ছোট শরীরটা পুড়ে কঙ্কাল হয়ে গিয়েছে। কয়লার মতো হাড় ছাড়া কিচ্ছু নেই! গুজরাতের অহমদাবাদের সিভিল হাসপাতালে বাইরে বসে আর্তনাদ করছেন সুরেশভাই পাটনি। বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ১৫ বছরের পুত্র আকাশের দেহ শনাক্ত করতে পেরেছেন তিনি। কিন্তু শ’য়ে শ’য়ে স্বজনহারা সেটুকুও পারেননি। দুর্ঘটনায় নিহতদের দেহ এতটাই পুড়ে গিয়েছে যে, শনাক্ত করতে পারছেন না প্রিয়জনেরাও। সরকারি সূত্র বলছে, শুক্রবার মাত্র আটটি দেহ শনাক্ত করে পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। বাকি দেহ শনাক্তকরণের জন্য নিহতদের আত্মীয়ের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। গুজরাত সরকার জানিয়েছে, শুক্রবার ২১৯ জনের ডিএনএ এবং রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে নিহতদের ডিএনএ। মিললে পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হবে দেহ।
এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার বৃহস্পতিবার দুপুরে অহমদাবাদের মেঘানিনগরে ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গিলে খায় আগুন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পরে শুক্রবার জানান, ওই বিমানে ছিল ১.২৫ লক্ষ লিটার জ্বালানি। সেই জ্বালানি জ্বলার ফলে তাপমাত্রা ছিল অত্যধিক। ফলে বিমানের সওয়ার আরোহীদের বাঁচানোর সুযোগ পাওয়া যায়নি। ঝলসে গিয়েছে যাত্রীদের লাশ। উদ্ধারকারীদের একাংশ বলছেন, সে কারণে দেহ শনাক্তকরণ কঠিন হয়ে পড়েছে। শেষ ভরসা এখন ডিএনএ পরীক্ষা।
মেঘানিনগরে বিজে মেডিক্যাল কলেজের হস্টেলের কাছেই ছিল আকাশের মা সীতাবেনের চায়ের দোকান (এখন শুধুই পোড়া ছাই)। বৃহস্পতিবার দুপুরে মা-কে দোকানে খাবার দিতে গিয়েছিল অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। তখনই ভেঙে পড়ে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান। কিছু বোঝার আগেই আগুনের গোলা গ্রাস করে আকাশের শরীর। তাকে বাঁচাতে গিয়ে তার মায়ের শরীরের ৫০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছে। তিনি এখন সিভিল হাসপাতালে ভর্তি। বাবা পাটনি জানিয়েছেন, ছেলের মৃত্যুর খবর পেলে আর বাঁচানো যাবে না স্ত্রীকে। আপাতত তাই সিভিল হাসপাতালে বাইরে অপেক্ষা করছেন তিনি।
পাটনির সঙ্গেই অপেক্ষা করছেন প্রহ্লাদ ভাই। বিমানটি যে ডাক্তারদের হস্টেলে ভেঙে পড়েছিল, সেখানেই রুটি তৈরি করতেন তাঁর স্ত্রী সরলা। বৃহস্পতিবার মায়ের সঙ্গে গিয়েছিল ছোট্ট আদ্যা। দুর্ঘটনার পর থেকে প্রহ্লাদ আর খোঁজ পাননি দু’জনের। মর্গে রাখা সারি সারি পোড়া লাশের মধ্যে মা-মেয়েকে চিনতে পারেননি। শুক্রবার ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নিজের রক্তের নমুনা দিয়েছেন প্রহ্লাদ। তার পর থেকে শুধুই অপেক্ষা। ফেডারেশন অফ অল ইন্ডিয়া মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (এফএআইএমএ) জানিয়েছে, বিমান ভেঙে পড়ে হস্টেলের ১০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চার জন ডাক্তারি পড়ুয়া, ছ’জন পড়ুয়াদের আত্মীয়। যদিও হস্টেলের কর্মীদের মৃত্যু হয়েছে কি না, সেই পরিসংখ্যান নেই।
শাহ বৃহস্পতিবারই জানিয়েছিলেন, নিহতদের পরিজনদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে। বিমানের চালক সুমিত সভরওয়ালের বাড়িতে গিয়েও তাঁর বাবার ডিএনএর নমুনা সংগ্রহ করে এনেছে সরকারি দল।
দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানে ছিলেন বিমানকর্মী ও যাত্রী-সহ ২৪২ জন। তাঁদের মধ্যে এক জনের প্রাণ রক্ষা হয়েছে। ১১এ আসনের ওই যাত্রীর নাম বিশ্বাসকুমার রমেশ। তিনি আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। শুক্রবার তাঁর সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। যে এলাকায় বিমানটি ভেঙে পড়েছে, সেই মেঘানিনগরে অনেকে আহত হয়েছেন। আহত প্রায় ৫০ জনকে সিভিল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। তাঁদের সঙ্গে শুক্রবার দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী।
দুর্ঘটনার ২৮ ঘণ্টার মাথায় উদ্ধার হয়েছে বিমানের একটি ব্ল্যাকবক্স। অহমদাবাদের মেঘানিনগরে চিকিৎসকদের যে হস্টেলে বিমানটি ভেঙে পড়েছিল, তার ছাদ থেকে শুক্রবার উদ্ধার হয়েছে সেই ব্ল্যাকবক্স। এই ব্ল্যাকবক্সের মধ্যে বিমানের প্রয়োজনীয় তথ্য বন্দি থাকে। সেই নথি, তথ্য বিশ্লেষণ করে দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ জানা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। কী কারণে ভেঙে পড়ে ওই বোয়িং বিমান, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
হস্টেলে মৃত্যু
বিজে মেডিক্যাল কলেজের হস্টেলে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন ডাক্তারি পড়ুয়ারা। অনেকের সঙ্গেই ছিলেন পরিবারের সদস্যেরা। সে সময় বাড়িটির উপর ভেঙে পড়ে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান। বৃহস্পতিবারের দুর্ঘটনায় বিমানের আরোহীদের সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছেন হস্টেলের কয়েক জন। শুক্রবার ফেডারেশন অফ অল ইন্ডিয়া মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (এফএআইএমএ) জানিয়েছে, বিমান ভেঙে পড়ে হস্টেলের ১০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চার জন ডাক্তারি পড়ুয়া, ছ’জন পড়ুয়াদের আত্মীয়।
উদ্ধার ব্ল্যাকবক্স
এয়ার ইন্ডিয়ার দুর্ঘটনাগ্রস্ত সেই বিমানের ব্ল্যাকবক্স মিলেছে। অহমদাবাদ দুর্ঘটনার তদন্ত করছে এয়ারক্রাফট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (এএআইবি)। ওই তদন্তকারী সংস্থার একটি দল এবং গুজরাত সরকারের ৪০ জন আধিকারিক শুক্রবার ঘটনাস্থলে তল্লাশি চালিয়ে ব্ল্যাকবক্সটি উদ্ধার করেছেন বলে জানা গিয়েছে। এই ব্ল্যাকবক্সের নথি ঘেঁটে জানা যেতে পারে, ঠিক কী কারণে বিমানটির ওই পরিণতি হয়েছে। নাম ব্ল্যাকবক্স হলেও এই যন্ত্রের রং গাঢ় কমলা। বিমান ধ্বংস হয়ে গেলেও এটি নষ্ট হয় না। জলে পড়লে, আগুনে পুড়ে গেলেও বছরের পর বছর অক্ষত থাকে। এর মধ্যে বিমানের গতি, উচ্চতা, ইঞ্জিন কী ভাবে কাজ করছে, সেই সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য থাকে। ককপিটে কী কথাবার্তা চলছে, এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে পাইলটের কী কথা হয়েছে, তা-ও রেকর্ড করা থাকে এই ব্ল্যাকবক্সে।
কন্যাহারা
বাবা রিকশাচালক। অনেক কষ্ট করে মেয়েকে পড়াশোনা করিয়েছিলেন তিনি। সম্প্রতি একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরিও পেয়েছিলেন তরুণী। চাকরির সুবাদে সংস্থা থেকে তাঁকে লন্ডনে পাঠানো হচ্ছিল। প্রথম বার বিমানে চড়া, প্রথম বার বিদেশে যাওয়া, এই বিষয়গুলি নিয়ে অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত ছিলেন গুজরাতের হিম্মতনগরের তরুণী পায়েল খটিক। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন পায়েল।
ইচ্ছাপূরণ
স্ত্রী ভারতীবেনের শেষ ইচ্ছাপূরণ করতে গুজরাতে নিজের গ্রামে এসেছিলেন অর্জুন মনুভাই পাটোলিয়া। লন্ডনের বাড়িতে রেখে এসেছিলেন চার এবং আট বছরের দুই কন্যাকে। স্ত্রীর শেষ ইচ্ছাপূরণ করে আবার ফিরে যাওয়ার কথা ছিল তাদের কাছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুই শিশুকন্যার কাছে ফেরা হল না অর্জুনের। অহমদাবাদের বিমান প্রাণ গিয়েছে ৩৬ বছরের যুবকের। এক সপ্তাহ আগেই লন্ডনে মৃত্যু হয়েছে ভারতীবেনের। স্বামীকে তাঁর শেষ ইচ্ছা জানিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। গুজরাতের নর্মদায় নিজের অস্থি ভাসানোর কথা বলেছিলেন। সেই কাজ করতে গুজরাতের আমরেলি জেলায় নিজের গ্রাম ভাদিয়ায় এসেছিলেন অর্জুন। কিন্তু আর সন্তানদের কাছে ফেরা হল না অর্জুনের।
আলোচ্য আসন
১১এ। ইউরোপীয়রা বলেন, বোয়িং বিমানের এই আসনে যাত্রা করলে সফরের মেজাজটাই নষ্ট হয়! এই আসন নামেই ‘উইন্ডো সিট’। ১১এ-র পাশে আদতে কোনও জানলা নেই। বিমানের দেওয়াল। আর সে কারণেই যাত্রীরা মোটেও পছন্দ করেন না আসনটি। এয়ার ইন্ডিয়ার অহমদাবাদ-লন্ডনগামী বোয়িং বিমানের সেই আসনে বসেই প্রাণরক্ষা হয়েছে বিশ্বাসকুমার রমেশের। বিমান সওয়ার ২৪২ জনের মধ্যে একমাত্র তিনিই প্রাণে বেঁচেছেন। তার পরেই প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি বোয়িং বিমানের সবচেয়ে অপছন্দের এই আসনই সবচেয়ে নিরাপদ? সমাজমাধ্যমে এই প্রশ্ন করেছেন ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনকেরও।
বাবার জন্য
আর চাকরি করবেন না। এ বার চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাবার সঙ্গে থাকবেন দিনরাত। তাঁর দেখাশোনা করবেন। নিজের সমস্ত সময়টুকু বাবাকে দেবেন। নবতিপর বৃদ্ধকে এমনটাই কথা দিয়ে এসেছিলেন এয়ার ইন্ডিয়ার পাইলট ক্যাপটেন সুমিত। তাঁর বাবাও বিমান পরিবহণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভারতের অসামরিক বিমান পরিবহণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিজিসিএ-র প্রাক্তন আধিকারিক ছিলেন সুমিতের বাবা। এখন বয়স ৯০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। বাবাকে সময় দিতে চাকরি ছাড়ার কথা ভেবেছিলেন সুমিত। কিন্তু তা আর হল না।
হাসপাতালে মোদী
বৃহস্পতিবার দুপুরে যেখানে লন্ডনগামী এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটি ভেঙে পড়েছিল, সেখানে শুক্রবার যান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দুর্ঘটনাস্থল ঘুরে দেখার পর অহমদাবাদ সিভিল হাসপাতালেও যান প্রধানমন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে ছিলেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র পটেল, কেন্দ্রীয় অসামরিক বিমান পরিবহণমন্ত্রী রামমোহন নায়ডুও। হাসপাতালে গিয়ে বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের সঙ্গে কথা বলেন মোদী। এই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন বিশ্বকুমার রমেশ। অহমদাবাদে বিমান দুর্ঘটনায় তিনিই একমাত্র যাত্রী, যিনি প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন।