ইতিহাসের সরণি থেকে কার্যত আড়াল করার চেষ্টা হল প্রাক্তনকে! আর বর্তমানের ভবিষ্যৎ নিয়ে রয়ে গেল জল্পনা।
দেশের একমাত্র বাম-শাসিত রাজ্য কেরলে আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচন। দক্ষিণী রাজ্যের চিরাচরিত প্রথা ভেঙে পরপর দু’বার বাম সরকার ক্ষমতায় এসেছিল পিনারাই বিজয়নের নেতৃত্বে। তাঁর বয়স এখন আশি ছুঁইছুঁই। হ্যাটট্রিকের লক্ষ্যে নির্বাচনী লড়াই কি সেই বিজয়নকে নেতৃত্বে রেখেই হবে? নাকি তাঁকে সামনে রেখেও সরকারের কথা ভেবে সেই সঙ্গে নতুন নেতৃত্বের দল গড়ে দেওয়া হবে? এই প্রশ্ন সঙ্গে নিয়েই শুরু হল সিপিএমের ২৪তম রাজ্য সম্মেলন।
কোল্লম শহরের সি কেশবন মেমোরিয়াল টাউন হলে বৃহস্পতিবার শুরু হওয়া সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনের প্রথম দিনেই ‘নতুন কেরলের জন্য নতুন পথ’ শীর্ষক প্রতিবেদন পেশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন। গত ৮ বছরে কেরলের সরকার কী ভাবে উন্নয়নের রাস্তায় এগিয়েছে, কোথায় বাধা এসেছে এবং ভবিষ্যতের পরিকল্পনাই বা কী— সে সবেরই উল্লেখ রয়েছে ওই রিপোর্টে। সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তৃতায় পলিটব্যুরো কো-অর্ডিনেটর প্রকাশ কারাটও বলেছেন, বিজয়নের নেতৃত্বে কেরলের বাম সরকার নব্য উদারনীতির যুগে দাঁড়িয়ে বিকল্প উন্নয়নের পথ দেখাচ্ছে। ‘কর্পোরেট হিন্দুত্বের নীতি’র বিরুদ্ধেও জোরদার লড়াই চলছে। দলের রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিংহভাগের মনোভাব থেকে ইঙ্গিত মিলছে, বিজয়নকে সামনে রেখেই আগামী বিধানসভা নির্বাচনে যেতে চায় সিপিএম। মুখ্যমন্ত্রীকে ‘অব্যাহতি’ দিলে ‘নেতিবাচক’ বার্তা গিয়ে পরের বছরের কঠিন লড়াই আরও কঠিন হয়ে যাবে কি না, সেই প্রশ্ন ভাবাচ্ছে সিপিএমকে।
যে কোল্লম শহরে এ বারের সম্মেলন, সেখানই ৩০ বছর আগের সম্মেলনে দলের কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ‘নীতিগত প্রশ্ন’ তুলেছিলেন ভি এস অচ্যুতানন্দন। তখন থেকেই তাঁর ‘বিদ্রোহী’ ভাবমূর্তির সূত্রপাত। শতায়ু ভি এস বেশ কিছু দিন ধরেই গৃহবন্দি। এ বারের সম্মেলন উপলক্ষে কোল্লমের রাস্তা সাজানো হয়েছে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ, ই কে নায়নার, দলের প্রয়াত প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক কোডিয়ার বালকৃষ্ণনের ছবিতে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হয়েও সেই তালিকায় নেই ভি এস! অথচ কোল্লমের নেতা, সিপিএমের বর্তমান পলিটব্যুরো সদস্য এম এ বেবি (দলের একাংশের মতে, পরবর্তী সাধারণ সম্পাদকের দৌড়ে আছেন যিনি) আছেন ছবির সারিতে। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, ‘‘নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর মত না-মিললেও ভি এস-কে তো মুছে ফেলা যায় না! সীতারাম ইয়েচুরি থাকলে এই কাণ্ডটা হয়তো হত না!’’ ইয়েচুরিহীন রাজ্য সম্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় দফতর থেকে কারাট-সহ ৭ জন পলিটব্যুরো সদস্য উপস্থিত আছেন।
সিপিএম সূত্রের খবর, সম্মেলন শুরুর আগে বুধবার রাতে বসেছিল দলের রাজ্য কমিটির বৈঠক। বয়সজনিত ও অন্যান্য কারণে কারা পরের কমিটি থেকে বাদ যাবেন, তার প্রাথমিক তালিকা ঠিক হয়েছে সেখানে। তবে রাজ্য কমিটির প্রস্তাব, বয়স-নীতিতে আটকে গেলেও ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী বিজয়নকে রাজ্য কমিটিতে রাখা হোক। যে ভাবে ত্রিপুরা রাজ্য সম্মেলনে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের জন্য ‘ব্যতিক্রম’ করা হয়েছে। দলীয় সূত্রের ইঙ্গিত, পরের মাসে পার্টি কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটিতেও বিজয়নের জন্য চাপ বাড়াবে কেরল সিপিএম।
সম্মেলনের সূচনা-পর্বে রাজ্যে সরকার ও দলের কাজের প্রশংসার পাশাপাশি ফ্যাসিবাদ-প্রসঙ্গে কংগ্রেসকে এক হাত নিয়েছেন কারাট। পার্টি কংগ্রেসের দলিলে আরএসএস-বিজেপির ‘নব্য ফ্যাসিবাদী’ বৈশিষ্ট্যের কথা বলায় কংগ্রেস নেতারা মন্তব্য করেছিলেন, বিজেপি-বিরোধিতায় শিথিলতা দেখাচ্ছে সিপিএম। তাঁদের ২০১৮ সালের পার্টি কংগ্রেসের নথি উদ্ধৃত করে কারাট সম্মেলনে ব্যাখ্যা করেছেন, বিজেপি জমানাকে নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে তাঁরা কী বলে আসছেন। সেই সূত্রেই তাঁর মন্তব্য, ‘কেরলের কংগ্রেস নেতাদের কথা শুনে মজা পাচ্ছি। ওঁরা কি আমাদের রিপোর্ট পড়ে দেখেছেন? বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা কংগ্রেসের শংসাপত্রের ভরসায় বসে নেই!’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)