Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

নীলগিরির নির্জন জলসাঘরে

উপত্যকা-প্রপাত-চা বাগিচা-পাহাড়-গিরিখাত এ সব নিয়েই শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো কুন্নুর। নীলগিরি পাহাড়ের কোলে ৬ হাজার ফুট উচ্চতায় নীলগিরির দ্বিতীয় জনপ্রিয় শৈলশহর কুন্নুর। উটির পরই। নীলচে পাহাড়ে সবজে পরত দেওয়া পাহাড়ি ঢাল বেয়ে কফি ও চায়ের খেত। ঘুরে এসে লিখলেন মধুছন্দা মিত্র ঘোষ। সেই যে, কোথাও না কোথাও একেকটা দারুণ মাধুর্যময় আলোকিত স্থান থাকে না? যেখানে কোনও আদি-অন্ত নেই, উত্থান-পতন নেই, ভরাট-শূন্যতা নেই— প্রকৃতিও যেন চিত্রবত্‌ থমকে থাকে সেখানেই। সেই বেবাক স্থানুতার পরিমণ্ডলে যখন পৌঁছে যাই, মন যেন আপন খেয়ালে বলে ওঠে— এখানেই তো আসতে চেয়েছিলাম। এখানেই তো আমার নিজেকে এলিয়ে রাখার একান্ত অবসর। কই, আগে তো তেমন করে বুঝিনি সে কথা। নীলগিরির জলসাঘরে দিন কয়েক কাটাব, এমন ব্যবস্থাপনা শেষে অতি উচ্ছ্বাসে ফেসবুকের স্ট্যাটাসে পোস্টও করে দিয়েছিলাম আমার এই ভ্রমণ বিলাসের নির্ঘণ্ট।

শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৪ ০১:৩১
Share: Save:

৯ জুন ২০১৪। সময় দুপুর ২.২০।
হোটেল বিবেক। ফিগার অব ৮ রোড, বেডফোর্ড, কুন্নুর, তামিলনাড়ু।

সেই যে, কোথাও না কোথাও একেকটা দারুণ মাধুর্যময় আলোকিত স্থান থাকে না? যেখানে কোনও আদি-অন্ত নেই, উত্থান-পতন নেই, ভরাট-শূন্যতা নেই— প্রকৃতিও যেন চিত্রবত্‌ থমকে থাকে সেখানেই। সেই বেবাক স্থানুতার পরিমণ্ডলে যখন পৌঁছে যাই, মন যেন আপন খেয়ালে বলে ওঠে— এখানেই তো আসতে চেয়েছিলাম। এখানেই তো আমার নিজেকে এলিয়ে রাখার একান্ত অবসর। কই, আগে তো তেমন করে বুঝিনি সে কথা।

নীলগিরির জলসাঘরে দিন কয়েক কাটাব, এমন ব্যবস্থাপনা শেষে অতি উচ্ছ্বাসে ফেসবুকের স্ট্যাটাসে পোস্টও করে দিয়েছিলাম আমার এই ভ্রমণ বিলাসের নির্ঘণ্ট। ব্যস, ওমনিই বন্ধু-পরিচিতদের অযাচিত মন্তব্যের হিড়িক— ‘এখন তো কেরলে বর্ষা ঢুকে গেছে। এমন সময় বৃষ্টি মাথায় করে দাক্ষিণাত্য বেড়াতে চললে? ‘অমুক সময়ে পাহাড়ে না যেয়ে তমুক সময়ে গেলে পারতে’। বেশিটাই নঞর্থক মন্তব্য।। আমিও ফেসবুকে আবার পাল্টা লিখে দিলাম, রিমঝিম বৃষ্টিদিনে নীলগিরি যখন ভিজতে থাকবে তখনই তো নীলগিরির রূপ আরও খোলতাই হবে।’ এ সব দেখেশুনে এ দিকে ঘরের মানুষটি মৃদু টিপ্পনী কাটে। সব কথা ফেসবুকে শেয়ার করার আদিখ্যেতা তার পছন্দ নয় মোটেই।

আজ সকালে মুম্বই-কোয়েম্বাত্তুর এক্সপ্রেসে দুই রাত এক দিনের রেল-যাত্রা শেষে কোয়েম্বাটুর এসে পৌঁছেছি। মুম্বই থেকেই ‘কোয়েম্বাটুর কার রেন্টাল অ্যাসোসিয়েশন’-এ অনলাইন বুকিং করা ছিল। স্টেশনের বাইরে আসতেই আমাদের আগামী কয়েকটা দিনের গাড়ির সারথী সতীশ মুরুগন কাছে এসে অভ্যর্থনা জানালেন।

কোয়েম্বাত্তুর তামিলনাড়ু রাজ্যের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক শহর। নয়্যাল নামে নদীর ধারের এই শহরটিকে বলা হয় ‘ম্যাঞ্চেস্টার অফ সাউথ’। কখনও বা ‘দ্য টেক্সটাইল ক্যাপিটাল’ বলা হয়। শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহাসিক শহরটিতে রাজ্যপাট সামলে এসেছেন চোল, রাষ্ট্রকুট, চালুক্য, পাণ্ডয়া, হোসলে ইত্যাদি বংশ। প্রাচীন সেই সময়ে এই অঞ্চলটির নাম ছিল কোঙ্গুন্দ, আরও পরে ব্রিটিশ জমানায় ছোট্ট এই রাজ্যটির নাম হয় কোয়েম্বাত্তুুর।

প্রাতরাশের জন্য সুন্দরাপুরম অঞ্চলে পোল্লাচি রোডের ধারে ‘শ্রীঅনধাস ভেজ রেস্তোরাঁ’য় বসলাম। এখানে তখন ‘ব্রেকফাস্ট টাইম মিনি টিফিন’-এর কার্ড লাগানো প্রতিটি টেবিলে। তাই অর্ডার দেওয়া হল। রেস্তোরাঁর বেয়ারা এসে সাজিয়ে দিল টেবিলে সাত রকম দক্ষিণ ভারতীয় খাদ্যসামগ্রী। ইডলি ১ পিস, মিনি পুরি ১ পিস, আরা ১ পিস, সম্বর বড়া, ভাজহইথান্ডু পোঙ্গল, মিনি উত্তপম। সঙ্গে ছোট্ট ছোট্ট স্টিলের বাটিতে সবজি, সম্বর, নারকেল রাই সরষেবাটার চাটনি। শেষ পাতে স্টিলের বাটিতে গেলাস উপুড় করা ফিল্টার কফি।

কোয়েম্বাত্তুর থেকে কুথুরের দূরত্ব মাত্র ৬৭ কিলোমিটার। সময় লাগে পৌঁছতে দেড় ঘণ্টা মতো। কোয়েম্বাত্তুর থেকে ২০৯ জাতীয় সড়ক ধরে প্রকৃতির সঙ্গে আলাপ জমিয়ে চলেছি। পথের ধারে কৃষ্ণচূড়া গাছেরা উজ্জ্বল লাল-কমলা ফুলে ফুলে ছয়লাপ। জুন মাসের সময়টায় এই প্রাচুর্যটা বেশ নিবিড় থাকে। গাছগাছালির পাতা গলে তির্যক রোদের ঝিলিক।

কিছুটা যেতেই এ বার ডান দিকে ঘুরে ৬৭ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরল আমাদের মারুতি স্যুইফ্ট। ক্রমশ থুড্ডিইয়ালুর জনপদ পেরিয়ে আরও কিছুটা পথ সাঁতরে থেক্কুপাল্লায়াম নামের ব্যস্ত এক এলাকা। আরও যাওয়ার পর কারমাদাই ছাড়িয়ে মেট্টুপাল্লায়াম। ভবানী নদী পেরিয়ে একটা ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলেছি অনেকটা পথ। ‘তামিলনাড়ু ফরেস্ট এরিয়া’ নামের সেই জঙ্গল চেরা মসৃণ পথের মাঝেমধ্যেই বোর্ডে লেখা, ‘ওয়াইল্ড অ্যানিম্যাল ক্রশিং জোন’। হাতি, হরিণ, বাইসনের ছবি আঁকা ক্রশিং জোনের বোর্ডগুলি। ফরেস্ট কলেজ অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট পার করে সমতলে মসৃণ সড়ক পথ চলল আরও কিছুক্ষণ। তারপরই হঠাত্‌ই শুরু হয়ে গেল ঘাট রোড বা পাহাড়ি পথ চলা। জঙ্গলের ঘন বেষ্টনী আড়াল হল।

অপূর্ব পাহাড়ি পথের দু’পাশে কখনও পাইন-ফার্ন-ইউক্যালিপ্টাসের ঘন বনানী তো কখনও অনন্ত চা বাগান। কবিতার মতো সুন্দর উপত্যকা। নীলগিরির চা বাগিচায় ঢেউ খেলানো পাহাড়। কেমন যেন খেই হারিয়ে যায় গাড়ির জানলার ওপারের দূরন্ত সৌন্দর্যের কাছে। ভ্রমণ ম্যাগাজিনের পাতায় তো এমনটাই কত বার দেখেছি। সেই দৃশ্যপট এখন আমারই চোখের সামনে। ভ্রমণলিপি এক টানে খুলে ফেলতেই টুকরো আলোয় কেমন অন্য রকম হয়ে ওঠে। নীলগিরির সবজে আতিথেয়তায় এখন তছনছ হয়ে যাচ্ছে ভ্রমণরসিক ভাবুক মন।

৯ জুন ২০১৪ রাত ১০.২৫ হোটেল বিবেক

নীলগিরি পাহাড়ের কোলে ৬ হাজার ফুট উচ্চতায় নীলগিরির দ্বিতীয় জনপ্রিয় শৈলশহর কুন্নুর। উটির পরই। নীলচে পাহাড়ে সবজে পরত দেওয়া পাহাড়ি ঢাল বেয়ে কফি ও চায়ের খেত। প্রকৃতির কারুকাজে অনাবিল উপত্যকাভূমের এক জমাট চিত্র। সিলভার-ওক-ফার্ন-ইউক্যালিপটাস-পাইনে ছাওয়া কুন্নুর শহরটা আপার কুন্নুর ও লোয়ার কুন্নুর দু’অংশে বিভক্ত। অনেকটা সিকিমের লোয়ার আর আপার পেলিঙের মতো। আজ বিকেলটা রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, ক্লকটাওয়ার, বাজার নিয়ে লোয়ার কুন্নুরটাই ঘুরলাম। ঢলে পড়ছে বিকেলের আঁচ। বিকেল যত গড়ায় আষাঢ়ের অনুভূতি গাঢ় হয়।

ম্যাগনোলিয়া, পাম ও ফার্ন-এর সবুজময়তায় মাখা বেডফোর্ড ফিগার অফ ৮ রোডের ওপর হোটেল বিবেক। আমাদের দু’রাত তিন দিনের বিশ্রামের ঠেক। মাস দুই আগে থাকতেই অনলাইন বুকিং করা ছিল। এখানকার পিক সিজন হল এপ্রিল-মে-জুন। কুন্নুর শৈলশহরে এই তিন মাস পর্যটক সমাগম বেশি থাকে। যদিও সারা বছরই অপরূপ আবহাওয়ার জন্য পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে কুন্নুর শৈলশহরে।

ফিরতি পথে লোয়ার কুন্নুর এলাকার বাজারে একটা সুদৃশ্য ‘হোম মেড চকোলেটের’ দোকান থেকে ‘হোল নাট চকোলেট’ ও ‘মারস মেলো চকোলেট’ কিনলাম, কিছু বাড়ির জন্য, কিছু ওই যারা ‘না’ বলেছিল, তাদের জন্য। থরে থরে সাজানো নানান ধরনের চকোলেটের লোভনীয় হাতছানি। উপেক্ষা করার মতো কঠোর মনের জোর নেই মোটেই। উটি-কুন্নুর এ সব অঞ্চলে ‘হোম মেড চকোলেটের’ বিজ্ঞাপনি ইস্তাহার প্রায় প্রতিটি দোকানেই।

হোটেলের কাছে এসেও তক্ষুনি হোটেলের ঘরে ফিরতে ইচ্ছে হল না। পথের পাশেই একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁর উঁচু স্টিলের চেয়ারে বসে ধূমায়িত হট চকোলেটের গ্লাসে আয়েশি চুমুক দিতে দিতে নীলগিরিকে নিয়ে আস্ত কবিতা লিখে ফেলি—

“সেই তো আবার ছুঁয়ে ফেলি

নীলগিরির ঠিকানা

সমস্তটাই প্রাতিভাষিক!

এই যেমন,

পাহাড়ের পর পাহাড় ঘিরে আনমনা

ওই সবুজ জেল্লা

সমতলের রোদ্দুর প্রবণতা ভুলে

শীত শীত অবেলা দিঘল হল

আকাশ নেমে আসছে সহসা

পলকে হারিয়ে যাচ্ছে নীলগিরি

অলীক এক মেঘ চাদরে

ঢেকে যাচ্ছে সবুজ

ঢেকে যাচ্ছে নীল

চা বাগিচার গোপন পেলবতায়

ডুব দিচ্ছে চুপিসার

সবুজ মসৃণতায়...

রাতের কুন্নুর। হোটেলের জানলা থেকে শহরটার এক চিলতে অংশ মাত্র দেখা যাচ্ছে। দূরান্তে চা বাগিচাগুলোর গায়ে ঝুপ্পুস অন্ধকার। হোটেলের ২ রাত ৩ দিনের নির্ধারিত প্যাকেজে এক রাতের নৈশাহার হোটেল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে ‘সৌজন্যমূলক’। বেশ একটা শীতার্ত অনুভূতি ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। বিছানার নরম কম্বলে ডুবে কফি পর্ব মিটিয়ে আগামী দিনের কুন্নুর সাইট সিয়িংয়ের সফরসূচি নিয়ে সামান্য আলোচনাও সেরে নিচ্ছি।

১০ জুন ২০১৪ সন্ধে ৭.৩৫ হোটেল বিবেক

উপত্যকা-প্রপাত-চা বাগিচা-পাহাড়-গিরিখাত এ সব নিয়েই শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো কুন্নুর। পথচলতি স্থানীয় ‘হারগা সম্প্রদায়’-এর লোকজন দেখতে পাচ্ছি! সতীশ জানালেন, উটি-কুন্নুর এই অঞ্চলে মূলত ‘বারগা’ সম্প্রদায়ের বসবাস। বারগা সম্প্রদায়ের মহিলাদের পরনে সাদা রঙা বোরখার মতো ঢাকা পোশাক।

আমাদের গাড়ি কিছুটা চড়াই পথ ধরল। কুন্নুর শহরের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি আপার কুন্নুর এলাকায়। এখানকার বিখ্যাত সিমস পার্ক কুন্নুর রেলওয়ে স্টেশনের সামান্য দূরেই। ১৭৬৮-১৭৯৪ মিটার উচ্চতা পরিসরে সিমস পার্কটি কুন্নুরের অহঙ্কার। মাদ্রাজ ক্লাবের তদানীন্তন সচিব জে ডি সিমসের তত্ত্বাবধানে ১৮৭৪-৭৫ সাল নাগাদ পার্কটি নির্মিত হয়। পাহাড়ি ঢাল বরাবর প্রায় ১২ হেক্টর ক্ষেত্রটিতে ১০০-এর বেশি প্রজাতির গাছগাছালির সংগ্রহ। পাহাড়ি অঞ্চলের উপযোগী গাছগুলি ছাড়াও রয়েছে ইলাইয়োকার্পাস অর্থাত্‌ রুদ্রাক্ষ গাছ। সিমস পার্কের ভেতর শিশু উপযোগী বিভিন্ন রাইডস, দোলনা কত কিছু। ছুটি ছাটার দিনে স্থানীয়রা ভিড় জমান পার্কে। আর বাইরের পর্যটকরা তো আছেনই। পুরো পার্কটা ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে সময় লেগে যাচ্ছে বেশ।

আষাঢ়ের ছায়াঘন আকাশ, কিন্তু এখনও বৃষ্টি নেই। ভাগ্যিস। মে মাসে সিমস পার্কে, তামিলনাড়ু সরকারের উদ্যোগে এখানে ফল ও বনস্পতি মেলা উদযাপিত হয়। কুন্নুর সিল্ক ফার্ম, পাস্তুর ইন্সটিটিউট, ফল কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্র ইত্যাদিও কাছে পিঠেই। শেষোক্ত অর্থাত্‌ রাজ্য কৃষি বিভাগের এই পোমোলোজিক্যাল স্টেশনে আপেল, প্লাম, পিচ, খোবানি, ডালিম, আনার, লেবু ইত্যাদি চাষ হয় ও টাটকা জ্যাম ও জেলিও প্রস্তুত ও বিক্রয় করা হয়।

সিমস পার্ক থেকে ১.৫ কিলোমিটার দূরত্বে কুন্নুর কোটাগিরি রাস্তার ওপরই টি ডেমনস্ট্রেশন ও টি ফ্যাক্টরিও অবশ্য দ্রষ্টব্য। এখানে ছবির মাধ্যমে তো বটেই এবং চা শিল্প পদ্ধতির নানান যন্ত্রপাতির সাহায্যে পর্যটকদের চোখের সামনেই সমস্ত প্রক্রিয়াকরণটি দেখানো ও পেশাদার প্রদর্শক দ্বারা বোঝানো হয়।

কুন্নুর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে নিশ্ছিদ্র জঙ্গল পথ ধরে ডলফিন নোজ। অসাধারণ দৃশ্য চোখের সামনে। ডলফিনের নাক সদৃশ্য বলে পাহাড়টার নামটাই এ রকম। এখানে কাঠের ভিউ পয়েন্ট থেকেই দেখা যাচ্ছে সামনে পাহাড়ে এক নিঃসীম বেগবতী জলপ্রপাত। সেন্ট ক্যাথেরিন ফলস। পাহাড়ের খাঁজে খন্দে মেঘের জটলা। কখনও কুয়াশা তো কখনও মেঘের ফাঁক গলে রোদ্দুরের আভা। সারি দেওয়া কিছু দোকানে সুগন্ধী চা, মকাই দানা সেদ্ধ। বাদাম সেদ্ধ, স্থানীয় নানান ধরনের অচেনা ফল, ইডলি, সম্বর বড়া, চিপস, কোল্ড ড্রিংকসের দোকান।

এলাকাটায় প্রচুর বাঁদরের উত্‌পাত। অসতর্ক মুহূর্তে ছোঁ মেরে হাতের খাবার কেড়ে নেয়। ফিরতি পথে সেই জঙ্গল ছাওয়া ওয়ান ওয়ে দিয়েই ফেরার পথে ল্যাম্বস রকে এলাম। হু হু হিমেল হাওয়ার দাপট। যদিও উপযুক্ত শীতপোশাক রয়েছে পরণে। কুন্নুরে এমনিতেই ঠান্ডা পড়ে জব্বর। শীতে এখানে ১ডিগ্রি-২১ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, এবং গ্রীষ্মে ১ ডিগ্রি-২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পারদের ওঠানামা চলে। ক্যাপ্টেন ল্যাম্ব, যাঁর ব্যবস্থাপনায় এই সুন্দর স্থলটি নির্মিত। এখান থেকে পাহাড়ি উপত্যকার ঢালে নীলগিরি চা-কফি বাগান দৃশ্যপট। দূরে নীচে কোয়েম্বাত্তুর শহরতলিরও একটা ছবির মতো দৃশ্যাবলি। মনের আনাচকানাচ একটু একটু করে ফুটে ওঠা যেন সে সব রমণীয় দ্রষ্টব্যে।

খানিক দূরেই ‘লেডি ক্যানিং সিট’। এখান থেকে মখমলের মতো সবুজ গালিচা বিছানো চা খেত শুধু দেখে যাওয়া। আর ক্যামেরার লেন্সের সঙ্গে মনের কোটরেও টুকে রাখা সযত্নে। আরও দুটি প্রপাত আছে কুন্নুরে। কাটেরি ফলস ও ল ফলস। কাটেরি জলাধারের অতিরিক্ত জলধারা পাহাড়ের খাঁজে ধাক্কা খেয়ে মহা উচ্ছ্বাসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নীচে। এটি নীলগিরি পাহাড়শ্রেণির সব থেকে উঁচু প্রপাত। ল প্রপাতটিও একটি মনোরম পিকনিক স্পট। ১৮০ ফুট উচ্চতা থেকে পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে সবেগে নীচে আছড়ে পড়ছে প্রপাতটি। এই সব উদ্দাম প্রপাতগুলির সামনে প্রকৃতির বৈচিত্রের কাছে গাঢ় হয়ে আসে হৃদয়।

ইতিহাসের পাতা ছোঁয়া পাক্কাসুরমালাই অঞ্চলটি টিপু সুলতানের দুর্গ ছিল একটা সময়ে। স্থানটি দ্রুগ নামেও খ্যাত। ৬০০০ ফুট উচ্চতায় দুর্গটির ধ্বংসাবশেষ ইতিহাসের স্বাক্ষর হয়ে আছে।

মেঘ-রোদ্দুরের পালাবদল থেকে থেকেই লক্ষ করছি। মেঘেরা নেমে এসেছে, ভিজিয়ে দিচ্ছে শরীর। মেঘের সংস্পর্শে কীই এক জাদু। এমন সব পাহাড়ি এলাকা এলেই মেঘবালিকাদের স্পর্শ আদর পাওয়া যায়। সেই মেঘ সংস্পর্শের স্মৃতি থেকে যায় মনে, অনেক কাল পর্যন্ত। হিমেল শিরশিরানি টের পাচ্ছি। গায়ে শীতপোশাকের ওমটা বেশ স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিচ্ছে। উলেন স্কার্ফটা আরও একটু মাথায় জড়িয়ে নিই।

দুপুর নাগাদ হোটেলে ফিরে মধ্যাহ্ন আহার সেরে নিলাম। দক্ষিণী থালিতে হরেক২ রকম পদ ছিল। খাবারগুলো খেলাম বটে কিন্তু অর্ধেক খাদ্যবস্তুর সঠিক নামটাও কিন্তু জানা হল না। তবে প্রতিটি খাবারের মান বেশ উন্নত। মধ্যাহ্নভোজন শেষে হোটেলের ঘরের নরম বিছানাতে একটু গড়াতে ইচ্ছে যে করছিল না, তা নয়। কিন্তু বেড়াতে এসে দুপুরের ভাতঘুমকে প্রশ্রয় দিতে রাজি নই মোটেই। সূর্যি সামান্য হেলে পড়লেই না হবে মনের সুখে ভাল ছবি তোলা, না হবে প্রকৃতিকে তেমন ভাবে দেখা।

উটির দিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেই পথ বরাবর কিছুটা যেতেই ওয়েলিংটন নামের ভারি সুন্দর একটা জায়গা ১৮৫২ সালে সৃষ্ট ব্রিটিশ ক্যান্টনমেন্ট চেন্নাই রেজিমেন্টের সদর দফতর হল এই ওয়েলিংটন নামের মনোরম স্থানটি। এই মিলিটারি ছাউনিতে ইন্ডিয়ান আর্মি রেজিমেন্ট, ডিফেন্স স্টাফ কলেজ, বোর্ডিং স্কুল রয়েছে। ওয়েলিংটন ছাউনি চত্বরে ভারতের বিভিন্ন ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতির মিশ্রণ হয়েছে, কারণ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এই সেনাবাহিনী প্রশিক্ষণ শিবিরে একসঙ্গে রয়েছেন।

১১ জুন ২০১৪ সকাল ১১টা ৫ হোটেল বিবেক

আজ সকালটা কুন্নুরে কাটিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সেরে আমরা উটি (উধাগামণ্ডলম) চলে যাব। ওখানেও নীলগিরির সান্নিধ্যে কাটাব তিনটে রাতদিন। উধাগামণ্ডলম নিয়েও পর্যটন আখ্যান শোনাব আগামীতে। পরমা প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় আলাপচারিতায় কেটে যাচ্ছে দুই রাত তিন দিনের এই সুহানা সফর।

নীলগিরির চা-শিল্পের জন্যও বিখ্যাত কুন্নুর। ১৮৫৩ সালে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নীলগিরির চা উত্‌পাদন শুরু হলেও দেশবিদেশে নীলগিরির চায়ের আভিজাত্য বর্ণনাতীত। এই চা শিল্প মূলত ‘পিকড-প্রসেস-প্যাকেজ’-এর মাধ্যমে স্থানীয় চা কারখানাগুলিতে প্রস্তুতপর্ব শেষে বাজারে রফতানি করা হয়। চমত্‌কার স্বাদ, সুগন্ধ, সুরভিত ও গাঢ় নীলগিরি পাহাড়ের চা। বাগিচা থেকে চা-পাতা তুলে সিটিসি পদ্ধতিতে অর্থাত্‌ ‘ক্রাশ-টিয়ার-কার্ল’ প্রক্রিয়ায় পুরো ব্যাপারটি প্রস্তুত হয়। নীলগিরির চা ভেষজ এবং নানান সুগন্ধ ও রঙেও পাওয়া যায়। গ্রিন টি, চকোলেট টি, লেমন টি, জিঞ্জার টি, মশলা টি, হোয়াইট টি, এলাচি টি, অরেঞ্জ টি, হার্বাল টি, হানি টি ইত্যাদি হরেক রকম রং-রূপ-স্বাদে বিক্রি হচ্ছে এখানকার দোকানপাটে। নীলগিরি চা কুন্নুর, কোয়েম্বাত্তুর ও কোচি শহরের বিভিন্ন কারখানায় নিলাম হয়। নিজের পরিবার ও প্রিয়জনদের জন্য নীলগিরি-খ্যাত বিভিন্ন স্বাদের চা ‘স্মারক’ হিসাবে কেনা হল। তবে উত্তরবঙ্গে চা-বাগিচার সঙ্গে দাক্ষিণাত্যের নীলগিরির চা-বাগিচার প্রভেদও আছে খানিক।

তামিলনাড়ুর গর্ব নীলগিরির মাউন্টেন রেলওয়ে। ৪৬ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথটি ১৯০৮ সালে ব্রিটিশ সরকার মাদ্রাজ রেলওয়ের অধীনে তৈরি করেছিলেন। সমতলে মেট্টু পাল্লায়াম শহর থেকে পাহাড় বেয়ে ন্যারো গেজ পথে কুন্নুর পর্যন্ত। পরে এটিকে ১৭ কিমি দূরে উটির সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ভাল লাগা স্টেশন হিলগ্রোভ, রানিমেড, ওয়েলিংটন, ফেট্টি, লাভাডেল। যেন এক স্বপ্নের রেল-যাত্রা। নীলগিরির রেলপথে পার হতে হয় ২৫০টি ব্রিজ, ১৬টি টানেল, ২০৮ টি বাঁক। এশিয়ার অন্যতম খাড়াই এই রেলপথটি রোমাঞ্চ-পাহাড়-প্রকৃতিতে ঠাসা।

সাধে কী আর ২০০৫ সালের জুলাইয়ে UNESCO নীলগিরি পাহাড়ি রেলপথটিকে ‘বিশ্ব বিরাসত স্থল’ তথা সহজ ইংরাজিতে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ তকমা দিয়েছে। তবে এত কথা লিখলাম বটে, আমার কিন্তু স্টিম ইঞ্জিন চালিত এই খেলনা গাড়িতে কু কু ঝিক ঝিক করে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নেওয়া হল না, এই টয় ট্রেনের সময় সারণীর সঙ্গে আমাদের নিজস্ব যাওয়া আসার সময় ও পরিকল্পনার সঙ্গে মিলমিশ না হওয়ায়। ‘হেরিটেজ রেলযাত্রার’ শরিক হওয়ার অভিজ্ঞতার অভাববোধ রয়ে গেল।

এক সফরে, মানে এক জীবনে, সব কী পাওয়া যায়!

কেমন এক মায়া পড়ে যায় দক্ষিণের ছোট্ট এই শৈলশহরটির উপর। ছায়াচ্ছন্ন নিরালা পাহাড়ি পথের ধারে ব্রিটিশ আমলের অনেক দৃষ্টিনন্দন বাংলো বাড়ি, হাল আমলের নানান সংস্থার, ব্যাঙ্ক ইত্যাদির সুদৃশ্য হলিডে হোম, সুন্দর দেখতে কটেজ, সুদৃশ্য হোম স্টে রয়েছে। মেঘ উড়ে এসে গায়ে পরশ মাখিয়ে ফিরে যায়। কখনও জলতরঙ্গ মাখা প্রপাত। সদ্য সদ্য লেখা কবিতার মতোই উপভোগ্য। মেঘের জলছবি ঘেরাটোপে নীল ও সবুজ মেশা সীমাহীন ঢেউয়ের মতো পর্বতমালা— ওই নীলগিরি। অন্য দিকে হাট হয়ে বিস্তীর্ণ উপত্যকা দৃশ্য। সারি সারি হোম মেড চকোলেটের লোভনীয় হাতছানি ও বিখ্যাত নীলগিরি চায়ের দোকান। পাহাড়ের মৃদু ঢাল বেয়ে শুধুই সবুজের আশ্বাস।

নীলগিরি পাহাড়ের একটা অংশে প্রাচীন বাসিন্দা টোডো উপজাতিদের বাস। এদের কুটিরগুলোর গঠনরীতিও একটু অভিনব। স্রেফ পাখি দেখতে অনেকে নীলগিরি পাহাড়ে আসেন মহার্ঘ টেলিলেন্স ক্যামেরা, ট্রাই পড, বাইনাকুলার এ সব লটবহর নিয়ে। এখানে নীলগিরি ভার্ডিটার ফ্লাইক্যাচার, স্পটেড ফ্যানটেল, অরেঞ্জ মিনিভেট, মালাবার লার্ক, লং টেল শ্রাইক, স্প্যারোলার্ক, হোয়াইট বেলি উডপেকার, জ্যাকোবিন কাক্কু, নীলগিরি লাফিং থ্রাশ— অর্ধেক নাম শোনা অর্ধেক নাম না শোনা পাখিদের মুক্তাঞ্চল। পাখি-প্রেমীদের কাছে ঈপ্সিত পাখিটির দেখা পাওয়া, লেন্স বন্দি করার মোক্ষম পছন্দের জায়গা কুন্নুর নীলগিরির কাছেই মধুমালাই জঙ্গল। এই কুন্নুর-উটি সমস্ত অঞ্চলটা চলচ্চিত্রকারদেরও ভারি পছন্দের জায়গা। নিয়মিত দক্ষিণী ও বলিউড ফিল্মের শুটিং চলে এখানকার নয়নাভিরাম প্রেক্ষাপটের জন্য। নীলগিরি কড়া নাড়বে মনের দরজায়। নাড়তেই থাকবে। এখনও বেশ কিছুকাল থাকবে যে কড়া নাড়া...।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

madhuchanda mitra ghosh nilgiri
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE