যুবভারতী কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে শুরু হল রাজনৈতিক চাপানউতর। লিয়োনেল মেসির সফরে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে বিশৃঙ্খলার ঘটনায় সরাসরি রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই নিশানা করেছে বিরোধী দলগুলি। সরাসরি রাজনীতির লোক না-হলেও এই ঘটনায় মেসি-সফরের প্রধান উদ্যোক্তা শতদ্রু দত্তের পাশাপাশি রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের সমালোচনা করেছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। খুব সম্ভবত ক্ষোভের আঁচ টের পেয়েই ঘটনার কিছু পরেই মেসি এবং দর্শকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বিশৃঙ্খলার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠন করার কথাও জানিয়েছেন তিনি।
শনিবার যুবভারতীতে মেসির পাশেই ছিলেন রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। মেসিকে জড়িয়ে ধরে কথা বলতেও দেখা যায় তাঁকে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন দর্শকদের একাংশ। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সমাজমাধ্যমে একটি পোস্ট করে দর্শকদের দুরবস্থার জন্য অরূপ এবং রাজ্যের আর এক মন্ত্রী সুজিত বসুকে দায়ী করেছেন। তিনি লিখেছেন, “যুবভারতীতে লিওনেল মেসির অনুষ্ঠানে চরম বিশৃঙ্খলা, মেসির গায়ে জোঁকের মতো চিটে রইলেন নেতা-মন্ত্রী-তারকারা, আর যাদের পিঠে কাঁঠাল ভেঙে মেসিকে দেখতে পাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে হাজার হাজার টাকার টিকিট কাটানো হল, সেই ফুটবলপ্রেমীদের ভাগ্যে জুটল ৫-৭ মিনিটের জায়ান্ট স্ক্রিনের দর্শন।” শুভেন্দু দর্শকদের টিকিটের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। এর পাশাপাশি অরূপ, সুজিত এবং প্রধান আয়োজক শতদ্রু দত্তকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন তিনি। ‘পশ্চিমবঙ্গের সম্মানহানি’র জন্য মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগও দাবি করেছেন বিরোধী দলনেতা। ইতিমধ্যেই যুবভারতী কাণ্ডে ‘নিরপেক্ষ বিচারবিভাগীয় তদন্তের’ দাবিতে রাজ্যপালকে চিঠি দিয়েছেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদারও। সমাজমাধ্যমে তিনি লেখেন, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উচিত এই মুহূর্তে পদত্যাগ করা! কারণ তাঁর পুলিশ-প্রশাসনের যাবতীয় পরিকল্পনাহীনতা এবং এই চূড়ান্ত অব্যবস্থার দায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে একমাত্র তাঁর উপরেই বর্তায়!”
টিকিটের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন রাজ্যপাল। অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের গ্রেফতার করার পাশাপাশি গোটা ঘটনা নিয়ে বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছেন বোস। তিনি বলেন, “আয়োজককে এখনই গ্রেফতার করতে হবে। যাঁরা কষ্টের উপার্জন দিয়ে হাজার হাজার টাকার টিকিট কেটেছিলেন, তাঁদের টাকাও ফেরত দিতে হবে। পাশাপাশি ক্রীড়াঙ্গনের যে ক্ষতি হল, সেটির ক্ষতিপূরণও দিতে হবে আয়োজক সংস্থাকে।” বিবৃতিতে রাজ্যপালের সংযোজন, “ রাজ্যের মানুষ, মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশকর্মীকে ব্যর্থ করে দিয়েছে রাজ্যের পুলিশ প্রশাসন। আজ পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার জন্য কালো দিনের সাক্ষী থাকতে হল কলকাতাকে।”
আরও পড়ুন:
যুবভারতী কেলেঙ্কারি নিয়ে রাজ্যের শাসকদলের সমালোচনায় সরব হয়েছে সিপিএমও। দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম খানিক বিদ্রুপের সুরে বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে খেলা হোক, মেলা হোক, বইমেলা হোক, বই ছাপা হোক, দুর্নীতি হবে না? কালোবাজারি হবে না? বিশৃঙ্খলা হবে না? ভাঙচুর হবে না? তৃণমূলের একটা বৈঠক কিংবা সভা হলেও গুলিগোলা চলে! এই জন্যই তো বাংলাকে বাঁচাতে হবে।” সেলিম স্মরণ করিয়ে দেন যে, এর আগে কলকাতায় পেলে এবং দিয়েগো মারাদোনা এলেও কোনও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। বিষয়টিকে সারদা কিংবা নারদের মতো নতুন দুর্নীতি বলে দাবি করেছে প্রদেশ কংগ্রেস। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকারের অভিযোগ, জনগণের টাকায় মেসিকে কলকাতায় নিয়ে আসা হলেও রাজ্যের শাসকদলের নেতা এবং তাঁদের আত্মীয়রাই ফুটবল তারকার সঙ্গে ছবি তুলেছেন। সমাজমাধ্যমে একটি পোস্ট করে গোটা ঘটনার জন্য উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি রাজ্য সরকার, বিধাননগর পুলিশ, ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ, স্থানীয় বিধায়ক সুজিতকে দায়ী করেছেন শুভঙ্কর।
শনিবার যুবভারতীতে মেসিকে সম্বর্ধনা দেওয়ার কথা ছিল মুখ্যমন্ত্রীর। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আর মাঠে যাননি তিনি। সমাজমাধ্যমে একটি পোস্ট করে যুবভারতীর ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়ে নেন মুখ্যমন্ত্রী। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অসীমকুমার রায়ের নেতৃত্বে তদন্তকমিটি গঠন করার কথা জানান। তিনি লেখেন, “সল্টলেক স্টেডিয়ামে শনিবার যে অব্যবস্থা দেখা গেল, তাতে আমি বিচলিত এবং স্তম্ভিত।’’ একই সঙ্গে তিনি লেখেন, “এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার জন্য আমি লিয়োনেল মেসি, সকল ক্রীড়াপ্রেমী এবং তাঁর ভক্তদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।’’ তবে মুখ্যমন্ত্রীর এই ক্ষমাপ্রার্থনাকে ‘কুম্ভীরাশ্রু’ বলে কটাক্ষ করেছে বিজেপি।
মুখ্যমন্ত্রীর পোস্ট শেয়ার করে বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালবীয় মমতার উদ্দেশে লেখেন, “কুমিরের কান্না বন্ধ করুন। সব বিষয়ে আপনার সরকার দুর্নীতি আর বিশৃঙ্খলা তৈরি করে।” তিনি অরূপ এবং সুজিতেকে অনতিবিলম্বে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান। দর্শকদের টিকিটের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার কথাও বলেন।
শনিবার বিকেলে দিল্লিতে সাংবাদিক সম্মেলনে বিজেপি সাংসদ সুশাংশু ত্রিবেদী যুবভারতীর ঘটনা প্রসঙ্গে বেঙ্গালুরু এবং তামিলনাড়ুর পদপিষ্ট কাণ্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। এই সূত্রে তাঁর দাবি, বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র নেতারা আইনশৃঙ্খলারক্ষায় ব্যর্থ।
মেসিকে স্বচক্ষে দেখতে শনিবার প্রায় কানায় কানায় পূর্ণ ছিল যুবভারতী। কিন্তু ‘ফুটবলের রাজপুত্র’কে ঘিরে থিকথিকে ভিড় থাকায় মেসিকে দর্শকাসন থেকে দেখাই যায়নি বলে অভিযোগ। চড়া দাম দিয়ে টিকিট কেটেও কেন মেসির পরিবর্তে মন্ত্রী এবং কর্মকর্তাদের দেখতে হবে, এই প্রশ্ন তুলে ভাঙচুর শুরু হয় যুবভারতীতে। মাঠে উড়ে আসতে থাকে জলের বোতল, ভাঙা চেয়ার। শেষমেশ র্যাফ নামিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। ইতিমধ্যেই পুলিশের তরফে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। মেসির সঙ্গে হায়দরাবাদ উড়ে যাওয়ার আগেই কলকাতা বিমানবন্দর থেকে পাকড়াও করা হয়েছে প্রধান আয়োজক শতদ্রুকে।