Advertisement
০২ মে ২০২৪
Bharat Jodo Nyay Yatra

‘মহব্বত কি দুকান’ লেখা বাসের সামনে আছড়ে পড়ল ‘নফরত’! কেন এমন ঘটল রাহুলের যাত্রাপথে?

রবিবার থৌবাল থেকে ‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’ শুরু করে ইম্ফল শহর পেরিয়ে পশ্চিম ইম্ফল জেলার সেকমাইতে রাত কাটিয়েছিলেন রাহুল গান্ধী। পূর্ব ও পশ্চিম ইম্ফল, থৌবাল, বিষ্ণুপুর ও কাকচিং।

Rahul Gandhi

ইম্ফলের সেকমাই গ্রামে পৌঁছল রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’। ছবি: পিটিআই।

প্রেমাংশু চৌধুরী
সেনাপতি (মণিপুর) শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:৩৯
Share: Save:

‘উই ওয়ান্ট, সেপারেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’!

স্কুলপড়ুয়া ছেলের দল। হাতে তিরঙ্গা জাতীয় পতাকা। গলার শিরা ফুলিয়ে দাবি তুলছে। চোখে-মুখে রাগ, বিদ্বেষ ঠিকরে বের হচ্ছে।

সোমবার সকালে রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’র বাস পশ্চিম ইম্ফল থেকে সবে কাংপোকপি জেলায় ঢুকেছে। ‘মহব্বত কি দুকান’ লেখা সেই বাসের সামনে আছড়ে পড়ল ‘নফরত’— বিদ্বেষ, রাগ, ক্ষোভ। রাস্তার ধারে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া, আগুন ধরিয়ে দেওয়া ঘরবাড়ির চিহ্ন। স্কুল পড়ুয়াদের মনেও জমে ওঠা বিদ্বেষ ফুটে উঠেছে রাস্তার পাশে কালো কালির দেওয়াল লিখনে—‘নো পিস’। শান্তি নয়। শান্তি চাইলে দাবি মানতে হবে—‘সেপারেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’। আলাদা প্রশাসন।

রবিবার থৌবাল থেকে ‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’ শুরু করে ইম্ফল শহর পেরিয়ে পশ্চিম ইম্ফল জেলার সেকমাইতে রাত কাটিয়েছিলেন রাহুল গান্ধী। পূর্ব ও পশ্চিম ইম্ফল, থৌবাল, বিষ্ণুপুর ও কাকচিং। মণিপুরের সমতলে এই পাঁচ জেলাই মেইতেই সম্প্রদায় অধ্যুষিত। সোমবার সকালে রাহুলের বাস ঢুকল কুকি-প্রধান কাংপোকপি, সেনাপতি জেলায়।

তার আগে সকালেই রাহুলের যাত্রার কনভয়ের সমস্ত গাড়ির চালক বদলে ফেলতে হয়েছে। কারণ, মেইতেইরা কুকি এলাকায় ঢুকতে পারবেন না। ঢুকলে প্রাণ নিয়ে ফেরার নিশ্চয়তা নেই। একই কারণে কুকিরাও মেইতেই এলাকায় ঢোকেন না। একমাত্র রাজ্যের বাইরের চালক বা মেইতেই পাঙ্গাল বা মুসলিমরা দুই এলাকাতেই ঢুকতে পারেন।

কুকি অধ্যুষিত এলাকা থেকে মেইতেইরা পালিয়ে গিয়েছেন। মেইতেই অধ্যুষিত এলাকা থেকে কুকিরা প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়েছেন। মণিপুরে প্রভাবশালী মেইতেইদের জনজাতি তকমা দেওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন আদিবাসী কুকিরা। তাকে কেন্দ্র করে গত আট মাস ধরে খুনোখুনি চলছে। পুলিশ, সেনা, নিরাপত্তা বাহিনীর অতন্দ্র প্রহরা, টহলদারি চলছে। তা সত্ত্বেও সুযোগ পেলেই এক সম্প্রদায়ের জঙ্গি বাহিনী অন্য সম্প্রদায়ের উপরে হামলা চালাচ্ছে। প্রতিটি গ্রামের প্রবেশপথে বিজ্ঞপ্তি—‘বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ’। গ্রামবাসীদেরও সন্ধ্যার আগে বাড়িতে ঢুকে পড়ার সতর্কবার্তা।

কাগজে-কলমে রাজ্য একটাই। মণিপুর। বাস্তবে আড়াআড়ি ভাবে ‘দ্বিখণ্ডিত’। রবিবার রাতে মেইতেই সংগঠনের প্রতিনিধিরা রাহুল গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তাঁদের অনুরোধ, রাহুল গান্ধী সংসদে বাজেট অধিবেশনে মণিপুর নিয়ে সরব হন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে মণিপুরে আসতে বলুন। কারণ গত আট মাসে মোদী মণিপুর-মুখো হননি।

সোমবার কুকি সংগঠনের প্রতিনিধিরা রাহুলের হাতে স্মারকলিপি তুলে দিলেন। তাঁরা রাজধানী ইম্ফলে বসে থাকা মেইতেইদের শাসন মানতে রাজি নন। তাঁদের পৃথক প্রশাসন চাই। কুকি সম্প্রদায়ের কলেজ পড়ুয়ারা রাহুলকে জানালেন, তাঁরা ইম্ফলের কলেজে পড়াশোনা করছিলেন। হিংসার জেরে তাঁদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কুকি সংগঠনের অভিযোগ, অসুস্থ রোগীদের ইম্ফলের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। রাহুল গান্ধী হস্তক্ষেপ করুন।

সোমবার সেনাপতি শহরের মোড়ে যখন রাহুল গান্ধীর বাস পৌঁছল, তখন শ’য়ে শ’য়ে জনতা হাজির। রাহুল বাসের মাথায় উঠে শুধু বললেন, তিনি চান, মণিপুরে দ্রুত শান্তি, সম্প্রীতি ফিরুক। এই কারণেই তিনি মণিপুর থেকে ‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’ শুরু করেছেন। বিজেপি শাসিত মণিপুর কী ভাবে বিদ্বেষের আগুনে বিভাজিত হয়ে গিয়েছে, তা তিনি দেশের সামনে তিনি তুলে ধরতে চাইছেন। রাহুলের ভাষায়, “আজ মণিপুর গোটা দেশের দিকে আশা নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। তাঁদের চোখের যন্ত্রণা মুছে আশার প্রদীপ জ্বালাতে হবে। আমাদের যাত্রা বিজেপির এই বিভাজন, উপেক্ষার রাজনীতিতে জখম ভারতের আত্মায় ঐক্য ও মহব্বতের মলম।”

অতীতে কুকিরা প্রাণ দিয়ে মণিপুরের মেইতেই রাজাদের বহিরাগত আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছেন। সেই রাজবংশের বর্তমান উত্তরাধিকারী মহারাজা সানাজাওবা লেইশেম্বা এখন বিজেপির রাজ্যসভা সাংসদ। অথচ তিনি কুকি অধ্যুষিত এলাকায় যেতে পারেন না। কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র জয়রাম রমেশ বলছিলেন, “আগে আমরা মণিপুরে এলে মণিপুরি সংগঠনের সঙ্গে দেখা করতাম। এখন মণিপুরি কুকি, মণিপুরি মেইতেই সংগঠনের সঙ্গে আলাদা ভাবে দেখা করতে হচ্ছে। মণিপুরের বিজেপির লোকসভার সাংসদ রাজকুমার রঞ্জন সিংহ কেন্দ্রে মোদী সরকারের বিদেশ প্রতিমন্ত্রী। গত আট মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করার সময় পাননি। প্রধানমন্ত্রী মণিপুরে আসেন না। মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করেন না। অথচ তিনি বিজেপি সরকারেরই মুখ্যমন্ত্রী।” মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ আজও অভিযোগ তুলেছেন, রাহুল গান্ধী ‘ভারত জোড়ো’-র নামে ‘ভারত তোড়ো’-র লক্ষ্য নিয়ে বেরিয়েছেন। বাস্তব হল, তাঁর সরকারের দুই কুকি সম্প্রদায়ের মন্ত্রী, লেটপাও হাওকিু ও নেমচা কিপজেন গত আট মাস ধরে রাজ্যের রাজধানী ইম্ফলে যেতে পারেননি। তাঁদের সরকারি বাসভবন মেইতেই-রা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের অনলাইনে যাবতীয় সরকারি কাজকর্ম করতে হচ্ছে।

এই ‘দ্বিখণ্ডিত’ মণিপুরকে সাক্ষী রেখেই ‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’ মণিপুরের পথ শেষ করে নাগাল্যান্ডের খুজামা-তে পৌঁছে গিয়েছে। এ বার যাত্রা শুরু হবে নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমা থেকে। তার আগেই নাগাদের জনজাতি সংগঠন ‘নাগা হোহো’ রাহুলের সঙ্গে দেখা করে অভিযোগ তুলেছেন, মোদী সরকার ও এনএসসিএন (আই-এম)-এর মধ্যে ২০১৫-তে খসড়া চুক্তি হলেও এখনও তা রূপায়ণ হয়নি। অথচ মোদী সরকার এই চুক্তিকে নাগাল্যান্ডের সমস্যার সমাধান হিসেবে তুলে ধরেছিল। কংগ্রেস নেতাদের কটাক্ষ, রাজ্য পাল্টায়। মোদী সরকারের প্রচারের আলোয় লুকিয়ে থাকা ব্যর্থতার কাহিনি পাল্টায় না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE