Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বারাণসীর তারার ভিড়ে সিপিএম, তৃণমূল

রাস্তায় ঘুরলে প্রায়শই ভুল হয় কোথায় রয়েছি! পশ্চিমবঙ্গে নাকি হিন্দি বলয়ের হৃদয় বারাণসীতে? রাস্তায় পুণ্যলোভাতুরদের বড় অংশই বাঙালি। খাবারের দোকান থেকে ধর্মশালা পসরা সাজানো বাঙালি পর্যটকদের কথা ভেবেই। এবং তাঁরা আছেনও।

প্রেমাংশু চৌধুরী ও অনমিত্র সেনগুপ্ত
নয়াদিল্লি ও বারাণসী শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৪ ০৩:১২
Share: Save:

রাস্তায় ঘুরলে প্রায়শই ভুল হয় কোথায় রয়েছি! পশ্চিমবঙ্গে নাকি হিন্দি বলয়ের হৃদয় বারাণসীতে?

রাস্তায় পুণ্যলোভাতুরদের বড় অংশই বাঙালি। খাবারের দোকান থেকে ধর্মশালা পসরা সাজানো বাঙালি পর্যটকদের কথা ভেবেই। এবং তাঁরা আছেনও।

আর আছে সিপিএম বনাম তৃণমূল! কাশী-বিশ্বনাথের শহরে ভোট যুদ্ধে রয়েছে এই দুই পক্ষও। বিজেপির নরেন্দ্র মোদী, আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরীবাল, কংগ্রেস (এখনও নামই ঠিক করে উঠতে পারেনি!)-এর মহাতারকা প্রার্থীদের সঙ্গে লড়াইয়ে আছেন সিপিএম ও তৃণমূলের প্রার্থীও। আর এখানেও জোর লড়াই দু’পক্ষের। অন্তত খাতায়-কলমে তো বটেই।

পশ্চিমবঙ্গে যুযুধান দুই দল উত্তরপ্রদেশের গঙ্গার তিরেও একে অপরের বিরুদ্ধে হাতিয়ারে শান দিচ্ছে। সিপিএম প্রার্থী হীরালাল যাদব যখন বলছেন, “বারাণসীর রাজনৈতিক মহলে তৃণমূলের প্রার্থী ইন্দিরা তিওয়ারির নামই কেউ শোনেনি।” তখন সিপিএম প্রার্থীর নাম শুনে ইন্দিরা বলছেন, “সিপিএম এখানে আছে না কি? খুব ভাল কথা। বারাণসীর গঙ্গায় স্নান করলে ওদের সব পাপ ধুয়ে যাবে!”

বারাণসীর বুকেও দু’দলের তরজা শুনে গোধুলিয়ার মোড়ের বাঙালি খাবারের দোকানে বসে রীতিমতো অবাক ব্যারাকপুরের বাসিন্দা বিধান দত্ত। বাংলা থেকে এত দূরে এসেও দু’দলের তরজার কথা শুনে বললেন, “এখানেও! এখানে তো খালি দেখছি কেজরীবাল আর মোদী। আর কেউ আছে নাকি?” আছে মানে! বারাণসী কেন্দ্র থেকে বিজেপি নরেন্দ্র মোদীর নাম ঘোষণা করার আগেই সেখানে সিপিএম নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করে দিয়েছিল। বিশ্বনাথ মন্দিরের মূল গলি দিয়ে বেরোতেই সিপিএমের পার্টি অফিস। ছোট্ট সিঁড়ি। ঘুপচি অন্ধকার ভেদ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই দো’তলায় অর্ধশতকের পুরনো সিপিএমের পার্টি অফিস। দফতরে ঢুকেই দেখা হয়ে গেল হীরালাল যাদবের সঙ্গে।

উত্তরপ্রদেশের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা বারাণসী জেলা কমিটির সম্পাদক। গত ৩০ বছর ধরে পার্টির হোল-টাইমার। ২০০৪-এর লোকসভা ভোটেও লড়েছিলেন। কিন্তু হালে পানে পাননি। যদিও এ বার মোদীর নাম ঘোষণার পর প্রকাশ কারাট জানান, তিনি নিজে হীরালালের হয়ে বারাণসীতে প্রচারে যাবেন। কিন্তু যেখানে মোদী বনাম কেজরীবালের লড়াই, সেখানে সিপিএমের ঝুলিতে কতগুলো ভোট পড়বে? ভরসা দিতে পারছেন না দলীয় কর্মীরাই।

তবুও লড়াইয়ে আছেন তিনি। দলীয় নেতৃত্বের বক্তব্য, “লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।” হীরালালের ভরসা বেনারসি শাড়ি ও জমি অধিগ্রহণ নিয়ে টানা সরব থাকা। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বামেদের বিরুদ্ধে সাফল্য পেয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখানে সেই মডেলই হাতিয়ার সিপিএমের।

হীরালালের ব্যাখ্যা, “আমাকে মানুষ চেনেন আন্দোলনের জন্য। বারাণসী সংলগ্ন ১২-১৩টি গ্রামের উর্বর জমি অধিগ্রহণ করে আবাসন প্রকল্প হচ্ছিল। ওই জমিতে বছরের ১০ থেকে ১২ মাস ফসল হত। আমাদের আন্দোলনেই গত পাঁচ বছর ধরে প্রকল্প আটকে।”

একই সঙ্গে সিপিএমের বড় ভরসা স্থানীয় বুনকরেরা। বারাণসীতে প্রায় ৫ লক্ষ তাঁতি রয়েছেন, যাঁরা বেনারসি শাড়ি বোনেন। সংখ্যালঘু সমাজের ওই মানুষেরা ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন সিন্থেটিক বেনারসি শাড়ির আগ্রাসনে। এই সব তাঁত শিল্পীদের হয়েই দীর্ঘদিন ধরে লড়ছেন সিপিএম নেতা মোবিন আহমেদ। তাঁর বক্তব্য, “জানেন, এখন কোথা থেকে সিন্থেটিক বেনারসি আসে? গুজরাত। তার ফলে বহু শিল্পী অনাহারে ভুগে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। পেশা ছেড়ে মজদুরি বা হকারি করছেন। এখন সেই গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী এখানে প্রার্থী!”

সিপিএম এখন বারাণসীর ভোটারদের কাছে প্রচারে তুলে ধরতে চাইছে যে, মোদী জিতলে তাঁতিদের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। হীরালালের কথায়, “আমরাই তাঁদের সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করেছি। তাঁদের জন্য সচিত্র পরিচয়পত্র তৈরি করে দিয়েছি, রেশনের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। বাকিরা তো শুধু জাত-ধর্মের ভিত্তিতেই ভোট জেতার চেষ্টা করছেন। আমরা কিন্তু জমির সঙ্গে জুড়ে আছি, মানুষের সঙ্গে রয়েছি।” পার্টি অফিসে বসা স্থানীয় বাঙালি প্রভাসকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের তির্যক মন্তব্য, “তৃণমূল! কোথায় এখানে? গত বিধানসভার আগে শম্ভুনাথ বাঁটুল বলে এক জন হঠাৎ তৃণমূলের প্রতীক নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। অষ্টম হলেন। এখন আর তাঁর কোনও পাত্তাই নেই! এ বার ইন্দিরা তিওয়ারি!”

সিপিএমের এই মাটি ও মানুষের সঙ্গে জুড়ে থাকার দাবি এক কথায় উড়িয়ে দিয়েছেন ইন্দিরা তিওয়ারি। প্রয়াত কংগ্রেস নেতা কমলাপতি ত্রিপাঠীর নাতনি ইন্দিরার বক্তব্য, “সিপিএম এখানে রয়েছে, তারা প্রার্থী দিয়েছে বলেই প্রথম শুনলাম! ওঁর নামও আগে কখনও শুনিনি। কে উনি?” যা শুনে হীরারাল বলছেন, “ইন্দিরার নাম প্রথম বার শুনছি। রাজনৈতিক মহলে কেউ ওঁর নামই শোনেননি। শুনলাম, আগে জনসঙ্ঘের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।”

বারাণসীর স্থানীয় বাসিন্দা প্রাক্তন ব্যাঙ্ক কর্মী সুরজিৎ সেনগুপ্তের ব্যাখ্যা, “ইন্দিরা তিওয়ারি লড়ছেন বলে তো শুনেছি। কিন্তু তিনি তো মরসুমি পাখি! এত দিন তো জানতাম উনি হিন্দু মহাসভায় ছিলেন। কবে তৃণমূলে গেলেন, তাই তো জানতে পারলাম না!” সিপিএম তা-ও দলীয়-কর্মীদের নিয়ে বারাণসীর অলি-গলিতে পোস্টার-ব্যানার লাগাতে শুরু করেছে। কিন্তু তৃণমূল কোথায়? প্রথম রাউন্ডে তারা অন্তত এই লড়াইয়ে পিছিয়ে রয়েছে। তৃণমূলের বক্তব্য, এখানে ভোট ১২ মে। এখনও দেড় মাসের বেশি সময় রয়েছে।

সিপিএম ও তৃণমূল, দুই দলেরই প্রার্থী জানেন, বারাণসীতে মানুষের নজর থাকবে নরেন্দ্র মোদীর উপরে। তার উপরে নির্বাচনী ময়দানে নেমেছেন অরবিন্দ কেজরীবালও। বিজেপির দাবি, কেজরীবাল যতই দাঁড়ান, মোদীর জয় নিশ্চিত। যদিও বিজেপির ওই দাবি মানতে রাজি নন সিপিএম ও তৃণমূলের প্রার্থীরা। হীরালাল বলছেন, “মানুষ এখনও মনস্থির করেননি। মুরলীমনোহর জোশীর আমলেও এখানে উন্নয়ন হয়নি। যে গঙ্গার জন্য বারাণসী এত বিখ্যাত, সেই গঙ্গায় চড়া পড়ে যাচ্ছে। এখন জোশীর বদলে মোদী প্রার্থী হচ্ছেন। সত্যিই প্রধানমন্ত্রী হলে মানুষ তাঁকে কোথায় খুঁজতে যাবে?”

ইন্দিরা বলছেন, “সিপিএম হোক বা মোদী বারাণসীর গঙ্গায় ডুব দিলে সকলের পাপই ধুয়ে যাবে।” কেজরীবালকে নিয়ে হীরালালের যুক্তি, “দিল্লি আর বারাণসী আলাদা। কেজরিওয়াল এখানে বাইরে থেকে আসছেন। আম আদমি পার্টির এখানে কোনও সাংগঠনিক শক্তি নেই।” আর ইন্দিরার প্রশ্ন, “কেজরীবাল দিল্লিতে সরকার তবে একটা জায়গায় দু’জনেই এক। দু’জনেরই প্রচারের মুখ উন্নয়ন। প্রশ্ন, এই অস্ত্রে কি হেভিওয়েটদের বিন্দুমাত্র আঁচড় দিতে পারবেন তাঁরা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

baranasi delhi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE