Advertisement
E-Paper

আশ্চর্য শিলাখণ্ডই আস্থার নয়া বিগ্রহ কেদারনাথে

কেদারনাথ মন্দিরের চাতালে বসে থাকা পুরোহিতের কথাগুলো অন্য কোনও সময়ে শুনলে হয়তো অদ্ভুত লাগত। কিন্তু হৃষীকেশে পা রাখা ইস্তক প্রায় প্রত্যেক দিন এই একটাই কথা শুনে আসছি। ভাড়া গাড়ির ড্রাইভার, হোটেল-কর্মী, ধাবা বা চায়ের দোকান কিংবা ধর্মস্থানের আশেপাশে পুজোর সামগ্রী বিক্রির স্টল, সর্বত্র এই একই কথা “ইস সাল ধন্দা তো বিলকুল চৌপাট!”

শুভলক্ষ্মী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৪ ০৩:২৭
রক্তচন্দন মাখা সেই শিলাখণ্ড। কেদারনাথ মন্দিরের ঠিক পিছনে। ছবি: শুভলক্ষ্মী ভট্টাচার্য

রক্তচন্দন মাখা সেই শিলাখণ্ড। কেদারনাথ মন্দিরের ঠিক পিছনে। ছবি: শুভলক্ষ্মী ভট্টাচার্য

কেদারনাথ মন্দিরের চাতালে বসে থাকা পুরোহিতের কথাগুলো অন্য কোনও সময়ে শুনলে হয়তো অদ্ভুত লাগত। কিন্তু হৃষীকেশে পা রাখা ইস্তক প্রায় প্রত্যেক দিন এই একটাই কথা শুনে আসছি। ভাড়া গাড়ির ড্রাইভার, হোটেল-কর্মী, ধাবা বা চায়ের দোকান কিংবা ধর্মস্থানের আশেপাশে পুজোর সামগ্রী বিক্রির স্টল, সর্বত্র এই একই কথা “ইস সাল ধন্দা তো বিলকুল চৌপাট!”

‘ধন্দা’য় যে মন্দা লেগেছে, তাতে আর আশ্চর্যের কী? পুজোর থালা এগিয়ে দিয়ে বিনীত অনুরোধ পুরোহিতের, “ইস বার চড়াওয়া থোড়া জাদাহি দিজিয়ে।” প্রণামী এ বার একটু বেশিই দিন।

গত বছর জুনের ১৬-১৭ তারিখে কেদারনাথে সেই ভয়ঙ্কর ধ্বংসলীলার ছবি সবাই দেখেছেন। এক বছরেও মানুষের আতঙ্ক যেমন ফিকে হয়নি, আস্থাতেও যেন চিড় ধরেছে কোথাও। এ বছর তাই খুব কম যাত্রীই সাহস করে চারধাম যাত্রায় বেরিয়েছেন।

গঙ্গোত্রী মন্দিরে সন্ধ্যার আরতি দেখছেন হাতে গোনা কয়েক জন। মন্দিরের চাতালে পুরোহিতদের আফশোস, “হাদসা তো হুয়ে থে কেদারনাথ মে। পর ইঁহা হম লোগোঁ বেকার হো গ্যয়া!” বদ্রীনাথের বাণিজ্যেও ভাটার টান। এখানকার পুরোহিতরা অবশ্য বেশ পেশাদার। এক বাবাজি কী সব ভস্ম-টস্ম কপালে লাগিয়ে দিয়ে বললেন, “উন্নতি করবি মা, পার্লামেন্টে তোর নামে চর্চা হবে। নে, ১১০০ টাকা বার কর।” পকেট থেকে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে এগারো টাকা বার হল। বাবাজি তাই নিয়েই উধাও হলেন। বুঝলাম, সংসদে নিজের নামের চর্চা হওয়াটা দেখে যাওয়া হল না!

গঙ্গোত্রী থেকে নেমে উত্তরকাশী হয়ে গুপ্তকাশী। আর সেখান থেকেই আস্তে আস্তে ছবিটা পাল্টাতে লাগল। উত্তরকাশীতে ঢোকার মুখে রাস্তাটা স্রেফ উধাও। নতুন রাস্তা তৈরি হয়েছে বটে, পাশপাশি দেখা যাচ্ছে ধুয়ে যাওয়া পুরনো রাস্তা, ভেঙে ঝুলে থাকা ব্রিজও। নদীর ধারে ঘরবাড়ির কঙ্কাল। তিলওয়ারা পেরিয়ে কুণ্ড-এর পথে ড্রাইভার হঠাৎ জোরে ব্রেক কষলেন। একটা ফাঁকা জায়গার দিকে কিছু ক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “ইহাঁ তো এক বহোত বড়া হোটেল থা! অব তো বিল্ডিং কা নাম-ও-নিশান নেহি হ্যায়!”

আমরা ফাটা থেকে হেলিকপ্টার ধরব। পবনহংস ছাড়াও দেখলাম তিন চারটে বেসরকারি হেলিকপ্টার সার্ভিস রয়েছে। গুপ্তকাশীতে বায়োমেট্রিকস ‘পঞ্জিকরণ কেন্দ্র’ খুলেছে। আগেই হৃষীকেশে এই কাজ করিয়ে নেওয়ায় লাইনে দাঁড়াতে হল না। মেডিক্যাল ক্যাম্পে প্রেসার মেপে একে একে প্রায় সবাইকে ‘আনফিট’ ঘোষণা করে ভাগিয়ে দিচ্ছেন স্বাস্থ্য অফিসাররা।

আমাদের কপ্টার ছাড়বে দুপুরে। সকালে তাই গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেলাম সোনপ্রয়াগের দিকে। দু’কূল ভাসিয়ে, সব কিছু লন্ডভন্ড করে মন্দাকিনীর হড়পা বান নেমে এসেছিল এই পথেই। এখন অবশ্য বয়ে যাচ্ছে নীল স্বচ্ছ জলের সরু একটা ধারা। কিন্তু ধ্বংসের চেহারাটা দিব্যি দগদগে। ভাঙাচোরা রাস্তায় বিস্তর চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নতুন ১৮ কিলোমিটার হাঁটাপথের শুরু এই সোনপ্রয়াগ থেকেই।

বেলা তিনটে নাগাদ ওঠা হল কপ্টারে। সাত মিনিটের উড়ান পৌঁছে দিল কেদারনাথের একমাত্র হেলিপ্যাডে। তার পাশেই সেনাবাহিনীর বানানো তাঁবুতে পাঁচশো জনের থাকার বন্দোবস্ত। আর তাঁবু থেকে পায়ে হেঁটে মিনিট পনেরো গিয়ে মন্দির। এক একটা তাঁবুতে জনা দশেক যাত্রী শুতে পারেন। বরাদ্দ একটা করে স্লিপিং ব্যাগ। রাতের খাবারও ওরাই দেবে। বিকেলে বৃষ্টি নেমে বেশ ঠান্ডা। সেনারা কাগজের কাপে ধরিয়ে দিয়ে গেল গরম চা। বৃষ্টি থামতে তাঁবু থেকে বেরিয়ে চারপাশটা ঘুরে দেখলাম। যে কেদারে আগে দিনে প্রায় পাঁচ-দশ হাজার তীর্থযাত্রীর ভিড় হতো, সেখানে আজ পাঁচশো যাত্রীর কোটাও পূর্ণ হয়নি। জায়গায় জায়গায় হাল্কা বরফ। রাস্তার ধারে পাহাড় থেকে নেমে আসা পাথর। পায়ের নীচে নরম ঝুরো মাটি। সম্ভবত জলস্রোতে নেমে আসা কাদামাটি রোলার চালিয়ে সমান করা হয়েছে।

অনেকগুলো প্রকাণ্ড পাথর ডিঙিয়ে পৌঁছতে হল মন্দিরের সামনে। ধ্বংসের আগের কেদারনাথ মন্দিরের ছবি দেখেছিলাম। মন্দিরের সামনে রেলিং ঘেরা উঁচু চাতাল, বেশ কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হতো সেই চাতালে। কিন্তু কোথায় সিঁড়ি? সবুজ রঙের কার্পেট পাতা রাস্তা সোজা গিয়ে মিশেছে চাতালে। আশপাশের দোকান, হোটেল, ঘরবাড়ি সবই চাপা পড়ে গিয়েছে। চোরাবারি তাল ফেটে নেমে আসা স্রোতে আছড়ে পড়া পাথর আর মাটি প্রায় ১০-১২ ফুট উঁচু পরত ফেলেছে গোটা কেদারনাথের ওপর। আশপাশের সব বাড়িঘর এক-দেড়তলা উঁচু মাটির নীচে চাপা পড়ে আছে। মনে পড়ল ফাটার লজ মালিকের কথা“আভি ভি কিতনে শব দবে পড়ে হোঙ্গে কেদার মে!” গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

আরতি শেষ হওয়ার পরেও আলো রয়েছে আকাশে। পায়ে পায়ে গেলাম মন্দিরের পিছন দিকটায়। এলোমেলো পড়ে আছে নানা আকারের পাথর, আর মন্দির থেকে পাঁচ-সাত মিটার দূরে পড়ে একটা প্রকাণ্ড শিলাখণ্ড। মন্দির যতটা চওড়া, দানবাকৃতির গাছের গুঁড়ির মতো সেই শিলা দৈর্ঘে একেবারে ঠিক ততটাই। যেন কেউ মাপ নিয়ে বসিয়েছে। তার পিছনে এসে জমা হয়ে আছে শয়ে শয়ে ছোট বড় পাথর, ভাঙা বাড়িঘরের কংক্রিটের চাঁই, ধুলো আর মাটি। প্রকাণ্ড শিলাটাকে ডিঙিয়ে পাথরগুলো কিছুতেই আছড়ে পড়তে পারেনি মন্দিরের ওপর। পাহাড় থেকে ধেয়ে আসা জলের প্রচণ্ড স্রোতও টলাতে পারেনি এই শিলাকে। মন্দিরকে মাঝে রেখে জল বয়ে গিয়েছিল শিলার দু’পাশ দিয়ে।

হয়তো নিছকই সমাপতন।

কিন্তু প্রকৃতির রোষে আতঙ্কিত আমজনতার আস্থার ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে এই প্রকাণ্ড শিলাখণ্ড। ভীম শিলা, দেব শিলা, দিব্য শিলা নানা নামে ডেকে তার নিত্য পুজো হচ্ছে। মন্দির প্রদক্ষিণের পরে এই শিলাকেও প্রদক্ষিণ করে, সামনে রাখা দানপাত্রে দক্ষিণা দিয়ে প্রণাম করছেন ভক্তেরা।

চোখের সামনে দেখলাম, প্রকৃতির ভয়াল মারকে ঠেকিয়ে দেওয়ার মহিমা নিয়ে গড়ে উঠছে দেবতার আর এক নতুন বিগ্রহ। প্রকৃতিরই এক অংশ, বিশালাকায় এক শিলাখণ্ড।

গ্যালারির ছবি লেখকের সৌজন্যে।

subholakshmi bhattacharyay kedarnath badrinath
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy