Advertisement
E-Paper

ভগবান চোর

মুম্বই মনতাজ-এ মিলন মুখোপাধ্যায়তস্করটি আবার বেশ নামকরা। ঘরে ঘরে এনার গপ্পোগাছা। থানায় নোটিশবোর্ডে যেমন চোর-ছ্যাঁচোরদের ছবি ঝুলিয়ে, তলায় ‘ওয়ান্টেড’ শব্দ লিখে দেওয়া হয়,—অনেকটা তেমনই ব্যাপার-স্যাপার এনাকে নিয়েও। ‘ওয়ান্টেড’ লেখা নেই, থানার নোটিশবোর্ডে ঝুলিয়ে রাখাও নয়, তবুও এত ছবি, ফটো, মূর্তি কোটি কোটি হিন্দুদের ঘরে বিরাজমান।

শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩

তস্করটি আবার বেশ নামকরা। ঘরে ঘরে এনার গপ্পোগাছা। থানায় নোটিশবোর্ডে যেমন চোর-ছ্যাঁচোরদের ছবি ঝুলিয়ে, তলায় ‘ওয়ান্টেড’ শব্দ লিখে দেওয়া হয়,—অনেকটা তেমনই ব্যাপার-স্যাপার এনাকে নিয়েও। ‘ওয়ান্টেড’ লেখা নেই, থানার নোটিশবোর্ডে ঝুলিয়ে রাখাও নয়, তবুও এত ছবি, ফটো, মূর্তি কোটি কোটি হিন্দুদের ঘরে বিরাজমান।
যদ্দুর জানি, ইতিহাস, প্রাক-ইতিহাস বা পুরাণের কোথাও আর কোনও ‘চোরের’ এত নামডাক ছিল না। আহা, শত হলেও ইনি একমাত্র ‘চোর’, যিনি আসলে ভগবান। ভাগবান চোর! যদিচ, শাস্ত্রমতে ইনি ভগবানের অবতার। আমি ব্যক্তিগত ভাবে কৃষ্ণকেই সেই ‘সর্ব শক্তিমান’ বলে মনে করি। আর সব দেবদেবীদের কেমন যেন উচ্চমার্গের কল্পনা মনে হয়। ছবি-ছবি, পুতুল-পুতুল। চতুর্দিকে বারোমাসের পুজো-আচ্চা—সত্যি বলতে কি—আচার-বিচার-ফুল-ধোয়ার আড়ম্বরের প্রাচুর্যে ভরপুর, তবুও, কেমন যেন গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। যদিও, এই সব পুতুল বা মূর্তি বন্দনা উপলক্ষে উৎসব-আনন্দ-হইচইতে আমি নিজেই মহা ফূর্তিতে অংশগ্রহণ করি। পুরুত মশাইয়ের ভুলভাল উচ্চারণ শুনে (সংস্কৃত স্কুলের ছাত্র হিসেবে) হাসি সামলাই। এই উপলক্ষে মুখস্থ আচার-আচরণ ইত্যাদিকে মনে হয়— যান্ত্রিক।
ঠিক তেমনই, কোনও ইট-পাথরের দেবালয়কে দেখে আমি কপালে হাত ছোঁয়াই না। আবার এও-ও সত্যি যে ভক্তদের ভক্তিকে ঠিক অশ্রদ্ধাও করতে পারি না। মনে হয়, ভয়ের থেকেও হোক বা যে কোনও কারণের থেকেই হোক এই ভক্তির প্রকাশের ভিতরেই হয়তো ঈশ্বর লুকিয়ে রয়েছেন। দুর্বোধ্য বা বিমূর্ত ঈশ্বর।
অথচ, কৃষ্ণের তাবত অস্তিত্বই যেন স্বাভাবিক, জীবন্ত। শৈশব থেকেই যার দুরন্ত দামালপনা সামাল দিতে মাতৃরূপী যশোদা সদাই তটস্থ। এই বুঝি হামা দিয়ে কার হেঁসেলে চড়াও হল। তাও আবার একা তো নয়, ‘বালখিল্য’দের দলবল নিয়ে। বৃন্দাবনের যত রাখাল-গোপশিশু আছে, তাদের পাণ্ডা যে গোপাল। কার ঘরের মধ্যিখানে শিকেয় ঝোলানো হাঁড়িতে দই-নাড়ু আছে, সে খবর দস্যি ছেলের ঠিক জুটে যায় কচি গুপ্তচর মারফত। বড়দের নজর এড়িয়ে একের পিঠে দুই, দুইয়ের কাঁধে তিন নম্বর চড়তে চড়তে ছোট্ট শরীর হলেও ঠিক শিকে অবধি পৌঁছে যায় কেষ্টাচোরের হাত। নাগালের হাঁড়ি নামিয়ে সদলবলে চেটেপুটে পরিষ্কার করে মুখ পুছে বেরিয়ে আসে সবাই।

শিশু-বালকের পর কৈশোর তো রীতিমতন গোকুলের কানু-সর্দার একেবারে, যাকে বলা যায়, পাড়ার মাস্তান। এই মহারাষ্ট্রে মাস্তানকে সম্মান দেখিয়ে বলা হয়— ‘দাদা’।

তা, এই দাদার জন্মদিন পালন করতে পাড়ায় পাড়ায় ছেলে-ছোকরারা জোট বেঁধে উপস্থিত হয়। গোপ-বালকও কানাইয়ের নকলে হাঁড়িকুঁড়ি থেকে দই-দুধ আহরণ করতে ‘নর-পিরামিড’ তৈরি করে। ওজনদার, শক্তিমানরা প্রথম ধাপ তৈরি করে। ক্রমে ক্রমে কম ওজনওয়ালারা ওপরে উঠতে থাকে। সাত-আটটি ধাপ তৈরি হয় একই প্রক্রিয়ায়। পাঁচতলা-ছ’তলার বাসিন্দারা টানটান দড়ি ঝুলিয়ে তার ঠিক মধ্যিখানে মাটির হাঁড়িটি বেঁদধে দেয়। যেন শিকেয় ঝুলছে। ভেতরে থাকে দই, দুধ এবং টাকা। টাকাপয়সার পরিমাণ যত বেশি হবে, দড়িতে বাঁধা হাঁড়িও ঝোলানো থাকবে তত উঁচুতে। সাত-আট তলা পর্যন্ত হয় দু’একটি জায়গায়। সবথেকে উঁচুতে ওঠে দলের ন্যুততম ওজনের রোগা ছেলেটি। কয়েক জায়গায় এই ছেলেকে কৃষ্ণের কায়দায় মাথায় ফেট্টি জড়িয়ে পালক বা পাতা গুঁজে দেওয়া হয়। তার পর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জন ছেলের দল হই-হই করতে করতে ‘দহি-হান্ডি’ উৎসব পালন করতে পাড়ায় পাড়ায় হানা দেয়। চতুর্দিকে বাদ্যি-বাজনার মধ্যে কোরাসে শোনা যায় হিন্দি সিনেমার অতি পুরাতন অথচ অত্যন্ত জনপ্রিয় গান—

‘‘গোবিন্দা আ’-লারে, আ’-লা-

জরা মাটকি সামহাল বৃজবালা।।’’

হে ব্রজবাসী গৃহিণীগণ! গোবিন্দ এসে পড়ল। হাঁড়িকুঁড়ি সামাল দাও সবাই।

এই দহি-হাণ্ডির পিরামিড তৈরি হতে থাকলে, এদের বিপত্তি বাঁধায় পাড়া-পড়শিরা। না না, আপত্তি নয়, বাধা সৃষ্টির চেষ্টা। ধরুন, ছ’তলা সমান উঁচুতে দড়ি ঝোলানো দু’ধারে। তার মাঝ বরাবর বাঁধা হয় এই টাকা-দই ভর্তি মূল্যবান মাটির হাঁড়িটি। দু’পাশে আট তলা, দশ তলা দালানের জানালা, বারান্দা বা ছাদ থেকে বাসিন্দারা বিচিত্র পন্থায় বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করে। ঘটি-বাটি-বালতি ভরে ভরে (কোথাও কোথাও আবার পিছল করার জন্যে জলের মধ্যে খানিকটা তেল-ফেলও ) ঢালতে থাকে উক্ত পিরামিড তৈরি হওয়ার পথে। খালি গায়ের চামড়ায় তেল-জল বা দই ইত্যাদি অনবরত ঢালতে থাকলে এই যুগের ‘গোবিন্দদের’ গা পিছল তো হবেই। একের গা বেয়ে আরেক জনের ওঠা বেশ দুরূহ হয়ে পড়ে। ওপর থেকে পিছলে পড়ে নবীন বালকদের হাড়গোড়ও দু’চার জনের ভাঙে বই কি। ফলে, এ বারের ‘জন্মাষ্টমী’র আগেই জনা কয়েক বে-রসিক নাগরিক আদালতে আর্জি পেশ করেছিল যাতে অপ্রাপ্তবয়স্কদের এই ‘দহি-হাণ্ডি’ উৎসবে অংশগ্রহণ করতে না দেওয়া হয়। হাইকোর্টের জজসাহেব এই আর্জি খারিজ করে দিয়ে বলেছেন, ‘‘উৎসবের সঙ্গে জড়িত এই ‘দহি-হাণ্ডি’তে যারা অংশ নেয়, তাদের প্রত্যেকেই ‘জিমনাস্টিক’ জাতীয় মহড়া দিয়ে তৈরি হয়। এটা যেমন উৎসব, তেমনই খেলাও বটে।’’

ভাগ্যিস, তা না হলে, ভাবুন, কতগুলো ষণ্ডাটাইপ ব্যায়ামবীর দামড়া মদ্দা ‘কৃষ্ণের’ সেই রমণীয়, মজার খেলা খেলতে নেমেছে। একটার ঘাড়ে আরেকটা চড়ে! উফ, শা-জোয়ান মদ্দ পাণ্ডাকে দেখেছি প্রথম, দ্বিতীয় এমনকী তৃতীয় ধাপে অংশ নিতে। সুতরাং শিণ্ড গোবিন্দ জিন্দাবাদ।

ও, হ্যাঁ, প্রসঙ্গত, গোপ বা রাখাল ছেলেদের টেক্কা দিতে হাল আমলে গোপিনীরাও ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এই রাজ্যে। আদি পুরাণ-টুরানের নিকুচি করে, আবহমান কাল ধরে বয়ে আসা গল্প-গাঁথার তুষ্টিনাশ করে আজকের রাধিকে সুন্দরীরাও জানান দিচ্ছেন— আমরাও ব্যাটাছেলেদের মতো পাল্লা দেব। ননী খাব, দই খাব, দুদু খাব!—

যাকগে, কৃষ্ণের কথায় শেষ করা যাক। এই শিশু-বালক-কিশোর কৃষ্ণকে আমার ব্যক্তিগত ভাবে পছন্দ। কারণ, বাকি দেবেদবীরা সারাক্ষণ স্বর্গে তথা নন্দনকাননে বাস করেন। তেনাদের বোঝাতে গেলেই আমরা চোখ কপালে তুলে আকাশে বা ওপরে তাকাই। অথচ, কেষ্ঠঠাকুরকে আমার একেবারে ঘরেয়া মনে হয়। অনেকটা পাশের বাড়ির ছেলেটাই যেন কৃষ্ণ। কালো কালো শিশুটি মেঝেয় হামাগুড়ি দিচ্ছে, সেই তো আসলে নাড়ুগোপাল। বালকৃষ্ণ। যদিও মাঝে মধ্যে কেমন যেন মনে ভাবি, মানুষের বিভিন্ন চেহারা বা রূপের মধ্যেই বহুরূপী কৃষ্ণ, বিষ্ণু বা দুষ্টু গণেশ বাবাজীবন লুকিয়ে আছেন।

সে দিন আন্ধেরি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একটি রোগাভোগা, কালো ছেলেকে দেখলুম। একেবারে নাঙ্গা-সাঙ্গা। আপন মনে হাঁটছে আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ডান হাত দিয়ে বাঁ হাত ধরে আছে। বাঁ হাতের কনুইয়ের কাছে বেশ কানিকটা ছড়ে গেছে। মনে হল, আমাদের কানাইয়েরও লাগতে পারে। সুতরাং, বিবেকানন্দের বাণী স্মরণ করি, ‘‘ বহুরূপে সম্মুখে তোমার—’’।

তা, ছবি আঁকতে বসলেও কেমন কেষ্টঠাকুর এসে উদয় হয় কাছেপিঠে। নতুন সিরিজের ছবি শুরু করেছি। বিষয়— পথে, ঘাটে, মাঠে বালক-কিশোর পেট চালাতেই হয়তো ঢোলক বাজাচ্ছে, করতাল বাজাচ্ছে। বাঁশি বাজাতে বাজাতে হেঁটে আসছে। প্রথম ছবিটি শেষ হতেই আবিষ্কার করলুম, না না করেও কৃষ্ণের ছবিই বোধহয় হয়ে গেল প্রাকারান্তরে। বেলা শেষে মাঠ পেরিয়ে হেঁটে আসছে ছেলেটি। পেছন পেছন গরুর পাল। হেঁটো ধুতির কোমরে গিঁট বাঁধা। মাথায় লাল গামছা পেচানো। আপন মনে আড়বাঁশি বাজাতে বাজাতে যে কিশোর আসছে, তার খালি গায়ের রং একেবারে চাপা। উজ্জ্বল নীলাভ।

বাঁশির ডাকে রাধা ও সখীরা থাকতে না পেরে ছবিটির চার পাশে কি লুকিয়ে আছে? হয়তো বা! মোহনবাঁশির সুর শরীর মন যে মাতাল করে দেয়। তখনই টের পাই গীতার কৃষ্ণ চাই না, কুরুক্ষেত্রের শ্রীকৃষ্ণে আমার দরকার নেই। চাই না মথুরার রাজা কৃষ্ণকে।

আমাকে সারাক্ষণ ঘিরে থাকুক পড়শির শিশুটি বা আন্ধেরির প্ল্যাটফর্মের ক্রন্দনরত নাবালকটি। নাড়ুগোপাল আমার, থেকো কাছেপিঠে। আমার, আপনার, সকলের—! জয় কৃষ্ণ!!

dahi handi dahi handi festival lord krishna god thief lord krishna thief
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy