উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। — ফাইল চিত্র।
লোকসভা ভোটের আগে জ্ঞানবাপী মসজিদ বিতর্কে ‘ঢুকে পড়ল’ বিজেপি। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সোমবার সংবাদ সংস্থা এএনআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাফ জানিয়ে দিলেন, প্রায় সাড়ে চারশো বছরের পুরনো বারণসীর ওই মসজিদ আদতে হিন্দু মন্দির! সেই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘‘ওটিকে (জ্ঞানবাপী) মসজিদ বলা হলে সংঘাত বাধবেই।’’
সাক্ষাৎকারে যোগী আরও বলেন বলেন, ‘‘ঈশ্বর যাঁদের দৃষ্টিশক্তি দিয়েছেন, তাঁরা ওখানে গিয়ে দেখুন। মসজিদের ভিতরে ত্রিশূল কেন? আমরা তো রাখিনি। জ্যোতির্লিঙ্গ রয়েছে। দেবমূর্তি রয়েছে। দেওয়াল (জ্ঞানবাপীর) চিৎকার করে কী বলছে?’’ এর পরেই তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, ‘‘আমর মনে হয়, মুসলিম সমাজের তরফেই প্রস্তাব আসা উচিত। বলা উচিত, যে ঐতিহাসিক ভুল হয়েছে, তার সমাধান হোক।’’ বিরোধীদের অভিযোগ, যোগীর মন্তব্যে স্পষ্ট বার্তা—অতীতের অযোধ্যার বাবরি মসজি-রামমন্দিরের বিতর্কের মতোই আগামী দিনে বারাণসী জ্ঞানবাপী মসজিদ-কাশী বিশ্বনাথ মন্দির নিয়েও ‘পরিকল্পনা’ মাফিক এগোতে চাইছে বিজেপি।
হিন্দু পক্ষের আবেদন অগ্রাহ্য করে জ্ঞানবাপী মসজিদে নমাজের অধিকার বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট। ‘অঞ্জুমান ইন্তেজামিয়া (জ্ঞানবাপী) মসজিদ কমিটি’-র আবেদন মেনে শীর্ষ আদালত এবং ইলাহাবাদ হাই কোর্ট জ্ঞানবাপী মসজিদে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া বা এএসআই)-কে সমীক্ষার কাজ চালানোর উপর স্থগিতাদেশ বহাল রেখেছে। এই পরিস্থিতিতে যোগীর মন্তব্যে নতুন করে উত্তেজনা এবং মেরুকরণ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখছেন রাজনৈতির বিশ্লেষক এবং বিরোধীদের একাংশ। কংগ্রেসের রাজ্যসভা সাংসদ প্রমোদ তিওয়ারি সোমবার বলেন, ‘‘লোকসভা ভোটের আগে পরিকল্পিত ভাবে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা চাই বিচারাধীন এই বিষয় নিয়ে প্ররোচনামূলক মন্তব্যের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করুক আদালত।’’
প্রসঙ্গত, জ্ঞানবাপী নিয়ে এই প্রথম বিজেপির কোনও প্রথম সারির নেতা মুখ খুললেন। ঘটনাচক্রে, লোকসভা ভোটের আট-ন’মাস আগেই। যদিও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ‘সরসঙ্ঘচালক’ মোহন ভাগবত গত বছর জ্ঞানবাপী বিতর্ক নিয়ে ‘অন্য’ কথা জানিয়েছিলেন। কার্যত জ্ঞানবাপী চত্বরে পুজোর আবেদনকারী হিন্দুপক্ষের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমাদের কিছু জায়গা (ধর্মীয় স্থান) নিয়ে বিশেষ ভক্তি থাকতে পারে। কিন্তু তা বলে রোজ নতুন নতুন বিষয় কেন জাগিয়ে তোলা হবে? আমাদের আদৌ বিতর্ক বাড়ানো উচিত নয়। জ্ঞানবাপী নিয়ে আমাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকতেই পারে। কিন্তু তা বলে প্রত্যেক মসজিদেই কেন শিবলিঙ্গ খোঁজা হবে?’’
হিন্দুত্ববাদীদের দাবি, দ্বাদশ শতকে ভারত আক্রমণকারী মহম্মদ ঘোরির সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবকের (পরবর্তীকালে দিল্লির সুলতান) হাতেই প্রথম আক্রান্ত হয়েছিল কাশীর আদি বিশ্বনাথ মন্দির। কয়েক বছর পর কাশীর বাসিন্দারা সংস্কার করেন মন্দিরটি। এর পর নাকি সপ্তদশ শতকে (১৬৬৪ থেকে ’৬৯-এর মধ্যে) মুঘল সম্রাট অওরঙ্গজেব কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। আর সেই জমির একাংশে গড়ে তুলেছিলেন বর্তমান জ্ঞানবাপী মসজিদ।
জ্ঞানবাপী মসজিদ লাগোয়া জমিতে এখন যে বিশ্বনাথ মন্দির রয়েছে তা অষ্টাদশ শতকের। মধ্যপ্রদেশের ইনদওরের হোলকার রাজবংশের রানি অহল্যাবাই ওই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ব্রিটিশ জমানায় জ্ঞানবাপীর জমিতে মন্দির গড়ার দাবি উঠেছিল। ১৯৩৬ সালে বারাণসীর আদালতে সেই আবেদন জানানো হলেও জ্ঞানবাপীতে নমাজের অধিকার বজায় থাকে রায়ে। ১৯৪২-এ ইলাহাবাদ হাই কোর্টও সেই রায় বহাল রেখেছিল।
২০২১-এর অগস্টে পাঁচ হিন্দু মহিলা জ্ঞানবাপীর ‘মা শৃঙ্গার গৌরী’ (ওজুখানা ও তহখানা নামে পরিচিত) এবং মসজিদের অন্দরের পশ্চিমের দেওয়ালে দেবদেবীর মূর্তির অস্তিত্বের দাবি করে তা পূজার্চনার অনুমতি চেয়েছিলেন বারাণসী দায়রা আদালতে। এর পর দায়রা আদালত নিযুক্ত কমিটি মসজিদের অন্দরে সমীক্ষা এবং ভিডিয়োগ্রাফির নির্দেশ দিয়ে পর্যবেক্ষক দল গঠন করে। এর পর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মামলা যায় বারাণসী জেলা আদালতে। গত ২৩ জুন জেলা আদালতের বিচারক ‘সিল’ করা ওজুখানা এলাকার বাইরে এএসআই সমীক্ষার নির্দেশ দিলেও শীর্ষ আদালত তাতে স্থগিতাদেশ দিয়ে মামলাটি ইলাহাবাদ হাই কোর্টে পাঠায়। এর পর ইলাহাবাদ হাই কোর্ট দু’পক্ষের মতামত শুনে স্থগিতাদেশের মেয়াদ ৩ অগস্ট পর্যন্ত বাড়িয়েছে। সেই শুনানির আগেই সামনে এল যোগীর বিতর্কিত মন্তব্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy