Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

মুম্বইয়ে শ্রীবিনায়ক জয়ন্তী

তিনি বিঘ্নবিনাশী শ্রীবিনায়ক। তিনি গজানন, তিনি একদন্ত, তিনি লম্বোদর। নানান রূপেই তিনি লীলাময়। কখনও তিনি বাল গণপতি, কখনও বা স্বয়ম্ভু গণপতি। কখনও দ্বিভুজ গণপতি, চতুর্ভুজ গণপতি অথবা দশভুজ গণপতি। আবার কখনও হেরম্ব গণপতি, বরদ গণপতি, সূর্য গণপতি, লক্ষ্মীগণপতি, হরিদ্রা গণপতি, দক্ষিণামূর্তিধারী গণপতি, নর্তন গণপতি।

মধুছন্দা মিত্র ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৪ ০০:১৯
Share: Save:

তিনি বিঘ্নবিনাশী শ্রীবিনায়ক। তিনি গজানন, তিনি একদন্ত, তিনি লম্বোদর। নানান রূপেই তিনি লীলাময়। কখনও তিনি বাল গণপতি, কখনও বা স্বয়ম্ভু গণপতি। কখনও দ্বিভুজ গণপতি, চতুর্ভুজ গণপতি অথবা দশভুজ গণপতি। আবার কখনও হেরম্ব গণপতি, বরদ গণপতি, সূর্য গণপতি, লক্ষ্মীগণপতি, হরিদ্রা গণপতি, দক্ষিণামূর্তিধারী গণপতি, নর্তন গণপতি।

সংস্কৃত শব্দ ‘গণ’ অর্থাৎ সর্বসাধারণ এবং ‘ঈশ’ অর্থাৎ ‘পরম পূজ্য’। পুরাণে তিনি ‘পঞ্চায়তন’ অর্থাৎ হিন্দু মতে অন্যতম পাঁচ দেবদেবী ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর-পার্বতী-গণেশ মধ্যে অনন্য। কোনও কোনও হিন্দু শাস্ত্রে উল্লেখ আছে শ্রীগণেশ অবিবাহিত ব্রহ্মচারী। আবার অন্যান্য কিছু শাস্ত্রে তাঁকে বুদ্ধি (বোধ), সিদ্ধি (আত্মিক শক্তি) ও রিদ্ধি (সৌভাগ্য) এই তিন গুণান্বিতা স্ত্রীর স্বামী রূপে কল্পনা করা হয়েছে।

‘সর্ববিঘ্নেশ্বর’ বিভূষিত শ্রীগণেশ। যাঁর হস্তিমস্তককে সূচিত করা হয় ‘আত্মন’ রূপে। মানবজীবনের মূল প্রতিপাদ্য হল এই ‘আত্মন’ অর্থাৎ নিজেকে জানা। শ্রীগণেশের নাসিকা তথা শুঁড়টি হল ওম তথা ‘ওঙ্কার’ নাদ বা ধ্বনিবিশেষ। আর শ্রীগণেশের সমগ্র অবয়ব হল ‘মায়া’ যা কিনা পার্থিব জগৎ প্রপঞ্চকে নির্ধারণ করছে।

“জয় গণপতি সদগুণ মদন
কবিরব বরদ কৃপাল
বিঘ্ন হরণ, মঙ্গল করণ
জয় জয় গিরিজালাল”

গণপতি মূর্তির চতুর্ভুজের মধ্যে উপরের ডান হাতে বিরাজমান ‘অঙ্কুশ’ হল মানবকুলের ‘সর্ববিঘ্নবিনাশকারী’। অন্য হাতে আশীর্বাদ স্বরূপ ‘বরাভয়’ মুদ্রা। গণপতির এক হাতের মণিবন্ধে জড়ানো সর্পশিশুর ফণা। যা কিনা আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতিভূ। কোথাও কোথাও আবার গণেশ মূর্তির এক হাতে ধরা থাকে তাঁরই ভাঙা গজদন্ত। কথিত আছে, মহাভারতের কাহিনি লিপিবদ্ধ করার সময়, এই গজদন্তটিকেই তিনি লেখনী হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ভূর্জপত্রের ওপর যে লেখনী দিয়ে সম্পূর্ণ মহাভারত লিখেছিলেন তিনি, সেই লেখনী তথা ভাঙা গজদন্তটি হল ‘আত্মত্যাগের’প্রতীক স্বরূপ। ‘মোতিচুরের লাড্ডু’ বা মরাঠি ভাষায় ‘মোদক’ আনন্দ সুখ ও সমৃদ্ধির প্রতিভূ যেটি গজাননের এক হাতের মুঠোয় ধরা থাকে। এই সুখ ও সমৃদ্ধির অধীশ্বর গণপতি বাপ্পাকে ‘Lord of Sucess’ ও বলা হয়।

গণেশের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে পুরাণে নানান কল্পকাহিনি প্রচলিত। ‘শিবপুরাণ’ মতে অদ্ভুত এক গাথা আছে যেখানে পার্বতী একদা স্নান করতে যাওয়ার আগে, ত্বক চর্চা করার সময় চন্দনচর্চিত ঘষা উচ্ছিষ্ট অংশ দিয়ে খেলাচ্ছলে ছোট্ট একটি মূর্তি গড়ে তাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন। সেই নব্য মূর্তিকে স্নানাগারের সামনে দ্বার প্রহরায় রেখে নির্বিঘ্নে স্নান করতে যান। এ দিকে শিব ঘরে ফিরে অচেনা এক আগন্তুককে দেখে ভয়ানক রুষ্ট হন। ও দিকে আবার পার্বতীর এই নবনিযুক্ত ‘দ্বারপাল’ শিবকে বিনা অনুমতিতে অন্দরে প্রবেশ করাতে নারাজ। রুষ্ট শিব তখনই তার মুণ্ডচ্ছেদ করেন। তার পর যদিও পার্বতীর কাতর হাহাকারে সব জানার পর, অনুশোচনাবিদ্ধ শিব, তাঁর ‘গণ’ নামক এক অনুচরকে আদেশ দেন, উত্তর দিকে মস্তক রেখে শুয়ে এমন যাকেই প্রথম দেখতে পাওয়া যাবে, তার মস্তক নিয়ে আসার জন্য। গণ বাধ্যের মতো, উত্তরে মাথা রেখে শুয়ে থাকা এক ঘুমন্ত হস্তিশাবককে প্রথম দেখতে পায় এবং তার শিরচ্ছেদ করে তা মহাদেবকে সমর্পণ করে। দেবাদিদেব সেই হস্তিমস্তককেই ‘পার্বতীর দ্বারপাল’ সেই শিশুর শরীরে প্রতিস্থাপন করেন। শিবপার্বতী সেই শিশুর নামকরণ করেন ‘গণেশ’ এবং আশীর্বাদ করেন জগতে সমস্ত দেবদেবীর পূজার প্রারম্ভেই ‘গণেশ বন্দনা’ করা হবে।

কত কাহিনিই না প্রচলিত, যেখানে সপ্তঋষির অন্যতম কাশ্যপ মুনির পুত্র আদিত্যকে শিব বধ করেন এবং পরে পুনরায় জীবনদান করেছিলেন। কাশ্যপ মুনি শিবকে অভিসম্পাত করেন তাঁর মুণ্ডহীন পুত্র ভূমিষ্ঠ হবে। ঘটনাচক্রে সত্যিই এমন ঘটনা ঘটে। দেবরাজ ইন্দ্র তখন নিজের বাহন ঐরাবতের মস্তক শিবতনয়ের মস্তকস্থানে সংস্থাপিত করে দেন।

নানান অতিরঞ্জিত গল্পগাথার মধ্যে গণেশ জন্মের আরও একটা গল্প হল, পার্বতীর ব্যবহৃত স্নানের জল গঙ্গায় জমা হত। একদিন হস্তিমস্তকরূপিণী দেবী মালিনী সেই গঙ্গাজল পান করার ফলে গর্ভবতী হন এবং যথাসময়ে চার হাত ও পাঁচ হস্তিমস্তকযুক্ত এক শিশুপুত্রের জন্ম দেন। মালিনী তাঁর গর্ভজাত পুত্রকে নিজ পুত্র বলে দাবি করলেও, শিব কিন্তু দ্বিধাহীন ঘোষণা করেন, প্রকৃত পক্ষে শিশুটি পার্বতীর পুত্র। এই ঘোষণার পরই তিনি সেই শিশুপুত্রের উদ্বৃত্ত চারটি মাথা ছেঁটে দেন এবং যথাস্থানে একটিমাত্র অবশিষ্ট রাখেন তাকে ‘সর্ববিঘ্নেশ্বর’ রূপে ভূষিত করার জন্য।

“একদন্তং মহাকায়ং লম্বোদরং গজাননং
বিঘ্ননাশকং দেবং হেরম্বং প্রণমাম্যহং”

বহুল প্রচারিত আরও এক কল্পকাহিনি হল, পার্বতীর প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর স্বর্গের তাবৎ দেবকুল সদ্যোজাত শিশুকে আশীর্বাদ করতে এলেন। সূর্যপুত্র শনিদেবও উপস্থিত সেই অনুষ্ঠানে। নবজাতকের সামনে শনিদেব কিছুতেই যেতে চাননি। তাঁর দৃষ্টি অমঙ্গলজনক সেটা বুঝেই। কিন্তু পার্বতীর একান্ত অনুরোধে ইতস্তত শনিদেব শিশুর কাছে যেতে বাধ্য হন এবং ফলত শনির নবজাতকের মুখদর্শন মাত্রই শিশুর মুখ খসে পড়ে। আনন্দ উৎসবের মাঝে আকস্মিক এই বিপর্যয়ে দেবতারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। ভগবান বিষ্ণু তাঁর বাহন গরুড়কে পুষ্পভদ্র নদীতীরে পাঠিয়ে, সেখান থেকে ঐরাবত শিশুর মুণ্ড আনিয়ে পার্বতীর নবজাতকের মস্তকে পুনরায় প্রতিস্থাপন করেন। উপস্থিত সমবেত দেবতারা তুমুল হর্ষধ্বনিতে নবজাতকের নামকরণ করেন ‘শ্রীগণেশ’। তাঁকে শক্তি ও সমৃদ্ধির অধীশ্বর ও বিঘ্নবিনাশী রূপে স্তুতি করতে থাকেন।

গণেশের জন্মবৃত্তান্ত আধারিত এমনই নানান কল্পকাহিনির খোঁজ পাওয়া যায় পৌরাণিক আখ্যানগুলোতে। তবে জন্মরহস্য যাই হোক, প্রকৃতির সমন্বয়সৃষ্ট প্রাণ মাত্রই ঈশ্বর। শিব-পার্বতীর একান্ত আদরের দুলাল গণপতি ‘সর্ববিঘ্নেশ্বর’। তাই তো গণপতি বাপ্পার বন্দনায় ভক্তরা উদাত্ত হয়ে প্রার্থনা ও আকুতি জানান

“বক্রতুণ্ড মহাকায় সূর্যকোটি সমপ্রভা
নির্বিঘ্নং কুরু মে দেব সর্বকার্যেষু সর্বদা”

মুম্বইকরদের প্রাণস্য প্রিয় দেবতা গণপতি বাপ্পার জন্ম-মহোৎসব এই বছর ২৯ অগস্ট থেকে ৮ সেপ্টেম্বর। প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শুক্লা চতুর্থীর পুণ্য তিথিতে শুরু হয়ে যায় শ্রীগণেশের পবিত্র জন্মোৎসব উদযাপন। এই ‘গণেশ চতুর্থী’ বা ‘বিনায়ক চৌথি’ উৎসবটি শেষ হয় দশদিন পর। ভাদ্র মাসের ‘শুক্লা চতুর্দশী’তে। সেই পবিত্র ক্ষণটিকে বলা হয় ‘অনন্ত চতুর্দশী’। মহারাষ্ট্রে পারিবারিক পুজোগুলোয় অষ্টমী তিথিতে অর্থাৎ পুজোর পঞ্চম দিনে গণেশ মূর্তি বিসর্জন দেওয়ার রীতি। যদিও এখানকার বারোয়ারি পুজো মণ্ডপে দশম দিনে, অর্থাৎ ‘অনন্ত চতুর্দশী’ দিনেই জাঁকজমকপূর্ণ নিরঞ্জন হয়।

প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, মরাঠা রাজ্যের কৃষ্টি ও জাতীয়তাবোধের নির্মাণকল্পে ছত্রপতি শিবাজী রাও ভোঁসলেই হলেন গণেশ জয়ন্তীর প্রথম উদ্যোক্তা। এর আরও পরে, ১৮৯৪ সালে বিশিষ্ট স্বতন্ত্রতা সংগ্রামী লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলককিশোরবেলায় ইতিহাসে পড়া যাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি ছিল “স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার” তিনিই এই পুজোকে এ রাজ্যের মানুষজনের কাছে নির্দিষ্ট বাৎসরিক পুজো হিসেবে চালু করেন।

এক সময় এই পুজোর সঠিক দিন ও নির্ঘণ্ট নিয়ে সমাজে এক শ্রেণির ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণদের মধ্যে এক ধরনের অবিসংবাদিত দ্বন্দ্ব সবসময় লেগে থাকত। লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলকই সর্বপ্রথম গণেশকে ‘সার্বভৌম’ দেবতা হিসেবে মান্যতা দিয়ে এই পবিত্র ‘গণেশ উৎসব’ শুরু করেন। তিলক প্রথম এই পুজোকে একটি জমায়েত স্থলে সমাজের সমস্ত শ্রেণির নাগরিকদের মধ্যে উন্মুক্ত এক সামাজিক, বাৎসরিক উৎসব হিসাবে প্রচলন করেন। বস্তুত সমগ্র মরাঠা জাতিকে ব্রিটিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে গণেশ জয়ন্তীকে কেন্দ্র করে বারোয়ারি উৎসব হিসাবে প্রচলন করেন তিনি। যেটি এখন সমগ্র মুম্বই তথা মহারাষ্ট্র ছাড়িয়েও সারা ভারতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একটি বৃহৎ গণ-উৎসব হিসাবে পালিত হয়।

মরাঠা জাতির বিশ্বাস ‘অষ্ট বিনায়ক দর্শন’ খুবই মহৎ ও পুণ্য কর্ম। এই অষ্টগণেশ মন্দির হল মারগাঁওয়ে অবস্থিত শ্রী ময়ূরেশ্বর মন্দির, পালি এলাকার শ্রীবল্লালেশ্বর মন্দির, মাহাদ-এ শ্রীবরদাবিনায়ক মন্দির, সিদ্ধাটেক-এর শ্রীসিদ্ধিবিনায়ক মন্দির, খার-এ শ্রীচিন্তামণি মন্দির, লেনিয়াদ্রি-র শ্রীগিরিজাত্মজ মন্দির, ওজাব-এ শ্রীবিঘ্নেশ্বর মন্দির ও রঞ্জনগাঁওয়ের শ্রী মহাগণপতি মন্দির। উপরিউক্ত আটটি মন্দিরই মহারাষ্ট্র ও বিদর্ভ অঞ্চলে। এ ছাড়া খোদ মুম্বইয়ের দাদার ওয়েস্ট-এ প্রসিদ্ধ শ্রীসিদ্ধিবিনায়ক মন্দির তো মুম্বইয়ের সেরা দ্রষ্টব্য তালিকাতেই পড়ে। বরিভলি ওয়েস্ট ওয়াজিরা নাকা গণেশ মন্দির, আন্ধেরি ইস্ট-এও অপর একটি বিনায়ক মন্দির, আলিবাগ অঞ্চলে আছে শ্রীবিক্রমবিনায়ক মন্দির, ও দিকে টিটাওয়ালার মহাগণপতি মন্দির মুম্বইকরদের কাছে খুবই পূজ্য ক্ষেত্র।

“জয় গণেশ জয় গণেশ জয় গণেশ দেবা
মাতা জাকি পার্বতী, পিতা মহাদেবা॥
জয়—
একদন্ত দয়াবন্ত চার ভুজাধারী।
মাথে সিঁন্দুর সোহে মুসে কী সবারি॥
জয়—
দীনন কি লাজ রাখো শম্ভুপুত্রয়ারী
মনোরথকো পুরা করো জয় বলিহারি॥
জয়—”

মরাঠা অঞ্চলের গণপতি মন্দিরগুলিতে সারা বছরই ভক্ত সমাগম লেগেই থাকে। ‘গণেশ চতুর্থী’ উৎসব উপলক্ষে তো এখানকার মানুষ বর্ণ, জাতি, ধর্ম ভেদাভেদহীন হয়ে এই আনন্দোৎসবে মেতে থাকেন। অসাধারণ সব মণ্ডপসজ্জা ও আলোকসজ্জার মাঝে একেকটি বিশালাকৃতি গণেশমূর্তির পূজার্চনা প্রভূত জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়। দশ দিনের এই মহা উৎসবটির জন্য মরাঠাবাসী সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন। গণপতি পুজোর প্রধান পুরোহিত গণেশ মূর্তিতে সাদা বা লাল ধুতি, উত্তরীয় এবং লাল চন্দনের তিলক পরিয়ে প্রথমেই ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ আচার পালন করেন। তার পর ‘সোদাশোউপচারো’ অর্থাৎ ১৬ উপচারে ভগবানকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। নারকেল, ২১টি মোতিচুরের লাড্ডু বা মোদক, ২১টি দুব্বো ঘাস, মিছরি অথবা গুড়, লাল ফুল, লাল ফুলের মালা, কুমকুম, ত্রিপত্র, রক্তচন্দন ইত্যাদি অর্ঘ্য নিবেদিত হয় শ্রীগণেশের পদতলে। গৌরীনন্দনের বন্দনায় মুখরিত হন মরাঠা তথা সমস্ত রাজ্যবাসী

“জয় জয় গণপতি গণ রাজু।
মঙ্গল ভরণ করণ শুভ কাজু॥
জয় গজ বদন সদন সুখদাতা।
বিঘ্ন বিনায়ক বুদ্ধি বিধাতা॥

পুরোদস্তুর ‘ফেস্টিভ মুড’-এ মেতে থাকেন মরাঠাবাসী, গণেশ জয়ন্তীর উৎসবমুখরিত দশটি দিনে। শ্রাবণের আলিঙ্গন শেষে প্রকৃতিও যেন সদাজাগ্রত। চার পাশ যেন আরও লাবণ্যময় আরও অপরূপা হয়ে ওঠে। উৎসব শুরুর ঢের আগে থাকতেই মরাঠাবাসী উৎসাহ উদ্দীপনায় কেনাকাটা, ঘর দুয়ার সাফ সুতরো, নতুন রঙের প্রলেপ লাগানো, সুন্দর করে সাজানো এ সব নিয়ে আনন্দে ব্যস্ত থাকেন। ফুটপাতে বিভিন্ন দোকানের সামনে রঙে রাঙানো মণ্ডপ, তোরণ বিক্রি হতে থাকে। রকমারি ঝুটো ফুলের মালা যেগুলি রঙিন কাপড়, নাইলন, প্লাস্টিক, কৃত্রিম রুদ্রাক্ষ, রঙিন ক্রেপ কাগজ, সাটিন, সলমা-চুমকি, রঙিন জরি, পুঁতি দিয়ে বানানো দেদার বিকোয়। আবার ঘরের দেওয়ালে সাজানো, সদর দরজায় টাঙানোর জন্য, আলপনার মোটিফ ও রঙোলি বানানোর হরেক রঙা আবির এবং হাজার একটা বিভিন্ন রকম অলঙ্করণের উপচার এই সময়টাতে ঢালাও বিক্রি হতে থাকে। অনেক আকৃতির দিয়ার সম্ভার কিংবা রকমারি টুনি, ঝুলন্ত বেলুন জাতীয় ল্যাম্প শেড কী যে বিক্রিবাটা হয় না এ সময়টাতে, উৎসবের আভিজাত্যে। উৎসাহী মানুষজনের পকেটের শেষ রেস্তোটুকু দিয়েও কেনাকাটা চলতেই থাকে।

আর হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি বিক্রি হয় প্রচুর ঐতিহ্যবাহী গণেশবন্দনার ও গণেশ স্তোত্র সম্বলিত সিডি। এখানকার ছোট-বড়-মেজ-সেজ সমস্ত মণ্ডপেই দশ দিন যাবৎ অহর্নিশ বাজতে শোনা যাবে গণেশস্তুতি ও গণেশ আরতির গানের ঝঙ্কার। দিনকাল বদলেছে। নতুন প্রজন্ম কোথাও হয়তো বলিউড ফিল্মি গানের সুরের অনুকরণে গণপতি বন্দনার চটুল রিমিক্সও শোনায়। তবে লক্ষণীয় ভাবেই এখানকার বেশির ভাগ ‘পুজো উৎসব মণ্ডল’ তথাকথিত এই বলিউড রিমিক্সের ঘোরতর বিরোধী এবং কঠোর ভাবে এগুলি পরিহার করে চলার পক্ষপাতী।

প্রায় দুু-তিন মাস আগে থাকতেই মুম্বই-পুণে-নাসিক-থানে-কোলহাপুর-নাগপুর তথা সমস্ত মহারাষ্ট্রেরই কুমোরপাড়ায় জোরকদমে শুরু হয়ে গেছে মূর্তি তৈরির কাজ। কোথাও ‘পরিবেশ-বন্ধু’ মূর্তিও তৈরি হচ্ছে। এখন তো ম্যারাপ বাঁধার কাজও প্রায় শেষ মুহূর্তে। দোকানের হোর্ডিং, কাগজের বিজ্ঞাপনে ব্যানারে গণেশ চতুর্থী উৎসবের নানান ধামাকা অফার ও ফিরিস্তি। ফুটপাতে দোকানে উপচে পড়া ভিড়। পুজোর প্রস্তুতি কেনাকাটা তুঙ্গে। সাজসাজ রব। ‘বাপ্পা’ আসছেন যে।

‘বাপ্পা’ আসছেন। বছরভর চরৈবেতি মন্ত্রে বেঁচে বর্তে থাকা মরাঠি-জীবন আসন্ন দশটি দিনের জন্য উদ্দীপনা উৎসাহ আর অপেক্ষায়‘কালনির্ণয়ের’ পাতায় চোখ রেখে শুরু করে দেন কাউন্টডাউন।

“জয় দেব জয় দেব
জয় মঙ্গল মূর্তি
দরশন মারতে কামনা পূর্তি
জয় দেব জয় দেব

সুখকর্তা দুখহর্তা ভর্তা বিঘ্নাচি
নভি পুর্ভি প্রেম ক্রুপা জায়চি
জয় দেব জয় দেব

সর্বাঙ্গি সুন্দর অতি সুন্দরচি
কান্তি ঝলকে মদমুক্তা পধঞ্চি
জয় দেব জয় দেব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

madhuchanda mitra ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE