হাত দেখিয়ে গাড়ি থামালেন জংলা পোশাকের সিআরপি জওয়ান। বললেন, ‘‘আর এগোবেন না!’’
দন্তেওয়াড়া ও নারায়ণপুরের মাঝে বিস্তীর্ণ পাহাড়ি জঙ্গল এলাকা। অবুঝমাঢ়। যার অনেকাংশেই এখনও রয়ে গিয়েছে লালবাহিনীর প্রভাব। নারায়ণপুরের দিক থেকে সেই জঙ্গলের পথে ঢোকার মুখে প্রথমেই থামালেন সিআরপি জওয়ানটি। অবশ্য পথের বিপদ তার আগেই জেনে গিয়েছিলাম, যখন সকালে নারায়ণপুর কোতোয়ালির পুলিশকর্মীরা সতর্ক করেছিলেন— কুঁকড়াঝোর থানা এলাকার পরে গাড়ি নিয়ে যাওয়াটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
কিন্তু যেতে তো হবেই। পকেট থেকে বার হল সরকারি পরিচয়পত্র। যা দেখে কিছুটা ইতস্তত করছিলেন জওয়ানটি। তবে শেষে পথ ছেড়ে দিলেন। শোনালেন সাবধানবাণীও। চারপাশে জঙ্গল, উঁচু-নিচু রাস্তা কেটে তৈরি হচ্ছে মহারাষ্ট্রগামী জাতীয় সড়ক। কে বলবে, এই অবুঝমাঢ়ের বড় অংশ আজও সরকারি জরিপের বাইরে! যদিও কুঁকড়াঝোর থেকে সরকারি ভাবে জমি জরিপের কাজ শুরু হয়েছে সদ্য কিছু দিন। এখানে পুলিশের দিন শুরু হয় ‘আরওপি’ (রুট ওপেনিং পার্টি) দিয়ে। তার পর বাইকে চেপেই এলাকায় ঢোকেন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর সদস্যরা।
যে এলাকার বৃত্তে ঘুরছি, গত ২১ মে সেখানেই জঙ্গলের গভীরে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন শীর্ষ মাওবাদী নেতা বাসবরাজু ও তাঁর ২৬ জন সঙ্গী।
তাঁদের মৃত্যুর পরেও কি পথ পুরোপুরি বিপন্মুক্ত? সরকারি গোয়েন্দারা বলছেন, না। এখনও কোথায় পা পড়লে মাটির নীচে পোঁতা আইইডি, প্রেশার মাইন ফেটে যাবে, তা আন্দাজ করা কঠিন। প্রায় রোজই জঙ্গলপথে উদ্ধার হচ্ছে বিস্ফোরক।
ওই বিপদ পথ উজিয়েই এর পরে পৌঁছনো আকাবেড়া, কস্তুরমেট্যা, মুন্দি, কুতুলের মতো গ্রামগুলিতে। যে গ্রামগুলি কয়েক মাস আগেও ছিল কার্যত অগম্য। এখন সেখানে পুলিশ ও বাহিনীর শিবির। এবং গ্রামওআপাত শান্ত।
নির্জন রাস্তার ধারে এক ছোট খাবার দোকানে ছোলা ভাজা দিয়ে লাল চা খাচ্ছিলেন বৃদ্ধ শম্ভু পোটাই। বললেন, ‘‘ওই ছেলেগুলো আদর্শের জন্য লড়ছে। ওরা কি এত সহজে ছেড়ে দেবে!’’ পাশেই বসেছিলেন আর এক প্রৌঢ়। তাঁর সুর একটু অন্য রকম। বললেন, ‘‘এই ছেলেগুলির আদর্শে আমরা কি কিছু পেয়েছি?না পেয়েছি ঘরবাড়ি। নারুজি-রোজগার।’’
ঘন পাহাড়-জঙ্গল আর মাঝে মাঝে কয়েক ঘর জনবসতি। সিপিআই (মাওবাদী) সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বাসবরাজুর মৃত্যু নিয়ে আড়ালে চলছে জল্পনা। মুন্দি গ্রামে ছাগলকে কচি পাতা খাওয়াচ্ছিলেন এক যুবক। মুখ নামিয়ে বললেন, ‘‘বাসবরাজু বেশ কিছু দিন ধরেই সরকারের সঙ্গে আলোচনা চাইছিলেন। সেই কারণেই এত সহজে পুলিশ তার হদিস পেয়েছিল বলে মনে হচ্ছে।তার পর…।’’
চুপ করে যান তিনি। একটু এ দিক-ও দিক তাকিয়ে, ফিসফিস করে বলেন, ‘‘বেশি কথা বললে আমাদের বিপদ। দু’দিক থেকেই।’’
নারায়ণপুর জেলার ডিএসপি (বালক অপরাধ অন্বেষণ) অমৃতা প্যাইক্রা বলছিলেন, ‘‘মাওবাদীরা এখন কোণঠাসা। নিয়মিত তল্লাশি অভিযান, এলাকার মানুষের পাশেআমরা থাকায় নকশাল প্রভাব ৭০ শতাংশ কমেছে। গ্রামে গ্রামে রাস্তা তৈরি হচ্ছে। রেশন নিয়মিত পৌঁছচ্ছে সর্বত্র। সরকারি আধিকারিকরা গ্রামে যাচ্ছেন। আর কিছু দিনের মধ্যেই নকশালবাদ আমরা উপড়ে ফেলব।’’
রাস্তা যে তৈরি হচ্ছে, তা চোখের সামনেই দেখা গেল। কয়েক বছর আগেও নারায়ণপুর থেকে বেলগাম, কোচওয়াহি হয়ে কুতুল যাওয়ার রাস্তা ছিল পুলিশের অগম্য। এই সব এলাকা ছিল মাওবাদীদের মুক্তাঞ্চল। গোন্ডি, হলবি, মৌর্যা, গান্ডা সম্প্রদায়ের জনজাতি-মূলবাসীদের জীবিকা জঙ্গল নির্ভর। জঙ্গলের তেঁতুল, কন্দ, প্রাকৃতিক মাশরুম, মহুল ফুল সংগ্রহ করেন তাঁরা। অসেচ জমিতে বৃষ্টি নির্ভর ধান, ভুট্টা চাষ হয়। রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্যোগে ওই এলাকায় স্বাস্থ্যপরিষেবা ও শিক্ষাদানের কাজ চলছে কয়েক দশক আগে থেকে। এক-দু’টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও পরিষেবা দেওয়ার কাজ করেছে।
তেমনই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রাক্তন কর্মকর্তা, বর্তমানে নারায়ণপুর আদালতের আইনজীবী রোশন সাহু বলছেন, ‘‘পাহাড়ি এলাকার আদিবাসী মূলবাসীরা দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে শোষিত, বঞ্চিত ছিলেন। নকশাল দমনে এমন কিছু মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, নিখরচায় যাঁদের মামলা লড়তে গিয়ে দেখেছি, তাঁরা আদৌ নকশাল কার্যকলাপে যুক্ত নন। তাঁরা পরিস্থিতির শিকার।’’ রোশন মনে করাচ্ছেন, কোন্ডাগাঁও থেকে নারায়ণপুর হয়ে মাওবাদী প্রভাবিত এলাকা দিয়ে মহারাষ্ট্রগামী জাতীয় সড়ক তৈরি হচ্ছে। এলাকায় নানা খনিজ রয়েছে। ফলে আগামী দিনে পরিস্থিতি বদলাতে চলেছে।
তাতে অবশ্য মূলবাসীদের কতটা উপকার হবে, সেটা সময়ই বলবে।
বাসবরাজু এবং আরও একাধিক নেতা-কর্মীর মৃত্যুতে মাওবাদীরা কি দমে গিয়েছে? অন্তত মাওবাদীদের দণ্ডকারণ্য স্পেশাল জোনাল কমিটির মুখপাত্র বিকল্পের কথায় তা মনে হচ্ছে না। এক প্রেস বিবৃতিতে বিকল্প দাবি করেছেন, বাসবরাজুকে হিন্দুত্ববাদী সরকার ষড়যন্ত্র করে মেরেছে। এই হত্যাকাণ্ডের জবাব দেওয়ার ডাক দিয়েছেন তিনি। তাই অবুঝমাঢ়ের কোথাও পা রাখতে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী যথেষ্ট সতর্ক রয়েছে। সিআরপি এবং ভারত-তিব্বত সীমান্ত পুলিশ (আইটিবিপি)-এর শিবির হচ্ছে একের পর এক গ্রামে। ছত্তীসগঢ় পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, কেবলমাত্র অবুঝমাঢ়ের নারায়ণপুর জেলার অংশে মহারাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী এলাকাতেও বাহিনীর শিবির হয়েছে।
এই সতর্কতা একচুলও কমালে চলবে না, বলছেন পুলিশ-প্রশাসনের লোকজনই। তাঁরা সরকারি তথ্য তুলে জানাচ্ছেন, বস্তার ডিভিশনের সাতটি জেলার মধ্যে শুধু বস্তার জেলাটিকে গত মার্চে মাওবাদী কার্যকলাপ মুক্ত হিসেবে ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। দান্তেওয়াড়া ও নারায়ণপুরের পাশে কিন্তু এখনও লেখা: অতি নকশাল প্রভাবিত জেলা। অবুঝমাঢ়ের মাটিতে এখনও সেই আগুনের তাপ আছে। বাইরে থেকে কিছুটা শান্ত দেখালেও, সে এলাকার অন্তরে বয়ে চলেছে দ্বন্দ্বেরগোপন স্রোত। (চলবে)
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)