এক সময় ছত্তীসগঢ়ের জঙ্গলমহলে ‘টিসিওসি’-র আশঙ্কায় ঘাম ঝরত পুলিশের। মাওবাদীদের ‘ট্যাকটিক্যাল কাউন্টার অফেন্সিভ ক্যাম্পেন’— সংক্ষেপে ‘টিসিওসি’— এক একটি গ্রীষ্মে হয়ে উঠত রক্তক্ষয়ী। রাস্তার উপর আইইডি, রাতের আঁধারে থানায় হানা, অস্ত্র লুঠ, ল্যান্ডমাইন ও ‘ডিরেকশনাল মাইন’ ফাটিয়ে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর কনভয় উড়িয়ে দেওয়া— এটাই ছিল মাওবাদীদের হামলার ধাঁচ। পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে যেমন এই 'টিসিওসি' বহু পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানের প্রাণ কেড়েছে, ছত্তীসগঢ়ের দন্তেওয়াড়া, বিজাপুর, সুকমা, নারায়ণপুর, কোন্ডাগাঁও, কাঙ্কের, অবুঝমাঢ়ের অন্দরে তার চেয়েও বড় খেসারত দিতে হয়েছে বাহিনীকে।
তবে সময় ঘুরেছে। পাল্টে যাচ্ছে কৌশলের খোলনলচে। বস্তার রেঞ্জের আইজি সুন্দররাজ পাট্টিলিঙ্গম বলছেন, ‘‘এখন মাওবাদীদের বিরুদ্ধে ‘টিসিওসি’-ই আমাদের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র। এই কৌশলেই আমরা ওদের ঠেকাতে পেরেছি।’’ কারণ, মাওবাদীদের বিরুদ্ধে ছত্তীশগড় পুলিশের বিশেষ বাহিনীর (ডিস্ট্রিক্ট রিজার্ভ গার্ড বা ডিআরসি, বস্তার ফাইটার্স) সদস্যেরা এই অরণ্যেরই ভূমিপুত্র এবং ভূমিকন্যা। এবং তাঁদের অনেকেই প্রাক্তন মাওবাদী।
গত ২১ মে, অবুঝমাঢ়ের জঙ্গলে মাওবাদী শীর্ষ নেতা বাসবরাজুর মৃত্যুর পর বৃহস্পতিবারই বিজাপুর জেলার ন্যাশনাল পার্ক এলাকার জঙ্গলে নিরাপত্তাবাহিনীর সংঘর্ষে শীর্ষ মাওবাদী নেতা নরসিংহচলম ওরফে সুধাকর নিহত হয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। দেশের অন্যতম ‘মোস্ট-ওয়ান্টেড’ এই মাওবাদী নেতা তেলঙ্গানা, ছত্তীসগঢ় ও মহারাষ্ট্র জুড়ে সক্রিয় ছিলেন। মাওবাদী কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুধাকরের মাথার দাম ছিল কোটি টাকা। ডিআরজি, কোবরা ও স্পেশাল টাস্ক ফোর্স সহ যৌথ বাহিনীর ‘টিসিওসি’র কারণে এই সাফল্য বলে ছত্তীসগঢ় পুলিশসূত্রের দাবি।
পুলিশের সূত্র বলছে, ‘টিসিওসি’ আগে ছিল মাওবাদীদের এক মরসুমি রণকৌশল। এলাকার বাসিন্দাদের সাহায্য নিয়ে এপ্রিল-মে-জুন জুড়ে ছিল তার বিস্তার। অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করত জনমিলিশিয়া বা জন সশস্ত্র বাহিনী। পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে যা ছিল জনসাধারণের কমিটি। ছত্তীসগঢ়ে মাওবাদীরা গ্রামের কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীদের স্কোয়াড সদস্য হিসেবে নিয়োগের পাশাপাশি, গ্রামবাসীদের নিয়ে জনমিলিশিয়া গঠন করে নানা দায়িত্ব দিত। যেমন সাধারণ বাসিন্দা হিসেবে ‘রেকি’ করা, বাহিনীর যাতায়াত পথের আগাম খোঁজখবর নেওয়া।
ডিআরসি এবং বস্তার ফাইটার্স লড়াইটা ঘুরিয়ে দিয়েছে। ছত্তীসগঢ় পুলিশের বক্তব্য, মাওবাদী দমনে বাইরে থেকে আসা আধাসেনার অনেকেই স্থানীয় ভাষা বোঝেন না। এলাকা সম্পর্কে এবং এলাকার সংস্কৃতি সম্পর্কে বুঝতেই তাঁদের সময় চলে যায়। এখন সেই সমস্যার সমাধান হয়েছে। ডিআরজি’র এক জওয়ান (যিনি আগে মাওবাদীদের ‘জনমিলিশিয়া’র সদস্য ছিলেন) বলছেন, “আগে আমরা যেখানে লুকোতাম, সেই গুহা এখন আমরা ঘিরে ফেলি। আগে যে পথে মাওবাদীরা সরে যেত, এখন আমরা ওই পথ আটকে রাখি। আগে বাহিনী যে পথে তল্লাশিতে যাবে, সেটা জেনে আড়ালে থেকে হানা দিতাম। এখন সেই কৌশলই মাওবাদী দমনে প্রয়োগ করা হচ্ছে।’’
সুকমার চিন্তলনাড়ের যোগেশ মান্ডভি প্রায় ১২ বছরেরও বেশি নকশালপন্থী সংগঠনে ছিলেন। আত্মসমর্পণের পর এখন তিনি ডিআরজি-র ৭ নম্বর ব্যাটেলিয়নের অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইন্সপেক্টর (এএসআই)। তাঁর কথায়, ‘‘মাওবাদীরা যেখানে থাকত, গোপন ডেরায় রাতে যেখানে বিশ্রাম নিত, এখন সেখানে আমরা হাজির হয়ে যাই। ‘অ্যামবুশ টেকনিক’— অর্থাৎ লুকিয়ে থেকে হামলা করার কৌশল মাওবাদীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হচ্ছে।’’
দন্তেওয়াড়ার ডিআরজি শিবিরে গিয়ে দেখা গেল, সাতসকালে জঙ্গলে ‘অ্যামবুশ’ করতে যাওয়ার আগে ডিআরজি এবং ‘বস্তার ফাইটার্স’ জওয়ানদের তাতাচ্ছেন পুলিশ কর্তারা। একেবারে সেনাবাহিনীর আদলে তাঁরা শপথ নিচ্ছেন, এলাকার মাটি সন্ত্রাসমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা লড়াই চালিয়ে যাবেন। প্রাক্তন মাওবাদী বর্তমানে ডিআরজি-র সদস্য ছোটু মান্ডভি বলছেন, “আগে মাওবাদী সংগঠনে আমাদের শেখানো হত, পুলিশ শত্রু। এখন বুঝি, আসল শত্রু তারাই, যারা আমাদের শিশুদের স্কুল পুড়িয়ে দিয়েছে, রেশন বন্ধ করেছে, ভবিষ্যৎ কেড়ে নিয়েছে।”
জানা গেল, এলাকায় সিআরপি’র কোবরা বাহিনীর সঙ্গে ডিআরজি এবং বস্তার ফাইটার্স-এর সদস্যরা থাকায় অভিযান ব্যর্থ হচ্ছে না। বাসবরাজুর মৃত্যু সম্পর্কে পুলিশ দাবি করেছে, ‘চার দিক থেকে ঘিরে ধরেই অভিযান চালানো হয়। মাটির নিচে থাকা শেল্টার-অঞ্চল আগে থেকেই চিহ্নিত ছিল। অ্যামবুশ-এর অপেক্ষায় ছিল ডিআরজি, বস্তার ফাইটার্স এবং সিআরপি’র কোবরা বাহিনী।’ এই অভিযানে এক দিনে ২৭ জন মাওবাদী নিহত হয়েছেন। বাসবরাজু ছাড়াও রয়েছেন মাওবাদী সংগঠনের একাধিক ডিভিশনাল কমিটির সদস্য। এক পুলিশ কর্তার কথায়, ‘‘এই অভিযান জমিনে ঘেরা, মনস্তত্ত্বে জয়।’’
এখানেই চলে আসছে বাংলার জঙ্গলমহলের শিক্ষা, যা শিখেছে ছত্তীসগঢ়। মাওবাদী অশান্তিপর্বে ২০০৪ থেকে ২০১১ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছিলেন পুলিশ কর্মী, কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান সহ বহু সাধারণ মানুষ। এক প্রাক্তন পুলিশ কর্তা মানছেন, বাম আমলে পুলিশের অপারেশন ছিল অতি বাহ্যিক ও প্রযুক্তিনির্ভর (মোবাইল ফোন ট্যাপ করে কথোপকথন শোনা), যা স্থানীয় বাস্তবতা বুঝতে পারেনি। কারণ, স্থানীয় বাসিন্দারা স্বেচ্ছায় বা ভয়ে গণ মিলিশিয়ার সদস্য থাকায় সেই অর্থে পুলিশের কাছে খবর পৌঁছত না। কিংবা খবর এলেও পৌঁছত অনেক দেরিতে। যেমন শীর্ষ মাওবাদী নেতা কিষেনজি লালগড়ের আজনাশুলির জঙ্গলে সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন, আর পুলিশের কাছে সেই খবর পৌঁছচ্ছে অনেক পরে। তখন ‘টিসিওসি’র আশঙ্কায় চটজলদি অভিযানে যাওয়ার ঝুঁকিও নিত না পুলিশ।
এক দশক পরে এ রাজ্যে সরকার বদলের পর এখন জঙ্গলমহলের জেলাগুলি ‘মাওবাদী প্রভাবমুক্ত’। মাওবাদী ও জনসাধারণ কমিটির বড় অংশ মূলস্রোতে ফিরে এখন রাজ্য পুলিশের স্পেশাল হোমগার্ড পদে চাকরিতে। ছত্তীসগঢ়েও জনজাতি প্রতিনিধি, স্থানীয় ভাষাভাষী জওয়ান, স্থানীয় মানসিকতাকে সম্মান এবং সমাজে ধীরে ধীরে ‘ভয় নয়, ভরসা’ প্রতিষ্ঠায় সাফল্য এসেছে বলে দাবি বস্তার রেঞ্জের আইজির। ডিআরজি-র দান্তেওয়াড়া শিবিরের ইনচার্জ প্রদীপকুমার বিসেনেরও দাবি, ‘‘কেবল গুলি দিয়ে নয়, মূলস্রোতে ফেরা জনজাতিদের সমর্থন আর আত্মবিশ্বাসের কারণে এই সাফল্য।”
ছত্তীসগঢ়ের বস্তার জেলা সদরের প্রবীণ সাংবাদিক নবীন গুপ্ত বলছেন, ‘‘বস্তারের গভীর নকশালপ্রভাবিত এলাকায় পুলিশ শিবির স্থাপনের পর থেকে ধারাবাহিক ভাবে অভিযান চালানো হয়েছে, যার ফলে নকশালবাদ এখন কোণঠাসা। গ্রামের মানুষরা মূল স্রোতে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের পরিষেবা নিচ্ছেন।’’
তবে ঘুরে ফিরে আসছে কিছু মূল প্রশ্ন। গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির (এপিডিআর) পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রীয় সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য অঙ্কুর মণ্ডল যেমন বলছেন, ‘‘আমাদের আশঙ্কা, বিচারবহির্ভূত ভাবে ‘এনকাউন্টার’ এর নামে ছত্তীসগঢ়ে কার্যত গণহত্যা চলছে। যাঁদের হত্যা করা হচ্ছে, তাঁরাও এই রাষ্ট্রের নাগরিক। সমস্যা মেটাতে রাজনৈতিক সমাধান জরুরি। মাওবাদীরা ঠিক কি ভুল সেই বিতর্কে না গিয়ে আমাদের দাবি, তাঁদের সঙ্গে সরকার আলোচনায় বসুক। কারণ, শুধুমাত্র মাওবাদীরা নন, ওখানকার সাধারণ জনজাতিরা জল-জমি-জঙ্গল রক্ষার আন্দোলনে শামিল রয়েছেন। তাঁদের এক সারিতে নিয়ে আসা হচ্ছে। যা একেবারেই কাঙ্ক্ষিত নয়।’’
ছত্তীসগঢ়ের বাতাস-মাটিও এই প্রশ্ন করছে। (শেষ)
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)