ইতালির দক্ষিণে উল্টনো ‘ব’য়ের মতো দেখতে একটি দ্বীপ মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা হয়ে ভূমধ্যসাগরে ভেসে আছে। নাম সিসিলি।
খাতায় কলমে ইতালির মানচিত্রের অংশ হলেও দ্বীপটি পুরোপুরি ইতালীয় নয়। গ্রিক, পর্তুগিজ, স্পেন, ফরাসি, রোমান এমনকি, আরব্য সংস্কৃতির বড় প্রভাব রয়েছে সিসিলিতে। জীবনযাপন, ভাবনা-চিন্তা এমনকি, খাওয়াদাওয়াতেও এরা আলাদা।
সিসিলির বারান্দা। ছবি: সংগৃহীত।
এ দ্বীপের মানুষ লক্ষ্যহীন দৌড়নোয় নয়, থামায় বিশ্বাসী। সাফল্যের পিছনে ছোটার থেকে পরিবারের সঙ্গে, বন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দেওয়ায় বিশ্বাসী। গোটা দুনিয়া যখন ব্যস্তসমস্ত, তখন সিসিলির মানুষ রোদ মাখা বারান্দায়, বেতের চেয়ারে গা এলিয়ে ভালবাসার মানুষজনকে কাছে নিয়ে বসতে ভালবাসেন। আর ভালবাসেন জমিয়ে খাওয়াদাওয়া করতে।
‘দ্য গড ফাদার’ ছবির দৃশ্যে মূল চরিত্র মাফিয়া ডন ভিটো কার্লোনের সঙ্গে তাঁর কন্যা এবং পরিবারের বাকি সদস্যরা। । ছবি: সংগৃহীত।
দুনিয়ার পরোয়া না করে এই যে সিসিলির নিজের মতো থাকার ‘দাদাগিরি’, তার একটা ঝলক দেখা যায় ‘দ্য গডফাদার’ সিনেমায়। কিন্তু সিসিলের এই দাদাগিরিকে যদি বাঙালিদের ভাষায় ব্যাখ্যা করতে হয়, তবে কী বলা যায়? বাবুয়ানা, সাহেবিয়ানা কিংবা বাঙালিয়ানার মতো ‘সিসিলিয়ানা’ বলা যায় নিশ্চয়ই। বাঙালি রেস্তরাঁ ব্যবসায়ী অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে তেমনই এক টুকরো ‘সিসিলিয়ানা’ এ বার খাস কলকাতায়।
সিসিলিয়ানার দ্য সালুমেরিয়া প্ল্যাটার। —নিজস্ব চিত্র।
সিসিলির খাবারের সম্ভার এবং তাদের অন্য রকম সংস্কৃতির টুকরো টুকরো দৃশ্যপট সাজিয়ে ফোরাম মলে খুলেছে নতুন রেস্তরাঁ ‘সিসিলিয়ানা’। সেখানে গেলে ইতালির খাবারের এক সম্পূর্ণ আলাদা রূপ দেখতে পাবেন কলকাতার খাদ্যপ্রেমীরা।
সিসিলির খাবারে তুরস্ক, আরবের প্রভাব রয়েছে ভরপুর। তাই কাবাবেরও দেখা মেলে। —নিজস্ব চিত্র।
ফোরাম মলের পাঁচতলায় যেখানে ওই রেস্তরাঁ খুলেছে, সেখানে এর আগে ছিল অঞ্জনের সংস্থা স্পেশ্যালিটি রেস্টুরেন্টস লিমিটেডের ‘ক্যাফে মেজ়ুনা’। সেই ক্যাফেরই ভোল বদলে তৈরি হয়েছে ‘সিসিলিয়ানা’। আর এই প্রথম স্পেশ্যালিটি গ্রুপ তাঁদের স্বাচ্ছন্দ্যের ক্ষেত্র এশিয়ার নানা দেশের খাবারদাবারের গণ্ডি পেরিয়ে পেরিয়ে পাড়ি দিল ইউরোপের দেশে ইতালিতে।
দেখতে পোলাওয়ের মতো। সঙ্গে রয়েছে আলু এবং মাংসও। এমন খাবারও ইতালির সিসিলিতে পাওয়া যায়! —নিজস্ব চিত্র।
কলকাতা শহরে ইতালীয় রেস্তরাঁ নেহাত কম নেই। খাঁটি ইতালীর খাবার দাবারও পাওয়া যায় তার মধ্যে কয়েকটিতে। সিসিলিয়ানা তবে কী ভাবে আলাদা? অঞ্জন বললেন, আধুনিক ভারতে ইউরোপীয় খাবার খাওয়ার চল রয়েছে। কিন্তু ইউরোপের বিভিন্ন দেশের খাবারে যে আলাদা আলাদা বৈচিত্র আছে তা ভারতের বহু খাদ্যপ্রেমীর কাছেই পৌঁছতে পারেনি। আমরা সেই দিকটাকেই সামনে রেখে এগোচ্ছি। ইতালির খাবার অনেকেই খেয়েছেন। কিন্তু সিসিলি হল খাস ‘গডফাদার’-এর এলাকা। সেখানকার খাওয়াদাওয়া অন্য রকম। সিসিলির মানুষ বাঙালিদের মতোই মাছ খেতে ভালবাসেন। কলকাতার খাদ্যরসিকদের কাছে তাই আমরা সিসিলির সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে চেয়েছি।’’
লম্বাটে পিৎজ়ার দেখা মিলবে সিসিলিয়ানায়। —নিজস্ব চিত্র।
ফোরাম মল-এর পাঁচতলায় তাই থাকছে সিসিলির একটি ড্রয়িং রুম। ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী সিসিলির কোনও শহরে পাথুরে রাস্তা, পাথুরে দেওয়াল পেরিয়ে যেমন ঘরে ঢুকে পড়া যায়, ঠিক সেই রকম। বড় বড় জানলায় সাজানো দেওয়াল, এলিয়ে বসার ব্যবস্থা, ছাদ থেকে ঝোলা সিলিং ল্যাম্পের নিভু নিভু আলোর বিচ্ছুরণ! সেখানে পরিবেশন করা হবে সিসিলীয় ঘরানার খাবার-দাবার রিসোতো আলা ক্যালাব্রিজ়, লিঙ্গুয়িনি আলা সার্ডিনিয়া, দ্য সালুমেরিয়া প্ল্যাটার, স্প্যাগেটি পুটানেসা, গ্রেমোলাটা স্যামন এবং আরও অনেক কিছু। পান ছাড়া ভোজন জমে না। তাই সিসিলিয়ানায় থাকবে সিসিলির ওয়াইন এবং সেখানকার স্থানীয় পানীয়ও।
শেষ পাতে মিষ্টিতে আম এবং চিজ়কেক। —নিজস্ব চিত্র।
সিসিলিয়ানার রান্নাঘরের দায়িত্বে রয়েছেন রন্ধনশিল্পী সব্যসাচী গড়াই। আসানসোলের ভূমিপুত্র সব্যসাচী, যিনি খাওয়াদাওয়ার জগতে স্যাবি নামেই বেশি পরিচিত, ইতালীয় রান্নাবান্নায় পটু। স্যাবি ইতালির রান্না শিখেছেন ইতালিতে থেকেই। ইতালির গ্রামে গ্রামে ঘুরে, সেখানকার প্রাচীন সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিত মানুষজনের রান্নাঘর ঢুকে। সেই অভিজ্ঞতাকেই কাজে লাগিয়ে সিসিলিয়ানার মেনু সাজিয়েছেন স্যাবি। খাস ইতালি থেকে খাঁটি জিনিসপত্র আনিয়েছেন রন্ধনশালায় ব্যবহারের জন্য।
এখন দেখার, কলকাতার মানুষ ‘গডফাদার’-এর দেশের সংস্কৃতিকে কতখানি আপন করে নেন!