Advertisement
E-Paper

শত্রু নিধনে এ বার রেলে ‘সুপারি কিলার’

লাশ ফেলতে হবে, লাশ! বোঝা গেল? এ বার কত লাগবে, খোলসা করে বললে ভাল হয়!একটা-দু’টো নয়, প্রচুর বডি ফেলতে হবে। দেশ জুড়ে ওদের জাল ছড়ানো। তাই আমাদেরও সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে হবে। এমন ভাবে ওদের মারতে হবে, যাতে গ্যাং-টা স্রেফ হাওয়া হয়ে যায়।

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৪:১৪
অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

লাশ ফেলতে হবে, লাশ!

বোঝা গেল? এ বার কত লাগবে, খোলসা করে বললে ভাল হয়!

একটা-দু’টো নয়, প্রচুর বডি ফেলতে হবে। দেশ জুড়ে ওদের জাল ছড়ানো। তাই আমাদেরও সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে হবে। এমন ভাবে ওদের মারতে হবে, যাতে গ্যাং-টা স্রেফ হাওয়া হয়ে যায়।

কোনও নাটকের সংলাপ নয়, এই খুনের সুপারিটা সত্যিই দেওয়া হয়েছে ক’দিন আগে। সত্যি বলতে কী, ঠিক কত লাশ ফেলতে হবে, ভাড়াটে খুনিদেরও জানা নেই। তাদের বলা হয়েছে, স্রেফ খতম করার কাজ চালিয়ে যেতে। সংখ্যাটা কয়েক লাখ হতে পারে, যদি সারা দেশ জুড়ে ঠিকঠাক নিকেশ করা যায় ‘তাদের’। যাদের খুদে চোখ, খাড়া কান, লম্বা লেজ আর ধারালো দাঁত। যারা থাকে স্যাঁতস্যাঁতে গর্ত খুঁড়ে, কিংবা অন্ধকার কোণে, ফাঁকফোকরে।

তাদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়েই ‘সুপারি কিলার’ ডেকেছে ভারতীয় রেল!

রেলের বিভিন্ন ‘জোন’-এর তরফে ইতিমধ্যেই ইঁদুর-নিধনে প্রসিদ্ধ বিভিন্ন সংস্থাকে মাঠে নামানোর কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে জোরকদমে। রেলের মোদ্দা কথা— ইঁদুরের জ্বালায় আমরা অস্থির। কোনও ওষুধই ধরছে না। অতএব বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে তাদের জব্দ করার উপযুক্ত পথ বাতলান। নিজেদের বাহিনী নামান। পাশাপাশি কাজটা যারা মোটের ওপর জানে, তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিন। ইঁদুর-বংশ ধ্বংস হওয়া চাই।

বংশের আবার নানা গোত্র। ধেড়ে, মেঠো, নেংটি...। কর্তারা জানাচ্ছেন, রেলের ওপর অত্যাচারে কোনওটিই কম যায় না। কোথাও ঘুমন্ত যাত্রীর পায়ে কামড় বসাচ্ছে নেংটি। কোথাও ধেড়ের উৎপাতে রেললাইনের ভিত ন়ড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। লখনউয়ের কাছে চারবাগ স্টেশন ভবনটা বহু যত্নে ঐতিহাসিক স্থাপত্যের আদলে তৈরি করা হয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, লম্বা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে সেই স্টেশনের তলার মাটিই ফোঁপরা করে দিয়েছে মেঠো মূষিকের দল।

মূলত স্টেশন, ইয়ার্ড বা কারশেডেই রাজত্ব ধেড়ে বা মেঠোদের। এ রাজ্যে শিয়ালদহ ও হাওড়া স্টেশনের নিত্যযাত্রীরা স্টেশনের লাইনের ফাঁকে ফাঁকে সেই বাহিনীর তাণ্ডব দেখে অভ্যস্ত। আর রেলের কামরায় (বিশেষত বাতানুকূল কামরা) বাসা বাঁধে নেংটি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বন্ধ অবস্থায় এসি কামরা গরম হয়ে ওঠে। সেই কারণেই সেখানে বাচ্চা পাড়তে পছন্দ করে মা-নেংটিরা। তার পর গোটা পরিবার চলন্ত ট্রেনে উপদ্রব শুরু করে। মাস কয়েক আগেই উত্তরবঙ্গ থেকে ফেরার পথে নেংটিদের হাতে হেনস্থা হতে হয়েছিল বেশ কয়েকটি পরিবারকে। সে যাত্রা ওষুধ ছড়িয়েও পুরোপুরি রেহাই মেলেনি।

দিকে দিকে এই হয়রানি রুখতেই নামানো হচ্ছে ‘খুনে’ বাহিনী। ইতিমধ্যেই যেমন ডাক পেয়েছেন বৃহন্মুম্বই পুরসভা এবং পঞ্জাব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা। রেলের এক কর্তা জানালেন, ইঁদুর মারার জন্য মুম্বইয়ের ওই পুরসভার বিশেষ বাহিনী রয়েছে। শহরের অলিগলি, নালা, সুড়ঙ্গে লুকিয়ে থাকা ইঁদুর দমন করে তারা। গত দু’বছরে তাদের হাতে অন্তত ৬ লাখ ইঁদুরের ‘লাশ পড়েছে’। আবার পঞ্জাবের ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিনী মাঠে নেমেই লুধিয়ানা ও জালন্ধর স্টেশনে এক মাসের মধ্যে ১০ হাজারেরও বেশি ইঁদুরকে খতম করেছে।

এই সব ‘সুপারির’ টাকাপয়সার কোনও অঙ্ক অবশ্য প্রকাশ্যে আসেনি। রেলের এক মুখপাত্র জানালেন, দেশজুড়ে ব্যাপক আকারে ‘হত্যাকাণ্ড’ চালাতে হবে বলেই বিভিন্ন ‘জোন’ নিজেদের মতো করে দরপত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্থাকে নিয়োগ করছে। প্রয়োজনে এক জোন অন্য জোনের বিশেষজ্ঞদের সাহায্যও নিতে পারে। বৃহন্মুম্বই পুরসভা ও পঞ্জাব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা যেমন ইঁদুর-নিধনের প্রশিক্ষণটাও দেবেন।

আসলে ‘যত পারো বিষ ঢালো আর ইঁদুর মারো’— কাজটা ঠিক এত সহজ নয়। ইঁদুর ঘোরাঘুরি করে মানুষের কাছাকাছি। ফলে ইঁদুর মারতে কী ধরনের বিষ প্রয়োগ করা যাবে, তা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র স্পষ্ট নির্দেশিকা রয়েছে। সেই কারণেই অপেশাদার কোনও সংস্থাকে এই নিয়োগের ঝুঁকি নিতে পারে না রেল বোর্ড। কিন্তু মুশকিল হয়েছে অন্যত্র। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, রেল এত দিন যে ধরনের বিষ ছড়িয়ে এসেছে, সম্ভবত সেগুলোর সঙ্গে এ বার মানিয়ে নিচ্ছে ইঁদুরেরা। কাজেই নতুন ওষুধ স্থির করা এবং তার বিজ্ঞানসম্মত প্রয়োগ ছাড়া কার্যত গতি নেই।

এ ভাবে কামরার নেংটিদের বন্দোবস্ত না হয় হল। কিন্তু ধেড়ে বা মেঠোদের বাগে আনা যাবে তো? রেল কর্তাদেরই অনেকে জানাচ্ছেন, স্টেশন এবং লাইনের পাশে গজিয়ে ওঠা খাবারের দোকান, হোটেল বা ঘিঞ্জি বসতিগুলো ইঁদুর-সাম্রাজ্যের বাড়বাড়ন্তের জন্য অনেকাংশে দায়ী। সেখানকার উচ্ছিষ্ট খেয়েই গায়ে-গতরে বেড়ে ওঠে তারা। ফলে ইঁদুর মারতে ‘সুপারি কিলার’ নিয়োগের পাশাপাশি বেআইনি বসতি বা দোকানপাট উচ্ছেদেও রেলকর্তারা সক্রিয় হবেন কি না, সেই প্রশ্ন থাকছে।

রেলের মতো এই উপদ্রব সইতে হয় শহর কলকাতাকেও। কার্জন পার্কে এক সময়ে ইঁদুরের রমরমা ছিল। সাম্প্রতিক পুর-সমীক্ষায় উঠে এসেছে, মহানগরের তলায় নিজেদের ‘মহানগর’ বানিয়ে ফেলেছে ইঁদুরেরা। তার ফলে নীচের মাটি ফাঁপা হয়ে গিয়ে ধস নামছে অনেক জায়গায়। ঢাকুরিয়া উড়ালপুলেও ইঁদুরের উপদ্রবের কথা বারবার উঠে এসেছে। এই অবস্থায় কলকাতা পুরসভাও সাহায্য চেয়েছে মুম্বইয়ের কাছে। পুরসভার স্বাস্থ্য দফতরের মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষের বক্তব্য, ‘‘শহরে ইঁদুরের উৎপাত রয়েছে। কিন্তু ইঁদুর মারার বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি আমাদের জানা নেই। সাহায্য চেয়ে মুম্বই পুরসভাকে পাঁচ বার চিঠি পাঠিয়েছি। এখনও উত্তর মেলেনি।’’

রেলের অবশ্য কোনও হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার জন্য অপেক্ষার সময় নেই। তাদের ছক পরিষ্কার।

‘মারব এখানে... লাশ পড়বে লাইনে!’

সহ প্রতিবেদন: কৌশিক ঘোষ

Rats Railway contract killer
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy