Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সুষমাকে পাকিস্তান পাঠালেও অলীক স্বপ্ন দেখতে নারাজ মোদী

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পাশে বসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রায় কানে কানে বলেছিলেন, আলোচনা করতে তো আমি সবসময়ই রাজি। ভারত-পাকিস্তান সমস্যা মেটাতে চাই বলেই তো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করার সময় আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। কথাও বলেছিলাম। কিন্তু এখন আমার কাছে এটা স্পষ্ট যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আপনার কথা শোনে না। সীমান্তে গোলাবর্ষণ, জঙ্গি-অনুপ্রবেশ ও নাশকতা, কিছুই বন্ধ হচ্ছে না।

নওয়াজ শরিফ এবং নরেন্দ্র মোদী।—ফাইল চিত্র।

নওয়াজ শরিফ এবং নরেন্দ্র মোদী।—ফাইল চিত্র।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৫ ১৯:৩৪
Share: Save:

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পাশে বসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রায় কানে কানে বলেছিলেন, আলোচনা করতে তো আমি সবসময়ই রাজি। ভারত-পাকিস্তান সমস্যা মেটাতে চাই বলেই তো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করার সময় আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। কথাও বলেছিলাম। কিন্তু এখন আমার কাছে এটা স্পষ্ট যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আপনার কথা শোনে না। সীমান্তে গোলাবর্ষণ, জঙ্গি-অনুপ্রবেশ ও নাশকতা, কিছুই বন্ধ হচ্ছে না।

নওয়াজ শরিফ প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, দেশে ফিরে গিয়েই আমি আপনার উদ্বেগ নিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে কথা বলব। কিন্তু আপনি যদি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার স্তরে একটা দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে রাজি হন, তা হলে আমার পক্ষেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।

প্যারিস থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে নওয়াজ শরিফের আলোচনা নিয়ে অজিত দোভাল, প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি নৃপেন মিশ্র, বিদেশসচিব জয়শঙ্করের সঙ্গে আলাদা আলাদা করে বৈঠক করেন। আপাতত পাকিস্তান নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর রণকৌশল হল, দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনা হবে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্তরে সন্ত্রাস ও সীমান্ত সমস্যা নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে আলোচনা চলতে থাকবে। চিন-মডেল অনুসরণ করে দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কাশ্মীর সমস্যার সমাধানসূত্র নিয়ে এখনই আলোচনা শুরু করে দেওয়া অথবা লাহৌর বাসযাত্রার মতো কর্মসূচি নিয়ে শান্তিপ্রক্রিয়ার একটা বড় যাত্রাপালা রচনা করতে এখনই রাজি নয় মোদী সরকার। বাজপেয়ীর লাহৌর বাসযাত্রার পর কারগিল যুদ্ধ হয়েছিল। তখনও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নওয়াজ শরিফ। সেনাপ্রধান ছিলেন পারভেজ মুশারফ। নওয়াজ শরিফও লাহৌর বাসযাত্রার জন্য যে রাজনৈতিক খেসারত দিয়েছিলেন, সেটা তার পক্ষে কখনওই ভোলা সম্ভব নয়। তিনিও তাই অনেক বেশি সতর্ক, সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রকাশ্যে সংঘাতে গিয়ে ভারতের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করা যে অসম্ভব, সেটা যেমন নরেন্দ্র মোদী বুঝতে পারছেন, বুঝছেন নওয়াজ শরিফও। তাই সুষমা স্বরাজের পাকিস্তান সফরে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হলেও এই সফরকে কেন্দ্র করে যাতে কোনও রাজনৈতিক সার্কাস না হয়, সে বিষয়েও পরামর্শ দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। সুষমা স্বরাজ এক প্রশ্নের জবাবে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী আমাকে যেতে বলেছেন। আমি যাচ্ছি। পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা মৈত্রী চাই। কিন্তু সেটা নিয়ে কোনও অসত্য স্বপ্নবিলাস কাঙ্খিত নয়। বরং বাস্তবতার জমিতে যাত্রা শুরু হওয়াই উচিত কাজ হবে।’’ গত কয়েক দিন ধরে প্রধানমন্ত্রী অজিত দোভালের মাধ্যমে সীমান্তে পাক-হানার কোনও ঘটনা ঘটছে কি না, সে দিকে নজর রেখেছিলেন। মোদী নওয়াজকে বলেছিলেন, কোনও ঘটনা ঘটলে সুষমাকে পাঠানো সম্ভব হবে না। সেই কারণেই এত দিন অপেক্ষা করে আগামিকালের সুষমা স্বরাজের সফরের বিষয়টি আজকে ঘোষণা করা হয়েছে।

পড়ুন: দু’দিনের সফরে মঙ্গলবার পাকিস্তান যাচ্ছেন সুষমা

বিদেশ মন্ত্রক সূত্র বলছে, প্রথমত সুষমা স্বরাজ পাকিস্তানে যাচ্ছেন কোনও দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে নয়। যাচ্ছেন ইস্তাম্বুল-পাকিস্তান সম্মেলনে যোগ দিতে। সেখানে গিয়ে তাঁর সঙ্গে নওয়াজ শরিফের আলাদা কথা হতে পারে। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান দু’দেশের কুশীলবেরাই জানেন যে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের চাবিকাঠি সুষমা স্বরাজ নয়, আসলে রয়েছে নরেন্দ্র মোদীর হাতে। এমনকী, অজিত দোভালের ভূমিকাও সুষমা স্বরাজের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

অজিত দোভালকে নিয়ে পাকিস্তানের সেনা এবং আইএসআই মহলে রয়েছে বড় আশঙ্কা। তিনি ভারতীয় গোয়েন্দা হিসেবে দীর্ঘ দিন পাকিস্তানে ছিলেন। গোয়েন্দা মহলে প্রচারিত, তিনি প্রায় জেমস বন্ডের মতো লাহৌরে, করাচিতে সক্রিয় ছিলেন। এমনকী, কিছু দিন আগেও যখন মনমোহন সিংহ প্রধানমন্ত্রী, তখন তাঁর ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ বিবেকানন্দ ফাউন্ডেশনের এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, পাকিস্তান যদি ভারতে এই ধরনের আক্রমণ করে, তা হলে আমরাও বালুচিস্তানে আক্রমণ হানতে পারি। দোভাল যখন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) হন, তখন এই বক্তব্যের ফুটেজ পাকিস্তানে ইউটিউবের মাধ্যমে তাঁকে প্রায় গব্বর সিংহের পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছিল। এখন এত দিন পর দোভালও তাঁর এই পুরনো ভাবমূর্তি সংশোধনের চেষ্টায় ব্রতী হয়েছেন।

মনমোহন সিংহ পাকিস্তানে যেতে চাইলেও প্রণব মুখোপাধ্যায় ও কংগ্রেস এই সফরের পক্ষে ছিলেন না। বিদেশমন্ত্রী থাকার সময় প্রণববাবু এক দিনের জন্য নমো নমো করে পাকিস্তান সফর করে দায় সেরেছিলেন। ভারত-পাক সম্পর্ক নিয়ে কোনও রাজনৈতিক নাটক তিনিও করতে চাননি। এখন সুষমা স্বরাজের সফরকালেও নরেন্দ্র মোদী কিন্তু সেই প্রণববাবুরই সাবেক রণকৌশল ধরে এগোচ্ছেন। যে কথা পাকিস্তানকে ভারত একদা বলেছিল যে, কাশ্মীর তোমাদের কাছে একশো মিটার দৌড়, আমাদের কাছে ম্যারাথন!

এখন সুষমা স্বরাজকে পাঠালেও পুরো বিষয়টি নিয়ে কোনও যাত্রাপালা রচনা করতে আগ্রহী নন নরেন্দ্র মোদী। সেই কারণেই ব্যাঙ্ককে এনএসএ বৈঠক গোপন না হলেও দোভাল ও নাসির জানজুয়ায় বৈঠকটি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে ঢক্কানিনাদে যায়নি। সুষমা স্বরাজের সফর নিয়েও একই কৌশল নেওয়া হচ্ছে। এই সামগ্রিক পরিস্থিতিতে একটু আশার আলো দেখছে পাকিস্তান। তারা যেমন খুশি, ঠিক তেমনই খুশি জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সঈদ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE