রমণ করে বলেছেন, ‘‘এমনও পরিবার আছে যাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম কোনও কাজ না-করেই চলে যাচ্ছে।’’ কিন্তু ব্যক্তি সুষমার ঢাল হতে চাননি। সুষমা দাবি করেছিলেন, তিনি ললিত মোদীর পাশে দাঁড়াননি। মানবিকতার কারণে সাহায্য করেছিলেন তাঁর ক্যানসার আক্রান্ত স্ত্রীকে। বিরোধী শিবিরের প্রশ্ন ছিল, মানবিকতাই যদি দেখাতে হয়, তা হলে এত গোপনে কেন? কেন ব্রিটিশ দূতাবাস সেটি জানল না? কেন বিদেশসচিব, এমনকী প্রধানমন্ত্রীও বিন্দুবিসর্গ টের পেলেন না? সুষমার কী স্বার্থ রয়েছে যে এত গোপনে মানবিকতা দেখাতে হল? সুষমা জবাবে বলেন, তাঁর পারিবারিক কোনও স্বার্থ ছিল না। ললিত মোদীর পাসপোর্ট মামলায় তাঁর স্বামী আইনজীবী ছিলেন না। তাঁর মেয়ে জুনিয়র কৌঁসুলি হলেও এক পয়সা নেননি।
মোদী সরকার কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়েছে। জেটলি আজ বলেন, ‘‘পারিবারিক বিষয় কী ছিল, আমি সে প্রসঙ্গে যেতে চাই না। কারণ, আমি সরকারের পক্ষ থেকে জবাব দিচ্ছি। সরকারের এখানে কোনও লেনাদেনা নেই। সুষমাজি নিজের তরফে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।’’ এমন জবাব স্বাভাবিক ভাবেই
জল্পনা ছড়িয়েছে। রাতে জল্পনা আরও বেড়েছে প্রধানমন্ত্রীর টুইটে। সংসদে সুষমার বক্তৃতাকে তিনি মন্তব্যবর্জিত স্রেফ ‘অবশ্যই দেখুন’ আখ্যা দিয়েছেন। অন্য দিকে, জেটলির বক্তৃতার আগে জুড়ে দিয়েছেন ‘তীক্ষ্ণ এবং যুক্তিপূর্ণ’ বিশেষণ।
ফলে সংসদের শেষ লগ্নে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার পিছনে দলের অন্তর্কলহই দেখছেন বিজেপি নেতাদের অনেকে। এক কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘‘আলোচনার ফল হল এই যে সুষমাকে কংগ্রেসের গাল শুনতে হল। যা দেখে আডবাণীজি, বেঙ্কাইয়া নায়ডুর চোখে জল এল। কিন্তু দলের অন্দরে কোনও ইতিবাচক বার্তা গেল না।’’ সুষমার বক্তৃতার সময় আগাগোড়া কংগ্রেসের স্লোগান এবং ওয়াক আউট করে জেটলিকে নির্বিঘ্নে বলতে দেওয়ার পিছনে কী রহস্য, সেই প্রশ্নও উঠছে শাসক শিবিরে।
আর আমজনতার প্রশ্ন হল, কাল থেকে কী হবে? আজকের আলোচনায় কি সব চুকেবুকে গেল?
রাজধানীর রাজনীতিকদের মতে, আদতে কিছুই হল না। আত্মপক্ষ সমর্থনের দায় সুষমার একার কাঁধে ঠেলে দিলেও তাঁকে অন্তত এখনই ইস্তফা দিতে বলবেন না মোদী। কারণ সে ক্ষেত্রে দুর্নীতির দায় মেনে নেওয়া হবে। সুষমা যে ইস্তফা দেবেন না, সে কথা আজ সংসদে স্পষ্টই বলে দিয়েছেন জেটলি। আর কংগ্রেসও যে সুষমার ইস্তফার দাবি থেকে সরবে না, সেটা এ দিনই দলীয় সাংসদদের সঙ্গে নৈশভোজে স্পষ্ট করেছেন সনিয়া। তিনি বলেছেন, ‘‘তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা কোনও অভিযোগেরই জবাব সুষমার কাছে ছিল না। তাই এমন উল্টোপাল্টা অভিযোগ তুলেছেন। আমরা ওঁর ইস্তফার দাবিতে অনড় থাকব।’’
সুতরাং আগামিকাল সংসদের বাদল অধিবেশন শেষ হলে রাস্তায় নেমে আগের ভাষাতেই দু’পক্ষ একে অপরের সমালোচনা করবে। পরের অধিবেশন তিন মাস পরে। তার আগে মূলত বিহারের ভোটের ফলই বলে দেবে রাজনীতির জল কোথায় গড়াবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy