E-Paper

প্রহরার বন্দিশালায় কণ্ঠরোধ তিব্বতিদের, বলছে রিপোর্ট

এত প্রহরার কী কারণ? সংলাপে দলাই লামার প্রসঙ্গ এবং প্রশংসা হচ্ছে কি না দেখা। চিন অধিকৃত তিব্বত থেকে পালিয়ে ভারতে বা অন্যত্র চলে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে কি না বোঝা।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৬:৪৮
তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের দফতর চত্বরের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাচ্ছে এই লেখা।

তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের দফতর চত্বরের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাচ্ছে এই লেখা। —নিজস্ব চিত্র।

নির্দিষ্ট সংখ্যার কয়েকটি গ্রাম নিয়ে এক-একটি ব্লক। প্রতিটি ব্লকে রয়েছে সিসি ক্যামেরা, ডিজিটাল এবং পুলিশি প্রহরা। বিশ্বের বাকি কোনও অ্যাপ-এ ‘প্রক্সি’ দিয়েও ঢোকার উপায় নেই। চালু শুধুমাত্র চিনা যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাপ নেটওয়ার্ক। সেখানে প্রত্যেক প্রোফাইলে আড়ি পাতার ব্যবস্থা। সাধারণ পোশাকে গুপ্তচর ছড়িয়ে রয়েছে প্রতিটি মহল্লায়। তারা রাতেও অতন্দ্র।

এত প্রহরার কী কারণ? সংলাপে দলাই লামার প্রসঙ্গ এবং প্রশংসা হচ্ছে কি না দেখা। চিন অধিকৃত তিব্বত থেকে পালিয়ে ভারতে বা অন্যত্র চলে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে কি না বোঝা। বিপ্লবের কোনও বারুদ সলতে হয়েও জ্বলছে কি না কোনও কুঁড়েঘরে আঁচ করা। যদি টের পাওয়া যায়? পরিণতি কড়া হুমকি থেকে জেলবন্দি হওয়া অথবা চিরতরে কর্পূরের মতো উবে যাওয়া— এর যে কোনওটাই হতে পারে বা হচ্ছে।

ধর্মশালায় দলাই লামার নির্বাসিত সরকারের দফতর-চত্বরের শেষ প্রান্তে ‘টিবেটিয়ান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’-র সদর দফতরে বসে। সেখানে ডিরেক্টর তেনজিং দাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘন (চিন অধিকৃত তিব্বতের) এবং আন্তঃসীমান্ত অবদমন সংক্রান্ত সর্বশেষ দু’টি রিপোর্ট হাতে নিয়ে যে কাহিনি শোনাচ্ছেন তা ওটিটি সিরিজ়-এর থ্রিলারের চেয়ে কম রোমহর্ষক নয়। তফাৎ— কল্পিত চিত্রনাট্য তো নয়, কঠিন বাস্তব। তাই বিষণ্ণতার ভাগটাই বেশি।

‘‘২০১২ বা ১৩ সালের আগে তা-ও কিছুটা নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা ছিল চিনের দখল করা তিব্বতে। আজকের মতো সর্বত্র সিসিটিভি ক্যামেরা তখনও লাগানো হয়নি। নেপাল ছিল সেফ প্যাসেজ। কিন্তু শি জিনপিংয়ের শাসনে নজরদারি ব্যবস্থা আরও নিষ্ঠুর হল। কাঠমান্ডুর সঙ্গে সে সময়ে নয়াদিল্লির সম্পর্কও খারাপ হওয়ায় তারা বেশি করে ঝুঁকল চিনের দিকে। ফলে নেপাল দিয়ে পালানোর উপায়ও রইল না তিব্বতিদের। এই ধর্মশালাতেও কিছু কম চিনে গোয়েন্দা রয়েছে না কি! আপনারা যে এসে আমাদের সঙ্গে কথা বলছেন, তা এত ক্ষণে বেজিংয়ে পৌঁছে গিয়েছে,’’ বলছেন দাওয়া।

সর্বত্র পোস্টার। তাতে লেখা, ‘চিন আমাদের ভূখণ্ড চুরি করেছে। এখন সন্তানদেরও চুরি করছে। লাখো শিশুকে জোর করে ঔপনিবেশিক বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হয়েছে।’ ঘটনা হল, দলে দলে কিশোরদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে চিনা কর্তৃপক্ষ শাসিত চিনা ভাষার বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হচ্ছে বাধ্যতামূলক। সেখানে তিব্বতি ভাষা, সংস্কৃতি, তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তিব্বতের মানবাধিকার আন্দোলনকারী রিয়ান তাসি বলছেন, ‘‘আমাদের বাবা মা-রা পালিয়ে চলে এসেছিলেন বলে তিব্বতি ভাষা-সংস্কৃতির চর্চা চালিয়ে যেতে পারছি। ওখানে আমাদের ৫৩টি উপজাতির চৈনিকীকরণ চলছে যুদ্ধকালীন ভাবে। বোর্ডিং স্কুল তার প্রথম ধাপ। অত্যন্ত অল্প বয়সে বাবা মা-র কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বোর্ডিংয়ে বাধ্যতামূলক ভাবে যাওয়ার ফলে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ছে শিশুরা।’’

তিব্বতের স্বাধীনতার জন্য কাজ করছেন তেনজিং পেলডন। নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময় থেকে। রীতিমতো লড়াই করে দীর্ঘ দিন রেডিয়োর মাধ্যমে, তাঁরা দলাই লামার বার্তা পাঠিয়েছেন চিন অধিকৃত তিব্বতে। ‘ভয়েস অব টিবেট’-এর ছোট্ট স্টুডিয়োতে বসে বলছেন, ‘‘হিজ় হোলিনেস নোবেল পাওয়ার পর বিশ্বের দৃষ্টি ফিরল আমাদের দিকে। কিছু আন্তর্জাতিক এনজিও সাহায্য করল। আমরা ভয়েস অব তিব্বত চালু করলাম। কিন্তু চিনের চাপে তুলে নিলে হত সম্প্রচার। বিভিন্ন বেতার তরঙ্গের আলাদা আলাদা স্লট নিয়ে রাখতাম। তিব্বতি সংস্কৃতি শিল্প অপেরা, বাজনার সম্প্রচারও করতাম চিন অধিকৃত ভূখণ্ডের মানুষদের জন্য। চিন সম্প্রচার জ্যাম করত, আমরা যেন চোর পুলিশ খেলতাম! এক তরঙ্গ থেকে অন্যে চলে যেতাম। ওপার থেকে অবরুদ্ধ মানুষরা বলতেন, দলাই লামার বাণী তাঁদের কাছে ওষুধের মতো কাজ করে।"

এখন অন লাইন চ্যানেল হয়ে গেলেও, সেই মানুষদের কাছে পৌঁছনো কঠিন হয়ে গিয়েছে উন্নত প্রযুক্তির চিনা দেওয়াল টপকে। ও-পারের মানুষও কথা বলা বা শোনা বন্ধ করেছেন ভয়ে। সম্মিলিত ভাবে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তিব্বতের স্বাধীনতার দাবিতে গায়ে আগুন দেওয়ার বিষয়টিকে সন্ত্রাসবাদ হিসাবে দাগিয়ে দিয়েছে বেজিং। আত্মহত্যাকামী ব্যক্তির পরিবারের উপরে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তৈরি করা হচ্ছে।

এই বজ্র আঁটুনির সঙ্গে নিরন্তর লড়াই করে চলেছে ধর্মশালার নির্বাসিত সরকার।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Dharamshala Tibet Dalai Lama Human Rights

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy