পুলিশকর্মীর কথাগুলো শুনেই মর্গের সামনে মাটিতে বসে পড়লেন অনিলভাই পটেল। বৃহস্পতিবার রাতভর এক বার কসৌটি ভবনের ডিএনএ পরীক্ষা কেন্দ্র, এক বার মর্গের গেটে ছুটে বেরিয়েছেন বছর সত্তরের বৃদ্ধ। যদি কোনও ভাবে খবর পাওয়া যায় ছেলে হর্ষিত আর বৌমা পূজার। খবর বলতে? ছেলে-বৌমার দেহ পাওয়া যাবে তো! অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে ব্রিটেনের বিমান ধরেছিল বছর পঁয়ত্রিশের পুত্র। স্বপ্নপূরণের সেই যাত্রা কয়েক মুহূর্তেই বদলে গিয়েছে দুঃস্বপ্নে। আর বৃদ্ধ ছুটে বেরিয়েছেন, সন্তানের দেহের জন্য।
শুক্রবার দুপুরের দিকে অনিলকে পুলিশকর্মীরা জানিয়ে দিলেন, ডিএনএ প্রোফাইল মিলে গিয়েছে। খোঁজ মিলেছে দু’জনেরই। কিন্তু দেহ নয়, পাওয়া গিয়েছে পূজার মাথা আর হর্ষিতের কোমরের উপরের অংশটুকু।
সন্তান, আত্মীয়, বন্ধুর খোঁজে আমদাবাদের সরকারি সিভিল হাসপাতাল জুড়ে শুধু হাহাকার। কেউ এসেছেন গুরুতর জখম আত্মীয়ের জন্য। কেউ ঝলসে যাওয়া সন্তানের জন্য। বহু মানুষ আবার আপনজনকে কোনও দিন দেখতে পাবেন না জেনেই এসেছেন। ডিএনএ নমুনা দিয়ে তাঁরা শুধু অপেক্ষা করে চলেছেন। জানা নেই, দেহটুকু পাবেন কি না।
বিশাল হাসপাতাল পেরিয়ে কার্যত ২০০ মিটারের মধ্যেই মেঘানী নগর। বৃহস্পতিবার দুপুরে যেখানে আছড়ে পড়েছিল এয়ার ইন্ডিয়ার ৭৮৭-৮ ‘ড্রিমলাইনার’। হাসপাতালের চৌহদ্দি পেরিয়ে সেই জায়গার দিকে যতই এগিয়েছি, হাহাকারের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে আতঙ্ক। গোটা এলাকাটাই যেন পোড়া চাটু। মুহূর্তে ছাই হয়ে গিয়েছে গাছপালা, মোটরবাইক, গাড়ি, মানুষের দেহ। এক ঝলক দেখলে মনে হতে পারে শতাধিক বাজ আকাশ ভেঙে পড়েছে একটাই জায়গায়। মাটির রং কালো। জায়গায় জায়গায় বিশাল গর্ত। তার মধ্যেই পড়ে রয়েছে বিমানের ভাঙা অংশ। আশপাশের একাধিক বহুতলেও ফাটল ধরেছে। তবে সবচেয়ে আতঙ্কের চেহারা ডাক্তারি পড়ুয়াদের সেই হস্টেলের।
পুলিশের ব্যারিকেড পেরোতেই চোখে পড়ে, হস্টেল ভবনের জমির চার দিকে লাগানো লোহার ফেন্সিং গলে গিয়েছে। পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া ভবনের বিভিন্ন অংশ ভেঙে পড়েছে। সেই ভাঙা অংশের সঙ্গেই এক জায়গায় ঝুলছে বিমানের লেজ। সেই দিক থেকে সিঁড়ি ধরে উঠতে চোখে পড়ে ছাদের চাঙড় খসে পড়েছে জায়গায় জায়গায়। তারপরই সিঁড়ি বলতে আর কিছু নেই। ঘরের ভিতরের সমস্ত কিছু এমন ভাবে পুড়ে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে যে, সেগুলি আগে কী ছিল তা ঠাওর করাই শক্ত। এই অংশ পেরিয়ে আর এক দিকে পৌঁছে দেখা গেল, ভেঙে পড়া বাড়ির অংশ সরানোর কাজ চলছে জোর কদমে।
জানা গেল, সেখানেই দুপুরে একসঙ্গে খেতে বসেছিলেন পাঁচ পড়ুয়া। আচমকাই তাঁদের উপর হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছিল দেওয়াল। আটকে পড়েছিলেন চার জন— এমবিবিএসের দ্বিতীয় বর্ষের রাকেশ দিয়োরা, জয়প্রকাশ চৌধুরী, প্রথম বর্ষের আরিয়ান রাজপুত ও মানব ভাড়ু। কেউ বেঁচে নেই। গুরুতর জখম আরও ছ’জন পড়ুয়াকে বি জে মেডিক্যাল কলেজ (আমদাবাদ সিটি হাসপাতাল)-এর আইসিইউ-তে ভর্তি করানো হয়েছিল। পরে তাঁদের মধ্যে চার জনকে বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের গলার, মুখের, পায়ের হাড় ভেঙেছে। কেউ আগুনে ঝলসে গিয়েছেন। বার্ন, অস্থি-শল্য এবং অন্য নানা সাধারণ ওয়ার্ডে রয়েছেন আরও জনা কুড়ি-পঁচিশ পড়ুয়া-সহ হস্টেলের প্রায় ৪০ জন।
এর মধ্যেই চিৎকার। ভেঙে পড়া অংশ এক জায়গায় কিছুটা সরাতেই পোড়া হাত। কাপড়ে জড়িয়ে এরপর বার করে আনা হয় দেহ। অ্যাম্বুল্যান্সে তোলার সময় দেখা গেল, চাদরের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে রয়েছে প্রায় ছাই হয়ে যাওয়া সেই দেহের হাত। তাতে তখনও শক্ত করে ধরা লোহার টুকরো। পোড়া বাড়ির অন্য দিক থেকে নিজেদের জরুরি সামগ্রী বার করে নিয়ে যেতে হাজির এক ডাক্তারি পড়ুয়া চিৎকার শুরু করলেন, “হাতটা সাবধান, তুলে নিন, তুলে নিন, খসে পড়ে যেতে পারে।” পাশ থেকে এক বাসিন্দা বলে ওঠেন, “এ ভাবে নিয়ে যেতে যেতে কত মৃতদেহের অংশ যে খসে পড়ে যাচ্ছে, বলে বোঝানোর নয়। গত রাত থেকেই এখানে কেউ থাকছি না। আতঙ্কে অনেকে আত্মীয়দের বাড়ি গিয়ে থাকছেন।”
আতঙ্ক এলাকার সর্বত্রই। মুখে মুখে ঘুরছে— বিমানটা যদি আরও আগে গিয়ে পড়ত, তা হলে আরও কত কী হত! ডাক্তারি পড়ুয়াদের এই হস্টেল পার করেই তো বসবাসের বড় এলাকা। গায়ে গায়ে সব বাড়ি। এমনই এক বাড়ির বাসিন্দা বললেন, “প্লেনটা ভেঙে পড়ার সময় মনে হচ্ছিল, পুরো শহরই বুঝি মাটি ফুঁড়ে নীচে ঢুকে যাবে। এখন প্লেন দেখলেই আতঙ্ক হচ্ছে।” বৃহস্পতিবার রাতে পৌঁছে একই রকম আতঙ্ক দেখেছি আমদাবাদ বিমানবন্দরেও। একাধিক উড়ান তত ক্ষণে বাতিল করা হয়েছে। বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মী বা স্টলের মালিক, সকলেই বলছেন, “ঘোরের মধ্যে রয়েছি। এই আতঙ্ক কাটিয়ে কবে আবার সব স্বাভাবিক হবে, বলা যাচ্ছে না কিন্তু।”
তথ্য সহায়তা: শান্তনু ঘোষ
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)