বসার জায়গা, খাওয়ার জল কিছুই ছিল না। গরমে আরও কয়েকটা পাখা লাগালে হয়তো ভাল হতো। একটা শামিয়ানা অন্তত খাটানোই যেত...
আগের রাতে নেমন্তন্ন খেয়ে পরের দিন যেমন ঝালটা-নুনটা নিয়ে চর্চা চলে, গত সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি ভবনের উঠোনে নরেন্দ্র মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা নিয়ে আজ তেমনই কাটাছেঁড়া চলল ক্ষমতার অলিন্দে। এই গুঞ্জনের অবশ্য সবটাই উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। বরং কাটাছেঁড়া যে হবে, তার সিঁদুরে মেঘ দেখা গিয়েছিল গত কালই।
যেমন ধরা যাক আসন বিভ্রাট। সরকারি প্রোটোকল অনুযায়ী এ ধরনের অনুষ্ঠানে কে কোথায় বসবেন, তা নির্ধারিতই থাকে। বিশেষত সাংবিধানিক পদে থাকা নেতা-নেত্রী ও বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের আসন থাকে নির্দিষ্ট। অথচ গত সন্ধ্যায় রাইসিনা হিলে সেই প্রোটোকলের সব কলকব্জাই যেন ঢিলে হয়ে গিয়েছিল একটা সময়ে। শিবরাজ সিংহ চৌহান, চন্দ্রবাবু নায়ডু, বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়ার মতো মুখ্যমন্ত্রীরা প্রথম সারিতে বসতেই পেলেন না। কেউ বসলেন দ্বিতীয় সারিতে, কেউ তৃতীয় কিংবা চতুর্থ সারিতে। এমনকী সদ্য প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম এবং কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধীকেও একটু পিছনের দিকেই খুঁজেপেতে নিতে হল আসন। অথচ প্রথম সারিতে বসে রইলেন বিজেপির দুই সাধারণ সম্পাদক, কিছু ধর্মগুরু এবং এক অনাবাসী বাঙালি শিল্পপতি।
একটু দেরিতে আসা সাংসদদের অনেকে আবার নিজেদের আসনেই বসতে পাননি। নিরুপায় হয়ে তাঁদের বসতে হয় আমজনতার জন্য বরাদ্দ গ্যালারিতে। নিরাপত্তার বেড়া গলে আমন্ত্রিত দর্শকদের কেউ কেউ বরং বসে পড়েছিলেন সাংসদদের আসনে। আবার বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের জন্য নির্ধারিত আসনে বসে পড়েছিলেন একাধিক প্রাক্তন সাংসদ!
রাষ্ট্রপতি ভবন সূত্রে বলা হচ্ছে, প্রথম সারির আসনগুলি অতিথিদের নাম ধরে ধরে নির্ধারিতই ছিল। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, সনিয়া গাঁধী, প্রাক্তন দুই রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম এবং প্রতিভা পাটিল, সস্ত্রীক উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি এবং সাত জন বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য বরাদ্দ আসনে অন্য কাউকেই বসতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু এই ক’জন ছাড়া আর কারও ক্ষেত্রেই আসন নিয়ে গোড়া থেকেই কোনও শৃঙ্খলা ছিল না বলে অভিযোগ।
এই ক্ষেত্রে অভিযোগের আঙুল মোদীর অন্যতম আস্থাভাজন নেতা অমিত শাহের দিকে। তিনি কোনও সাংবিধানিক পদে নেই, স্রেফ দলের সাধারণ সম্পাদক। অথচ নিজে তো প্রথম সারিতে বসে পড়েনই, আর এক সাধারণ সম্পাদক রামলালকেও সেখানে টেনে বসান। মুকেশ অম্বানী, গৌতম আদানির মতো শিল্পপতিরা বসেছিলেন বাঁ দিকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির আসনে। অথচ প্রথম সারিতে শিবসেনা নেতা উদ্ধব ঠাকরের পাশে গিয়ে বসতে দেখা গেল অনাবাসী শিল্পপতি প্রসূন মুখোপাধ্যায়কে।
এর আগে অশোক হলে বা দরবার হলে যে সমস্ত শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হয়েছে, সেখানে কিন্তু এ ধরনের অভিযোগ বিশেষ শোনা যায়নি। এ বার কেন এই অব্যবস্থা?
জবাবে রাষ্ট্রপতি ভবনের কর্তারা জানাচ্ছেন, রাইসিনায় এত বড় অনুষ্ঠান পরিচালনার অভিজ্ঞতা তাঁদের এই প্রথম। তা সত্ত্বেও গোটা ব্যবস্থাটাই যথেষ্ট পরিকল্পনা মাফিক করা হয়েছিল। কিন্তু মুশকিল হল, নির্ধারিত আসনে বসার ব্যাপারে কার্যত কেউই রাষ্ট্রপতি ভবনের কর্মী ও সেনার অনুরোধ শুনতে চাননি। সব চেয়ে বড় কথা, এই সব ব্যক্তির রাজনৈতিক ও সামাজিক উচ্চতা এতটাই যে, জোর করে তাঁদের তুলে দেওয়াও যায়নি। অথচ শিষ্টাচারটাই তাঁদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ছিল।
সেই প্রত্যাশাপূরণ কেন হল না?
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এর নেপথ্যে সার কথাটা হল ক্ষমতা। সবটাই তার খেলা। দিল্লিতে যা অতি পরিচিত দৃশ্য। এমন সব অনুষ্ঠানে কে কার সঙ্গে কাঁধ ঘষাঘষি করলেন, কোন নেতা বা শিল্পপতি সরকারের কত কাছের, তিনি প্রথম সারিতে বসলেন কি না, কিংবা প্রথম সারি থেকে কত দূরত্বে বসলেন, তার সবটাই মাপা হয়। এবং তার ভিত্তিতেই রাজনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা ওঠানামা করে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে সেটা দেশে নয়, আন্তর্জাতিক স্তরেও গুরুত্বপূর্ণ।
আসন বিভ্রাট ছাড়াও খুচরো কিছু অসন্তোষের কথাও আজ শোনা গিয়েছে। যেমন, সামনের দিকে বসা অনেকের অভিযোগ, ঠা ঠা গরমে জল পর্যন্ত মেলেনি। পানীয় জলের অবশ্য ব্যবস্থা জয়পুর স্তম্ভের নীচে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা উঠে গিয়ে জল খাওয়ার ঝুঁকি নেননি। কেন? যদি জল আনতে গিয়ে আসনই চলে যায়!
গরমে যথেষ্ট সংখ্যক পাখা ও শামিয়ানার অভাব নিয়েও অভিযোগ উঠেছে। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতি ভবনের এক কর্তা অবশ্য ঘরোয়া আলোচনায় বললেন, গরমের কষ্ট যে হবে, তা আগাম ধরে নেওয়াই উচিত ছিল দর্শকদের। খোলা মাঠে কতই বা পাখা লাগানো যায়! আর শামিয়ানা খাটাতে গেলে তো পটভূমিতে রাষ্ট্রপতি ভবনটাই ঢাকা পড়ে যেত।
যুক্তি-তর্ক যা-ই হোক, পালাবদলের সূচনায় এইটুকু অস্বস্তির ছোঁয়া রয়েই গেল রাজধানীতে।