সংসার চলছে ঋণের টাকাতেই। আয় যে হারে বাড়ছে, তার চেয়ে বেশি হারে ঘাড়ে চাপছে দেনা। অধিকাংশ রাজ্যেরই এখন এই দশা! ১০ বছরে দেশের ২৮ রাজ্যের মিলিত ঋণের বোঝা বাড়তে বাড়তে ছুঁয়েছে ৫৯.৬ লক্ষ কোটি, যা দেশের মোট জিডিপির ২২.১৭ শতাংশ। রিপোর্ট দিয়ে জানালেন কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি তথা ক্যাগ)।
গত শুক্রবার এই রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন ক্যাগ কে সঞ্জয় মূর্তি। প্রথম বার এই ধরনের রিপোর্ট তৈরি করেছেন তাঁরা। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৩-’১৪ সালে দেশের ২৮ রাজ্যের সম্মিলিত ঋণের বোঝা ছিল ১৭.৫৭ লক্ষ কোটি (আসলে ১৭,৫৭,৬৪২ কোটি) টাকা। সেটাই বাড়তে বাড়তে ২০২২-’২৩ সালে দাঁড়িয়েছে ৫৯,৬০,৪২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৩.৩৯ গুণ বেড়েছে।
প্রকারান্তরে, রাজ্যগুলির মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় দেনার বোঝার হার ২০১৩-’১৪ সালে ছিল ১৬.৬৬ শতাংশ। ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষে তা বেড়ে হয়েছে ২২.৯৬ শতাংশ।
ক্যাগের রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজ্যের জিডিপির তুলনায় ঋণের বোঝার হার দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পঞ্জাবে (৪০.৩৫ শতাংশ)। দ্বিতীয় স্থানে নাগাল্যান্ড (৩৭.১৫ শতাংশ)। তৃতীয় পশ্চিমবঙ্গ (৩৩.৭০ শতাংশ)। সবচেয়ে কম ওড়িশা (৮.৪৫ শতাংশ), মহারাষ্ট্র (১৪.৬৪ শতাংশ) এবং গুজরাতের (১৬.৩৭ শতাংশ)। রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাজ্যের জিডিপির তুলনায় দেনার বোঝার হার ৩০ শতাংশের বেশি মোট আট রাজ্যের। ১৪ রাজ্যের ক্ষেত্রে এই হার ২০-৩০ শতাংশের মধ্যে। আর ছয় রাজ্যের ক্ষেত্রে তা ২০ শতাংশের কম।
আরও পড়ুন:
অর্থনীতিবিদদের একাংশের মত, অতিমারি হানার পর থেকেই রাজ্যগুলির ঋণের বহর বাড়তে শুরু করেছিল। কোভিড-লকডাউনের পরে সুরাহা দিতে সাধারণ মানুষের হাতে টাকা তুলে দিতে শুরু করেছিল বিভিন্ন রাজ্য। ভোটে তার সুফলও মিলতে শুরু করে। সেই ধারা এখনও বজায় রয়ে গিয়েছে। রাজ্যগুলির এই ‘দান খয়রাতি’ নীতিই ঋণের বোঝা বাড়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গে গত বিধানসভা ভোটের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প চালু করেছিল। তা নিয়ে এ রাজ্যে বিরোধীরা বিভিন্ন সময়ে সরব হলেও, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানার মতো বিজেপিশাসিত রাজ্যে একই রকম খয়রাতি প্রকল্প চালু করেছে। এক সময় খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একে ‘রেউড়ি’ বা তিল-গুড়ের মিষ্টি বিলি বলে নিশানা করতেন। এখন বিজেপি যে নিজেই খয়রাতি করে, তার সর্বশেষ উদাহরণ মহারাষ্ট্র। সেখানে বাংলার লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো ‘লাড়কী বহীণ’ প্রকল্প চালু করেছে।
কেন্দ্র বা রাজ্য, সব সরকারই বাজার থেকে ধার করে। অর্থনীতিবিদদের মত, যদি সেই ধারের টাকা সঠিক জায়গায় বা পরিকাঠামো তৈরিতে খরচ হয়, তাতে কোনও সমস্যা নেই। কারণ, পরিকাঠামো তৈরি বা সম্পদ তৈরিতে টাকা খরচ হলে অর্থনীতিতে গতি আসে। আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়তে থাকে। কিন্তু ধারের বেশির ভাগটাই যদি অনুদান প্রকল্প চলে যায়, তা হলে বিপদ! অঙ্কটা সহজই। যদি আয়বৃদ্ধির তুলনায় ঋণের বোঝাবৃদ্ধির হার লাগাতার বাড়তে থাকে, তা হলে রাজ্য আর ধার শোধ করার অবস্থাতেই থাকবে না। তখন বাধ্য হয়ে খাইখরচ কমাতে হবে। দেনা মাত্রাছাড়া হয়ে গেলে বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্পেও খরচ কাটছাঁট করতে হতে পারে।
এখন অবশ্য রাজ্যগুলির রাজকোষ ঘাটতিতে বাজেট শৃঙ্খলা আইন অনুযায়ী লাগাম পরানো রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিটি আর্থিক বছরের একদম শুরুতে প্রত্যেকটি রাজ্যের জন্য ঋণের ঊর্ধ্বসীমা ঠিক করে দেয়। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের বক্তব্য, কিছু রাজ্য বাজেটের বাইরে রাজ্যের আওতাভুক্ত সংস্থা বা বিশেষ সংস্থা তৈরি করে তার পর সেটির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে থাকে। যদিও রাজ্য সরকারকেই তার সুদ গুনতে হয়। ২০২২-এর মার্চ মাসে রাজ্যগুলিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, এই সংস্থারগুলির ঋণও রাজ্য সরকারের ঋণ হিসেবেই ধরা হবে।