Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ধামসা-মাদলের মায়াবি দেশে

পুরুলিয়ায় যখন রঙের রায়ট লাগে পলাশের লালে আর মহুয়ার হলুদে শালের বনে হাওয়া খেলে যায় চাঁদনি রাতে এক আকাশ জোছনার আলোয় স্নান করে মহুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে চরাচর বহুদূর থেকে ভেসে আসে ধামসা মাদলের আওয়াজ মনে হয় এ যেন আমাদের সেই চেনা পৃথিবীটা নয়, অচেনা এক অতিপ্রাকৃত জগতের প্রতিভাস। পুরুলিয়া তার লোকাচার, লোকসংস্কৃতিকে নিয়ে পথ চলছে কতকাল। তার পাহাড় জঙ্গলের সীমানার মধ্যে অন্তরীণ হয়ে থাকা এই সব সম্পদকে সে রক্ষা করছে সযত্নে, পুরুলিয়ার ছৌ-নাচ, ঝুমুর, টুসু গানে যে মাটির স্পর্শ তা কোথায় পাব? স্মৃতির সরণিতে ডুব দিলেন পারমিতা মুখোপাধ্যায়।পুরুলিয়ায় যখন রঙের রায়ট লাগে পলাশের লালে আর মহুয়ার হলুদে শালের বনে হাওয়া খেলে যায় চাঁদনি রাতে এক আকাশ জোছনার আলোয় স্নান করে মহুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে চরাচর বহুদূর থেকে ভেসে আসে ধামসা মাদলের আওয়াজ মনে হয় এ যেন আমাদের সেই চেনা পৃথিবীটা নয়, অচেনা এক অতিপ্রাকৃত জগতের প্রতিভাস। পুরুলিয়া তার লোকাচার, লোকসংস্কৃতিকে নিয়ে পথ চলছে কতকাল। তার পাহাড় জঙ্গলের সীমানার মধ্যে অন্তরীণ হয়ে থাকা এই সব সম্পদকে সে রক্ষা করছে সযত্নে, পুরুলিয়ার ছৌ-নাচ, ঝুমুর, টুসু গানে যে মাটির স্পর্শ তা কোথায় পাব? স্মৃতির সরণিতে ডুব দিলেন পারমিতা মুখোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:০০
Share: Save:

অনেক অনেক দিন আগের এক স্মৃতি রোমন্থনের বড় সাধ জাগছে। স্পষ্ট মনে আছে, তখনই আমি মাঝে মাঝে শাড়ি, ক্লাস নাইনে পড়ি। স্কুল থেকে শিক্ষামূলক ভ্রমণে নিয়ে যাওয়া হবে। কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে? না, পুরুলিয়ার মাঠাবুরু। নির্ধারিত দিনে নির্ধারিত সময়ে ক্লাসের মেয়েরা সবাই জড়ো হলাম হাওড়া স্টেশনে। রাতের রেলগাড়ি--- সেই কবেকার ট্রেন! আদ্রা চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার। আজও রাত এগারোটায় ছাড়ে। মেয়েরা সবাই যার যার বাড়ি থেকে অভিভাবকদের সঙ্গে পৌঁছে গিয়েছিল। আমরা তিন জন যারা স্কুলের হস্টেলে থাকতাম সম্ভবত আমাদের কোনও দিনি মানে শিক্ষিকার সঙ্গে গিয়েছিলাম হাওড়া স্টেশনে। আমরা তখন আমাদের শিক্ষিকাদের দিদিই বলতাম।

‘টিন-এজ’ কথাটার আক্ষরিক বাংলা হয় না, বলতে গেলে বলতে হয় বয়ঃসন্ধিক্ষণ। কিন্তু ওই ‘আধেক চেনা আধেক জানা’র বয়সটা বোঝাতে ইংরেজি ‘টিন-এজ’ শব্দটাই যেন মনে হয় বেশি উপযুক্ত। তখন আমরা ওই মিষ্টি মধুরই বলুন বা দুঃসহ স্পর্ধার বয়সই বলুন ‘টিন এজ’এ সবে পা দিয়েছি। আর সেই প্রথম বাবা, মায়েদের ছেড়ে বাড়ির বাইরে পা রাখা, রাতের ট্রেনে যাওয়া! গন্তব্য এমন একটি জায়গায় যেখানে এর আগে কখনও যাওয়ার সুযোগ ঘটেনি। আমাদের ট্রেনে উঠিয়ে অবিভাবকরা বিদায় নিলেন। সঙ্গে ছিলেন আমাদের কয়েক জন দিদি এবং আয়োজক পর্বত আরোহণ সংস্থাটির দাদা, দিদিরা।

পরদিন ভোরবেলা পুরুলিয়া স্টেশনে নেমে একটা বাসে করে আমরা সদলবলে চলেছিলাম মাঠাবুরু অভিমুখে। ‘বুরু’ মানে পাহাড় অর্থাত্‌ মাঠা পাহাড়। মাঠাবুরুর কাছে আমাদের ক্যাম্প করা হয়েছিল। সম্ভবত সে সময়টা ছিল শীতকাল। আমাদের দলটাকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। আমরা রাত কাটাতাম তাঁবুতে এবং সকাল থেকে সন্ধে অবধি আমাদের রুটিন ছিল নানা রকম কর্মসূচিতে ঠাসা।

গিয়েছিলাম আমরা মূলত পাহাড়ে চড়ার প্রশিক্ষণ নিতে যাকে এখন বলে রক ক্লাইম্বিং। কিন্তু তার মধ্যে মধ্যেই প্রকৃতিকেও চিনতে শিখেছিলাম। কারণ, পুরুলিয়ার পাহাড়, জঙ্গল, পাখি, গাছ আমাদের সকলকে ঘিরে রেখেছিল তিনটে দিন। তাদের বুকের মাঝে আমাদের আনকোরা কিশোর মনগুলোকে আশ্রয় দিয়েছিল। ভোরবেলা দাদা, দিদিদের সঙ্গে শাল শিমূল মহুয়া পলাশ গাছেদের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতাম মাঠাবুরুর আনাচে কানাচে। ঝোপ জঙ্গল ভেদ করে খুজে নিতাম বড় বড় বোল্ডার বা ছোট্ট পাহাড়ের আকারের কোনও পাথর। সেই সব পাথর বেয়ে ওপরে ওঠার প্রশিক্ষণ শুরু হত আমাদের। আবার কখনও হয়তো চিনতে বেরিয়ে পড়তাম নানা রকমের গাছ বা পাখি। রাতের বেলা তারায় ভরা খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে তারাদের মাঝে হারিয়ে যেতাম।

শহরের কোলাহল থেকে বহুদূরে পুরুলিয়ার মাঠাবুরুর বুকে তিন দিনের ক্যাম্প যেন আমাদের মনের জানালা খুলে দিয়েছিল। শীতের রাতে তাঁবুর মধ্যে খড়ের বিছানায় শুয়ে মাঝরাতে যখন প্রচণ্ড ঠান্ডায় হি হি করে কাঁপছি আর চাপিয়ে নিচ্ছি সোয়েটার মাফলার তখনও কিন্তু মনের ওই অনাবিল ভাললাগাটা হার মানেনি। ফিরে আসার আগের দিন ক্যাম্প ফায়ার থেকেই চোখের জল বাঁধ মানছিল না। সেটা দ্বিগুণ হয়েছিল হাওড়া স্টেশনে নেমে। পুরুলিয়ার মাঠাবুরু এক অদৃশ্য মায়াজালে জড়িয়েছিল আমাদের।

শুধু কি মাঠাবুরু? পাখি পাহাড়ও দেখেছিলাম। তখন অবশ্য পাহাড়টাকে নিয়ে ধ্যাষ্টামো শুরু হয়নি।

আজ এত বছর পর আবার পুরুলিয়ার স্মৃতি কেন নতুন করে ধরা ছিল মনে আজ সে কথাই বলব আপনাদের। আমাদের পূবের কত মানুষ যে পশ্চিমের এই মুম্বই শহরটায় পাড়ি জমিয়েছে রুটি রুজির সন্ধানে আর লেখালেখির সূত্র ধরে এমন কত মানুষের যে সঙ্গে আলাপ হয়ে যায়। এমন ভাবেই একদিন হঠাত্‌ আলাপ হয়ে গিয়েছিল রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। কথায় কথায় উঠে এসেছিল পুরুলিয়ার প্রসঙ্গ।

মুম্বইয়ে আমরা যে যখন থেকেই আসি না কেন প্রত্যেকেই সেই একই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি। স্থান সংকুলানের সমস্যা। শহর যত মানুষের ভিড়ে ভারাক্রান্ত হচ্ছে, তত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে জমি বাড়ির দাম আর সামান্য পায়রার খোপের (এখানকার বেশিরভাগ ফ্ল্যাটবাড়িগুলোকে এ ছাড়া আর কিই বা বলা যায়!) জন্য কী লড়াই কী লড়াই। আর আমরা যা ছেড়ে এসেছি, পিছনে ফেলে এসেছি পশ্চিমবঙ্গের সেই অবারিত মাঠ, খেত, জঙ্গল— ছোটবেলায় গ্রামদেশের খোলা বাড়িতে মস্ত উঠোনে ছুটোছুটি। ধানখেতের আল ধরে দিকশূন্যপুরের দিকে চলে যাওয়া আম, জাম, কাঁঠাল, গন্ধরাজ লেবু, বাতাবি লেবু, লিচু, জামরুলের বাগানে স্কুলছুট পালিয়ে বেড়ানো সে সব কী স্বপ্ন হয়ে গেল? কিছুই কি আর অবশিষ্ট রইল না? এই দমবন্ধ করা শহরের ইটকাঠের ধ্বংসস্তূপের আড়ালে কী কবর দিয়ে দিতে হবে আমাদের সেই খেলে বেড়ানোর মুক্ত প্রকৃতিকে?

আমরা বেশির ভাগ মানুষই নিজেদের হারিয়ে ফেলি আমাদের পেশা, আমাদের শহরজীবন ধীরে ধীরে আমাদের গ্রাস করে নেয়। তবু এর মধ্যেও কোনও কোনও মানুষ একটু অন্য ভাবে জীবনের পথ চলা শুরু করেন রাজর্ষি এই দলে। তিনি কিন্তু তাঁর ছেলেবেলার লালমাটির দেশ, ধামসা মাদলের দেশ পুরুলিয়াকে ভুলতে পারেননি। নিজের পেশা সামলে, পরিবার সামলে, মুম্বইয়ের এই দ্রুত ছুটে চলা জীবনের মাঝেও তিনি তাঁর স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। এই স্বপ্ন প্রায়শই তাঁর মনের মাঝে বাসা বাঁধত যে পুরুলিয়া খনিজ, বনজ এবং সর্বোপরি মানবসম্পদে পূর্ণ, প্রকৃতি যাকে দু’হাত ঢেলে দিয়েছে অথচ যে চিরকাল অবহেলিত থেকে গেছে, তার জন্য কিছু করতে হবে।

কখন থেকে এই স্বপ্ন দেখার শুরু রাজর্ষি?

রাজর্ষির নিজের কথাতেই বলি।

‘১৯৯০ সাল। হাইস্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে সবে কলেজে ভর্তি হয়েছি। পুরুলিয়ায় বাড়ির দুর্গাপুজোয় নবমীর রাতে খাওয়াদাওয়ার পর সব জেঠতুতো, পিসতুতো ভাইয়েরা মিলে সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে চলে গিয়েছিলাম পুরুলিয়া শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে পারিবারিক সম্পত্তি খয়ের বনে যাতে এক সময় খয়ের গাছের জঙ্গল ছিল ও গুটিপোকা চাষ করা হত। সেই খয়ের বনের পঁচানব্বই শতাংশ প্রাইভেট ফরেস্ট অ্যাকুইজিশন আইনের আওতায় সরকার কর্তৃক অধিগৃহীত হয় এবং বাকি পাঁচ শতাংশ ছিল শুকনো ডাঙা জমি আর ভাগ চাষিদের হাতে। সেই নবমীর রাত আমার কাছে আজও স্মরণীয়, সেই ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, জঙ্গলের গাছগুলো যেন তারা ভর্তি আকাশের তলায় ঘোমটা পরে বসে আছে। আমরা ছয় ভাই বোন কোনও কথা না বলে আশ্বিনের শিশির ভেজা মাঠে চুপ করে বসেছিলাম আর গেয়ে উঠেছিলাম ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা, বিশ্বভরা প্রাণ’। কখন যে ভোর হয়ে গিয়েছিল বুঝতে পারিনি। তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরতেই বড়দের তুমুল বকুনির সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বলেছিলাম, আমরা সূর্য ওঠা দেখতে গিয়েছিলাম।

সেই হয়তো সূত্রপাত। যে মাটি মা তাকে কি ভোলা যায়। তার পর মাঝে অনেকগুলো বছর চলে গেছে জীবিকায় থিতু হতে। কিন্তু মাতৃভমির কথা রাজর্ষি ভুলতে পারেননি। নিজেকে কেবল ভাল চাকরি, ফ্ল্যাট, গাড়ি, বাড়ির মধ্যে বেঁধে রাখতে পারেননি। সেই ভাবনা থেকেই ২০০৮ সালে পারিবারিক সেই অবশিষ্ট পাঁচ শতাংশ যা প্রায় কুড়ি একর জমি অধিগ্রহণ করা শুরু হল। এই জমি অধিগ্রহণে অনেক বাধা বিপত্তির সামনাসামনি হতে হয়েছে। কিন্তু এ সব বাধা পেরিয়ে শেষমেশ ২০১০ সালে জমির চারদিকে দেওয়াল উঠল।

আবার রাজর্ষির কথাতেই বলি, ‘‘সেই সময় শুধু একটা কথাই সবাইকে বলতাম যে এ জায়গা কোনও মতে বেহাত হতে দেব না, প্লট করে বিক্রিও হবে না। এ জায়গা হবে পুরুলিয়ার কৃষ্টির পীঠস্থান।’’

রাজর্ষি এই ভাবনা থেকে এগোতে এগোতেই ধীরে ধীরে পাশে পেয়েছেন অনেক মানুষকে এবং গড়ে উঠেছে একটি ফাইন্ডেশন, যার নাম ‘রঞ্জিত ঝর্না কাঁসাই ইকো ফাউন্ডেশন’। বাবা, মা এবং পুরুলিয়ার কাঁসাই নদীর নামে নাম দিয়েছেন রাজর্ষি এই সংস্থার। পুরুলিয়ায় প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব নেই কিন্তু যার অভাব তা হল মানব সম্পদ উন্নয়নের। মানবসম্পদই যে জগতের শ্রেষ্ঠ সম্পদ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পুরুলিয়ার উপেক্ষিত, পিছিয়ে পড়া জনজাতির মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া এবং এঁদের স্বনির্ভর করে তোলার লক্ষ নিয়েই তৈরি হয়েছিল এই সংস্থা। এখানে গ্রামের মেয়েদের সেলাই বা হস্তশিল্পে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের হাতের কাজ দেশের নানা শহরে পাঠানো হয় প্রদর্শনীর জন্য। মুম্বইয়ে দু’বার এমন প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য মেয়েদের স্বনির্ভর করে তোলা। পুরুলিয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যেমন— মৃত্‌শিল্পে দিয়ালি পুতুল, আদিবাসী শবরদের হাতে ঘাস দিয়ে তৈরি শিল্পসম্ভার, ছৌ নাচের মুখোশ (বাঘমুন্ডির চোরিদা গ্রামে ছৌ মুখোশ তৈরি হয়), গ্রামের প্রাচীন সূচিশিল্প প্রভৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা এবং সেগুলিকে যুগোপযোগী করে তোলার প্রয়াসে ব্রতী এই ফাউন্ডেশন।

ইতিমধ্যে এই সংস্থা শিশুদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাজ শুরু করেছে। কিছুদিন আগে ৬ সেপ্টেম্বর মুম্বইয়ের বান্দ্রার মানিক সভাগৃহে এই ফাউন্ডেশন এবং নীলকণ্ঠ উডস-এর উদো্যগে এক মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য অর্থসংগ্রহের উদ্দেশ্যে। এ ছাড়াও এই সংস্থার উদ্যোগে লোকসঙ্গীত ও নৃত্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন শুরু হয়েছে, যার নাম রাখা হয়েছে পলাশ। আগামী দিনে এখানে একটি ছৌ নৃত্য অ্যাকাডেমি করার কথাও ভাবা হচ্ছে যাতে এই লোকনৃত্যকে যথোপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া হয়। গ্রামীণ মানুষের নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষা এবং চিকিত্‌সা শিবিরও করা হয়ে থাকে এই সংস্থার মাধ্যমে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রসঙ্গে ‘নীলকণ্ঠ উডস’-এর উল্লেখ করেছি। আগামী দিনে গ্রামের ছেলেমেয়েদের কর্মসংস্থানের জন্য একটি পর্যটন উপযুক্ত ইকো ভিলেজ তৈরি করা হচ্ছে এখানে। এর নামই ‘নীলকণ্ঠ উডস’। এখানে পর্যটকেরা এসে পুরুলিয়ার সাংস্কৃতিক রসদ সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবেন। রাজর্ষি ‘কিছু করতে’ বদ্ধপরিকর।

পুরুলিয়ার নিজস্ব সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে এই ফাউন্ডেশন বন্ধপরিকর। পুরুলিয়ার বিপুল বৈচিত্রকে অল্প কথায় প্রকাশ করা দুষ্কর। তবু ছোট করে এর সম্পর্কে বলি একটু। বিহারের ছোটনাগপুর মালভূমিই বিস্তৃত হয়ে এসেছে পুরুলিয়ার। আগে পুরুলিয়াকে বলা হত মানভূম। জঙ্গল মহলের অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে ডুংরি, পাহাড়, টিলা। বিস্তৃত এই অঞ্চল খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ।। অযোধ্যা, পঞ্চকোট, জয়চণ্ডী, বরন্তি প্রমুখ পাহাড়ের সারি সযত্নে রক্ষা করছে পুরুলিয়াকে। অঞ্চলটা ঝাড়খণ্ড লাগোয়া। এখান থেকে দুয়ারসিনি, সুবর্ণরেখা খুব দূরে নয়।

এই পুরুলিয়ায় যখন রঙের রায়ট লাগে পলাশের লালে আর মহুয়ার হলুদে— শালের বনে হাওয়া খেলে যায়— চাঁদনি রাতে এক আকাশ জোছনার আলোয় স্নান করে মহুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে চরাচর— বহুদূর থেকে ভেসে আসে ধামসা মাদলের আওয়াজ মনে হয় এ যেন আমাদের সেই চেনা পৃথিবীটা নয় অচেনা এক অতিপ্রাকৃত জগতের প্রতিভাস। পুরুলিয়া তার লোকাচার, লোকসংস্কৃতিকে নিয়ে পথ চলছে কতকাল। তার পাহাড় জঙ্গলের সীমানার মধ্যে অন্তরীণ হয়ে থাকা এই সব সম্পদকে সে রক্ষা করছে সযত্নে পুরুলিয়ার ছৌ-নাচ, ঝুমুর, টুসু গানে যে মাটির স্পর্শ তা কোথায় পাব? বলিউডি নাচাগানার জেল্লাকে হারিয়ে এই সব নৃত্য বা সঙ্গীত আমাদের হৃদয়ের গভীরে এক করুণ সুরে বাজতে থাকে।

কত যে উত্‌সব এখানে বছরভর। শরত শেষে হেমন্তের আগমনে পুরুলিয়ার একান্ত নিজস্ব উত্‌সব ‘বাঁদনা’। আদিবাসী সাঁওতালরা যাকে বলে ‘সহরায়’— তাই পুরুলিয়ায় ‘বাঁদনা’। এটি মূলত গো বন্দনা উত্‌সব। কার্তিক অমাবস্যার শেষ-সন্ধ্যায় শুরু হয় বাঁদনা পরব। গঠপুজো, জাগরণ, গোহাইল পুজো, চইখপুরা, গাইচুমা, জাওয়ার, গয়রা-গোঁসাই পুজো, গরু খুটা, কাঁড়া খুটা এই সব পর্বের মাধ্যমে কোথাও তিন দিন কোথাও পাঁচ দিন ধরে চলে বাঁদনা পরব। এ ছাড়া মনসা পুজো, চড়ক, ভাদু, ছাতা, রোহিন বা আদিবাসীদের দিসম সেন্দ্রা, বাহা, বাটাউলি, সহরায় এমনই অসংখ্য লোকায়ত উত্‌সবের সমাবেশ পুরুলিয়ার মানুষের জীবন জুড়ে।

আর পৌষের শেষ দিনে শস্য আর সমৃদ্ধির উত্‌সবের নাম হল ‘টুসু’। পুরুলিয়া সব থেকে জনপ্রিয় উত্‌সব। টুসু পুরুলিয়ার মানুষের মিলন মেলা আবার রঙের মেলাও বটে। রঙিন কাগজ আর ফুলে রথের আকারের চৌডালে সাজানো হয়। চতুর্দোলাই অপভ্রংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে চৌডাল। তার ভেতর থাকে টুসু। কখনও মূর্তি, কখনও বা মাটির সরায় সামান্য পুজোর উপচার—গোবরের নাড়ু, গাঁদা ফুল, চালের পিটুলি, বাতাসা-কদমা। অঘ্রাণের শেষ দিন থেকে মেয়েরা ঘরে ঘরে টুসু জাগরণ রাখে। তার পর পৌষ সংক্রান্তির দিন চৌডোল নিয়ে দল বেঁধে গান গাইতে হাইতে টুসু বিসর্জন।

পুরুলিয়ার কথা বলব আর তার ঝুমুর গান নিয়ে দু’চার কথা লিখব না তা হয় না। ঝুমুর গান পুরুলিয়ার মাটির থেকে উত্‌সারিত প্রাণের গান। এ গানের ইতিহাস অতি প্রাচীন। প্রায় আটশো বছর আগে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে বেজেছিল ঝুমুরের সুর। কেউ কেউ বলেন শ্রীরাধাই ঝুমুরের প্রথম ‘নাচনি’ আর শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ‘রসিক’। কালের প্রবাহে রাজপ্রাসাদেও একদা সমাদৃত হয়েছে দরবারি ঝুমুর আর পুরুলিয়ার লোকজীবনে ঝুমুর গান যেন এক অঙ্গ। ঝুমুরের লাস্য, শৃঙ্গাররস ছাড়িয়ে সে ব্যাপ্তি পৌঁছেছে আধ্যাত্মিকতায়।

পুরুলিয়া নিয়ে লিখতে গেলে কলম চলতেই থাকবে। যেমন পুরুলিয়া নিয়ে লিখতে গেলে সুজিত ও বাঘমুন্ডিতে তাঁর ছৌবুরু ট্যুরিজম-এর কথা বলতেই হবে। অযোধ্য পাহাড়মুখো তাঁর দোতলা বাড়ি। যে কোনও ঘর থেকে পাহাড় দেখা যাবে। ছাদে বসলে তো কথা হবে না। পাহাড় কেটে নেওয়া বা অরণ্য সম্পদ ধ্বংস করা তাঁকে কাঁদায়। প্রকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা তাঁর ধর্ম। পুরুলিয়া জেলাটাকে নিজের হাতের তালুর মতো চেনেন সুজিত। হোম স্টে-র ব্যবস্থা। মনে হবে না দূর দেশে এসে পড়েছি, সুজিতের আস্তানায় উঠলে। বড়ো আন্তরিক সুজিতের ব্যবহার। খরচও খুব বেশি নয়। বলে রাখলে বরাভূম স্টেশন থেকে তাঁর গাড়ি বাঘমুন্ডিতে ছৌবুরু-আস্তানায় নিয়ে আসে। ঝকঝকে গাড়ি অযোধ্যা-দুয়ারসিনি-চরিদা ঘুরিয়ে আনে পর্যটকদের। রাতের রেলগাড়ি চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জারে হাওড়ায় উঠে বরাভূমে নামলেই হল। বাকিটা সুজিতের দায়িত্ব। আলু পোস্ত-পোস্তর বড়া-দেশি মুরগির ঝাল ঝাল কষা-হাঁসের ডিমের ডালনা-স্থানীয় পুকুরের মাছ-মুলি পরাঠা-ঘরে তৈরি লেবুর আচার-গরম জিলিপি, সকালের জলখাবাবারের সঙ্গে— অশন-উত্‌সব। তবে সবই শহর-সম্পর্ক-রহিত। আদি-অকৃত্তিম। মুঠো-ফোন:09732294515. শীতে তো বটেই, সুজিতের ছৌবুরু সবচেয়ে সুন্দর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মার্চে। সুজিতের সাজানো উঠোনেই ঝাঁকালো পলাশ গাছ!

কিন্তু এ বার শেষ করতে হবে। তার আগে বলে নিই, আপনারা যদি চটজলদি পুরুলিয়া যেতে না পারেন, তা হলে দুঃখ করার কিছু নেই। পুরুলিয়া তার নাচ গান শিল্পসম্ভার নিয়ে হাজির হচ্ছে নবি মুম্বইয়ে। সিবিডি বেলাপুরের আরবান হাটে আগামী নতুন বছরের চোদ্দো এবং পনেরোই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ‘লালমাটি উত্‌সব’। দু’দিনব্যাপী গ্রামীণ মেলা ও গানের মেলা।

এই মেলায় গ্রামীণ শিল্পীরা আসবেন তাঁদের শিল্পসামগ্রী নিয়ে। লোকগান ও লোকনৃত্যের কলাকুশলীরা আসবেন, যেমন ছৌ নাচ, বাউল গান প্রভৃতি। উপস্থিত থাকবেন বিশিষ্ট লেখিকা এবং সমাজকর্মী জয়া মিত্র এবং বিশিষ্ট চিত্র পরিচালক রাজা সেন। এখানে তথ্যচিত্রও দেখানো হবে। থাকবে চিত্রকলা প্রদর্শনী, বিখ্যাত শিল্পীদের গান, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে আলাপচারিতা। এ ছাড়াও বইয়ের স্টল আর বাঙালি রসনার পরিতৃপ্তির জন্য নানা খাবার ও মিষ্টি তো আছেই।

এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, শান্তিনিকেতন আশ্রমিক অ্যাসোসিয়েশন-এর বসন্ত উত্‌সবও একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হবে এই আরবান হাটেই। পনেরোই ফেব্রুয়ারি সকাল ন’টা থেকে প্রায় ঘণ্টা দেড় দুইয়ের অনুষ্ঠান। শান্তিনিকেতনের বসন্ত উত্‌সবকেই তুলে ধরা হবে এই অনুষ্ঠানে, জানালেন সংস্থার সেক্রেটারি স্বাতী বাওড়া।

কথায় কথায় অনেক কিছু লেখা হয়ে গেল। রঞ্জিত্‌ ঝর্না কাঁসাই ইকো ফাউন্ডেশন-এর চলার পথ মসৃণ হোক, ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা করি। আপনাদের জন্য রইল ক্রিসমাস ও নতুন বছরের জন্য আগাম শুভেচ্ছা। এ বার শেষ করব একটি ঝুমুর গান দিয়ে যে গানে সুধীজন আপনারা পাবেন পুরুলিয়াবাসীর আত্মকথন—

ডুংরি পাহাড়ে ঘেরা

হামদের পুরুলিয়াটো সবার সেরা

পাত তুলি মুঠা মুঠা/বনাই ঝুড়ি ঝাঁটি

আমরা পুরুইল্যাবাসী বটি।

হামদের বাসি ভাতে পিঁয়াজকাটা/সইনঝায় খাই সারো ঘাঁটা

করম নাচে ছোয়াপোতা/মজায় মাতি গেলি

ঢোল ধামসা মাদল তালে কাঁপে ভুঁইয়ের মাটি

আমরা পুরুইল্যাবাসী বটি।

হামদের পুরুল্যাই মানভূম/ছৌ ঝুমুরে কতই ধুম

ঢোল ধামসা মাদল তালে কাঁপে ভুঁইয়ের মাটি

আমরা পুরুইল্যাবাসী বাটি।

ছবি: দেবাশিস ভাদুড়ি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE