মার্কিন নির্দেশ উপেক্ষা করে রাশিয়ার থেকে তেল কেনা জারি রাখায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রোষের মুখে পড়েছে ভারত। চলতি মাসের শুরুতেই ট্রাম্প দু’দফায় মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ভারতের উপর। তার পর থেকে টানাপড়েন চলছে দু’দেশের মধ্যে। আলোচনার পথ খোলা থাকলেও, তা খুব একটা ইতিবাচক হয়নি। ফলে তাদের শুল্ক-সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছে আমেরিকা। মঙ্গলবারই হোয়াইট হাউসের তরফে বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানানো হয়, বুধবার সকাল (ভারতীয় সময় সাড়ে ৯টা) থেকে আমেরিকায় রফতানি করা ভারতীয় পণ্যে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক নেওয়া হবে। তার ফলে সমস্যায় পড়েছেন আমেরিকায় ভারতীয় পণ্য রফতানিকারকেরা।
ট্রাম্পের শুল্ক-তিরে কতটা বিদ্ধ হবেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে এখনই মার্কিন শুল্ক থেকে কোনও অব্যাহতি মিলবে না, তা আঁচ করতে পারছে নয়াদিল্লি। এমনই দাবি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাণিজ্য মন্ত্রকের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিকের। সংবাদ সংস্থা রয়টার্স ওই আধিকারিককে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, শুল্কের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত রফতানিকারকেরা আর্থিক সহয়তা পাবেন। শুধু তা-ই নয়, বিকল্প পথ খোঁজার বিষয়ে উৎসাহ দেওয়া হবে সরকারের তরফে। সেই তালিকায় থাকতে পারে চিন, দক্ষিণ আমেরিকা কিংবা পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলি।
ট্রাম্পের শুল্ক-বোমা আঘাত হেনেছে ভারতের শেয়ার বাজারে। সেনসেক্স এবং নিফটি ১ শতাংশ করে কমেছে, যা গত তিন মাসের মধ্যে দৈনিক পতনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ভারত ও আমেরিকার মধ্যে বার বার আলোচনার জন্য অনেকেই রাজনৈতিক ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন। পাশাপাশি, এই অচলাবস্থার জেরে ভারত এবং আমেরিকার মধ্যে সামগ্রিক কৌশলগত সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কারণ, নয়াদিল্লি এবং ওয়াশিংটন, ভাল ভাবেই জানে তাদের এই সংঘাতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে চিন! বেজিংও পরিস্থিতির সুযোগ নিতে দেরি করেনি। প্রথম থেকেই ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের বিষয়ে নিন্দা করে ভারতের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছে। ভারত-চিন সম্পর্ক জোরদার করার কথা বলেছে বেজিং। তবে চিন নিয়ে আশঙ্কার কথা বুঝে ভারত এবং আমেরিকা নিজেদের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে। মঙ্গলবার দুই দেশের বিদেশ মন্ত্রকের তরফে প্রায় একই ভাষায় জানানো হয়, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিস্তৃতি এবং গভীরতা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। উল্লেখ্য, সোমবার আমেরিকার বিদেশ এবং প্রতিরক্ষা দফতরের আধিকারিকদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করেন ভারতের বিদেশ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের আধিকারিকেরা। সেই বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে, তা নিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। সোমবারের বৈঠকে শুধু বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে নয়, ভারত এবং আমেরিকার মধ্যে জ্বালানি নিরাপত্তা, গুরুত্বপূর্ণ খনিজের সন্ধান, মাদক ও সন্ত্রাসবাদ বিরোধী দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়।
তবে এখনও পর্যন্ত রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করার ব্যাপারে ভারত কোনও নির্দেশিকা জারি করেনি। তবে বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, নয়াদিল্লি যে রাশিয়া থেকে তেল কেনা অব্যাহত রাখবে, তা স্পষ্ট। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আমেরিকাও। এ প্রসঙ্গে গত সপ্তাহে প্রশাসনের অর্থসচিব স্কট বেসেন্ট দাবি করেছিলেন, ‘‘ভারত সব সময় লাভ খোঁজে। রাশিয়া থেকে তেল কিনে ফের বিক্রি করছে তারা। সস্তায় রাশিয়া থেকে তেল কিনে, তা আবার বিক্রি করাকে ভারতের স্বেচ্ছাচারিতা বলব। এটা কখনওই গ্রহণযোগ্য নয়।’’ যদিও আমেরিকার এই অভিযোগ নিয়ে এখনও কোনও মন্তব্য করেনি ভারত সরকার। আমেরিকার অভিযোগ, তেল বিক্রির টাকা ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহার করছে রাশিয়া। অর্থাৎ, ভারত পরোক্ষ ভাবে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পাশে দাঁড়াচ্ছে। সেই কারণেই ভারতের উপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, তা স্পষ্টই জানিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
আরও পড়ুন:
বুধবার থেকে কার্যকর হওয়া নতুন হারে শুল্ক প্রভাবিত করতে পারে ভারতীয় ব্যবসাকে, এমনই আশঙ্কা। রফতানিকারক গোষ্ঠীর অনুমান, আমেরিকায় ৮,৭০০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্যের রফতানির প্রায় ৫৫ শতাংশের উপর প্রভাব পড়তে পারে। ‘ইঞ্জিনিয়ারিং এক্সপোর্টস প্রমোশন কাউন্সিল’-এর সভাপতি পঙ্কজ চড্ডা বলেন, ‘‘মার্কিন গ্রাহকেরা ইতিমধ্যেই নতুন করে ভারতীয় পণ্যের বরাত দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।’’ তাঁর আশঙ্কা, সেপ্টেম্বর থেকে রফতানি ২০-৩০ শতাংশ কমতে পারে। সরকারের থেকে আর্থিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পরেও চিন্তায় পঙ্কজের মতো রফতানিকারক ব্যবসায় যুক্ত ব্যক্তিরা। বিকল্প পথ কতটা সুগম হবে, আদৌ লাভবান হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন ভারতীয় রফতানিকারকেরা।
ভারত সরকার ইতিমধ্যেই আমেরিকার শুল্ক আঘাতের মোকাবিলার পথ খোঁজা শুরু করেছে। রয়টার্স বাণিজ্য মন্ত্রকের এক কর্তাকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, ভারত প্রায় ৫০টি দেশকে চিহ্নিত করেছে, যে সব জায়গায় তারা রফতানি বৃদ্ধি করতে পারে। বিশেষ করে বস্ত্র, প্রসেস্ড ফুড, চামড়া, সামুদ্রিক পণ্য রফতানির বাজার আমেরিকা থেকে অন্যত্র সরানোর ভাবনাচিন্তা চলছে।
বেসরকারি ক্ষেত্রের বিশ্লেষকেরা সতর্ক করেছেন, যদি ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্ক অব্যাহত থাকে তবে তা ভারতের অর্থনীতি এবং কর্পোরেট মুনাফার উপর প্রভাব ফেলতে পারে। এর ফলে এশিয়া তীব্র আয়-সঙ্কট দেখা দেওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞেরা। গত সপ্তাহে ক্যাপিটাল ইকনমিক্স জানিয়েছিল, মার্কিন শুল্ক ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ০.৮ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রথম যে দেশগুলি সম্ভাব্য বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছিল, ভারত তাদের মধ্যে অন্যতম। তবে আপাতত এই চুক্তির ভবিষ্যৎ খুব একটা উজ্জ্বল বলে মনে করছেন না কেউই। কারণ ট্রাম্প নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন, শুল্ক-জটিলতা না-কাটলে বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে কথা এগোবে না। কেন্দ্রের একটি সূত্রের খবর, আমেরিকা চায় ভারত কৃষিপণ্য, দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যের বাজার তাদের জন্য পুরোপুরি খুলে দিক। কিন্তু তাতে নারাজ নয়াদিল্লি। তাড়াহুড়োয় কেবল আমেরিকার সুবিধা হয়, এমন একপাক্ষিক চুক্তি করতে নারাজ ভারত। তবে বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে আশাবাদী ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্পষ্ট জানিয়েছেন, তাঁর সরকার কখনওই ভারতীয় কৃষকদের স্বার্থের সঙ্গে আপস করবে না। আমেরিকার সঙ্গে ‘দূরত্বে’র মধ্যেই চিনের সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’ স্থাপনের নয়া পথ খুলতে চাইছে ভারত। মোদীর আসন্ন চিন সফর তারই অংশ বলে মনে করছেন অনেকে।