Advertisement
E-Paper

শিল্পই বলল ইটালির নবজাগরণের কাহিনি, পোশাকশিল্পী রোহনের সৃষ্টিতে উজ্জ্বল ভিক্টোরিয়া

ইটালির নবজাগরণকে ফিরে দেখল কলকাতা। সাজের মাধ্যমে ইতিহাস তুলে ধরলেন পোশাকশিল্পী রোহন পারিয়ার।

রূম্পা দাস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২৫ ১৮:৪৩
Kolkata designer Rohan Pariyar showcased his collection based on fashion during the Italian Renaissance

কনস্যুলেট জেনারেল অফ ইটালি ইন কলকাতার উদ্যোগে সম্প্রতি আয়োজিত হল ‘উনা সেরাতা ফিওরেন্তিনা’। ছবি: অমিত দত্ত।

তিনি ছিলেন ছোটখাটো চেহারার। শখ ছিল লম্বা দেখানোর। চাইলেই তো আর তা সম্ভব নয়। তাই মুচিকে ডেকে এমন জুতোর বরাত দিয়েছিলেন, যাতে জুতোর হিল হয় দশ সেন্টিমিটার উঁচু। সেই জুতো পরলে লম্বা তো লাগবেই, তার সঙ্গে আত্মবিশ্বাসের পারদও চড়বে। সময়টা পনেরো শতকের মাঝামাঝি এবং তাঁর নাম কাতেরিনা দি মেদিচি।

একটা সময় পর্যন্ত ইউরোপ মহাদেশের পোশাক-আশাক, ফ্যাশন— সব কিছুতেই এগিয়ে রাখা হত ফ্রান্সকে। বলা হত, ফ্রান্সই গোটা মহাদেশকে শিখিয়েছে কী ভাবে কেতাদুরস্ত হতে হয়। কিন্তু ইটালি সেই চিরাচরিত সংজ্ঞাটাই বদলে দিল। সৌজন্য মেদিচি পরিবার।

তেরো শতকের কথা। ইটালির আদরের ফিরেনজের উত্তর দিকের অঞ্চলের নাম মুজেল্লো। সেখানেই মেদিচি পরিবারের বাস। মেদিচি কথার অর্থ মূলত চিকিৎসক। কিন্তু পরিবারের সকলেই ব্যবসায়ী। যশ, প্রতিপত্তি এতটাই বেড়ে ওঠে যে, মেদিচি ব্যাঙ্ক হয়ে ওঠে গোটা ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থ যোগানকারী সংস্থা। তবে যতটা ব্যবসামনস্ক ছিল এই মেদিচি পরিবার, ততটাই সংস্কৃতিমনস্কও। বংশ ও ক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নানা রাজপরিবারের সঙ্গে মেদিচি পরিবার বিবাহসূত্রে সংযোগ স্থাপন করেছিল। এই ভাবে ইটালির সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে কাতেরিনা হয়ে গিয়েছিলেন ফরাসি রাজার রানি ক্যাথারিন। সেই কাতেরিনার গল্প নেহাত দু’-চার কলম শব্দবন্ধ নয়, একটা গোটা রূপকথা।

ফিরেনজের সান্ধ্য-আসর বসল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের থামে মোড়া অন্দরে, খোলা আকাশের নীচে।

ফিরেনজের সান্ধ্য-আসর বসল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের থামে মোড়া অন্দরে, খোলা আকাশের নীচে। ছবি: অমিত দত্ত।

পনেরো শতকে কসিমো দে মেদিচি বুঝেছিলেন ধীরে ধীরে ফিরেনজের হাওয়া ঘুরছে। প্রজন্মের পরম্পরায় পিয়েরো, লোরেনজ়ো যোগ্য উত্তরাধিকার হয়ে উঠেছেন। ব্যাঙ্কের ব্যবসায় অর্থ ফুলেফেঁপে উঠছিল ঠিকই, তবে তাতে সন্তুষ্ট ছিল না মেদিচি পরিবার। শিল্প, চিত্রকলা, ভাস্কর্যের আকর ফিরেনজের রাস্তায় রাস্তায় তখন জ্বলন্ত প্রতিভা। এতদিনকার প্রথা ভেঙে এ বার নতুন করে জেগে ওঠার পালা। এই সব নাম না জানা, অচেনা মানুষদের কাজে মুগ্ধ হয়ে আরও কাজের সুযোগ দিচ্ছিল মেদিচি পরিবার। উঠে আসছিল একে একে নতুন নাম— মিকেলেঞ্জেলো, বত্তিচেল্লি, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। রেনেসাঁসের ঢেউ যেমন বাইরে এসে লেগেছিল, অন্দরমহলেও তার রেশ ছড়িয়ে পড়ে। নারীরা সে সময়ে শুধুই অন্তঃপুরবাসিনী নন। স্পেনের ভাইসরয় চাইলেন মেয়ের বিয়ে হোক ইটালির এই খ্যাতনামা পরিবারে। কজিমোকে বিয়ের সূত্র ধরে স্পেন থেকে ইটালি এলেন এলেওনোরা দি তোলেদো। আবার মেদিচির মেয়ে কাতেরিনা গেলেন ফ্রান্সে। ফলে সংস্কৃতির সংমেল হল অবাধে। পর্দা সরিয়ে নারীরা নবজাগরণের জোয়ার আনলেন পোশাকে, সাজসজ্জায়, নিজেদের উপস্থাপনায়। ফিরেনজের বুকে লালিত হতে থাকা সেই নবজাগরণকে এত বছর পরে ফের ছুঁয়ে দেখল কলকাতা। কনস্যুলেট জেনারেল অফ ইটালি ইন কলকাতার উদ্যোগে সম্প্রতি আয়োজিত হল ‘উনা সেরাতা ফিওরেন্তিনা’। উদ্যোগে শামিল হল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। ফিরেনজের সান্ধ্য-আসর বসল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের থামে মোড়া অন্দরে, খোলা আকাশের নীচে। পোশাকশিল্পী রোহন পারিয়ার ভাবনায় বাস্তবায়িত হল ‘আলতা মোদা মাল্টি জঁর শোকেস— ই মেদিচি’।

রোহনের কথায়, ‘‘সুযোগ পেলে আমি ইটালির রেনেসাঁসের সময়টা কাছ থেকে দেখতে চাইতাম। সেই যুগটাই তো আমাদের সভ্যতাকে বদলে দিল। শিল্প, সঙ্গীত, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, সাহিত্য এমন বাঁকবদল নিল, যা আজও অনুপ্রেরণা জোগায়।’’ রোহনের হাত ধরে তৈরি হল ৪০টি অনসম্বল। মেদিচি পরিবারের লুক্রেৎসিয়া, কন্তেসসিনা, ক্লারিচে, কাতেরিনা, বিয়াঙ্কা, মারিয়া— শুধুমাত্র কয়েকটা নাম নন, এঁরা ছড়িয়ে আছেন ইতিহাস জুড়ে। রেনেসাঁসের নারীরা অন্তঃপুর থেকে হেঁটে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন প্রকাশ্যে, ভিক্টোরিয়ার মাটিতে। সিল্কের উপর জারদৌসি আর কাটদানার কাজের জাদুছড়ি বুলিয়ে দিতেই রেনেসাঁ স্বয়ং সকলের অলক্ষে বুঝি মুচকি হাসলেন।

তবে শুধু পোশাক নয়, পোশাককে কেন্দ্র করে তৈরি হল অ্যাসাজের আনুষঙ্গিকও। যে কাতেরিনাকে দিয়ে এই লেখার শুরু, তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর কোমর যেন সুন্দর দেখায়। সিল্কের ঝলক থাকলেও গাউনের আতিশয্য যেন কোনও মতেই তাঁর অঙ্গসৌষ্ঠবকে ঢেকে না দিতে পারে। ফলে কাতেরিনার নির্দেশে তৈরি হল করসেট। স্থাপত্যের জন্য পরিচিত ইটালির ইমারতের খিলানেই শুধু নয়, নারীদের সিল্কের গাউনের উপরেও বদলাল নকশা।

অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছেন কলকাতায় ইটালির দূতাবাসের কনসাল জেনারেল রিক্কার্দো দাল্লা কস্তা।

অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছেন কলকাতায় ইটালির দূতাবাসের কনসাল জেনারেল রিক্কার্দো দাল্লা কস্তা। ছবি: অমিত দত্ত।

ইটালির রেনেসাঁসের সময়কার গাউন মূলত দু’ভাগে বিভক্ত। স্কার্ট হবে রাজকীয়, প্লিট করা এবং বহরে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। কাপড়ের ব্যবহারে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য সেখানে নেই। আর অন্য দিকে বডিস হত আঁটসাট, তাতে কখনও থাকত লেসের কাজ। এর পাশাপাশি, গলা দিকটা আবার চওড়া করে কাটা হতেই হবে। স্কোয়্যার বা কোয়্যাড্র্যাঙ্গুলার নেকলাইনে থাকত মুক্তো বা সোনা দিয়ে সূক্ষ্ম এমব্রয়ডারি। এই পোশাকের সঙ্গে স্লিভস অনেক সময়েই ডিট্যাচেবল হত। অর্থাৎ, আলাদা করে পরা ও খোলা সম্ভব। মূল পোশাক অর্থাৎ গামুররার উপর আলাদা করে অনেক সময়ে পরা হয় চোপ্পা। সেটিও পোশাকের অঙ্গ, কিন্তু আলাদা গুরুত্ব বহন করত।

মেদিচি পরিবারের নারীদের পোশাকের ফ্যাব্রিক নিয়ে বললে প্রথমেই যে শব্দটি মাথায় আসে, তা হল বিলাসিতা। সিল্ক, দামাস্ক, ভেলভেট, ব্রোকেড, এমনকি ফারের সঙ্গে মুক্তোর কাজ দেখলে নাকি ‘স্টেটাস’ বোঝা যেত। সোনার সুতোর বুনন এবং মুক্তোদানার কাজ ছিল খুবই সাধারণ ব্যাপার। প্রথম দিকে নারীরা এমন জুতোই পরতেন, যা ঢাকা থাকত স্কার্টের আড়ালে। কারণ, মাটি ছোঁয়ানো ভারী স্কার্ট পরাই ছিল দস্তুর। কাতেরিনার হাত ধরে হিল বসল জুতোয়। ধীরে ধীরে চল হল চপাইনেরও। খানিকটা এখনকার দিনের ফ্ল্যাট হিলের মতো। জুতো মাটি থেকে উঠে থাকবে অনেকটাই। এতে করে জুতোয় বা পোশাকে রাস্তার নোংরা, কাদা লাগবে না।

এর সঙ্গে আলাদা করে বলতেই হয় চুলের পারিপাট্যের কথা। পোশাক অনুযায়ী মানানসই হতে হবে চুলের সাজ, এ কথা বলা বাহুল্য। মাঝে সিঁথি করে দু’পাশে চুল ফেলা থাকবে আলগোছে। চুলের সামনের দিকের লেয়ার দিয়ে তৈরি হবে টুইস্টেড বান। সেই হেয়ার বান সাজানো হবে বালজো দিয়ে। চক্রাকার, অর্ধচন্দ্র নানা আকৃতির বালজো তৈরি হত পোশাকের দাবি মেনে। সেই বালজোয় থাকত ফার, ফ্যাব্রিক, মুক্তো, বাকরাম নামের হাতে বোনা তার ও নানা কিছু। কুমারী মেয়ে এবং বিবাহিত নারীর ক্ষেত্রে চুল বাঁধার ধরন ছিল আলাদা আলাদা।

সে রকমই চোখ ঝলসানো সাজে ভিক্টোরিয়ার অন্দরমহলে যখন হাঁটছিলেন সুন্দরীরা, তখন প্রথম শীতের ছোঁয়ায় রোমাঞ্চ জাগার মতোই অনুভূতি হয়। রোহনের এই রেনেসাঁর পোশাকমালায় ছিল রঙের খেলাও। সাদা, অফ হোয়াইট, সবুজ, কালো, বেগনি— কোনও রংই স্রেফ রং হয়ে থাকেনি। মেদিচি পরিবারের নারীদের আত্মবিশ্বাস প্রদর্শন আর নিজেকে উপস্থাপন করার আখ্যান হয়ে উঠেছিল।

কলকাতায় ইটালির দূতাবাসের কনসাল জেনারেল রিক্কার্দো দাল্লা কস্তা অবশ্য ‘ই মেদিচি’-কে নিছক ফ্যাশন শো বলতে নারাজ। তাঁর কথায়, ‘‘এটা আসলে সময়ের ঊর্ধ্বে ওঠা। শাশ্বত লালিত্যের সঙ্গে নবজাগরণের যে সংমেল, সেটাই উদ্‌যাপন করা হয়েছে। এই সন্ধ্যা ইটালির শিল্পকলা এবং ভারতীয় সৃজনশীলতার প্রতীক।’’ কোনও কাজই একার নয়। এই সন্ধ্যার নেপথ্যে থাকা সকল মানুষের নাম করে সে কথাই মনে করিয়ে দিলেন রোহন। ফ্যাশন শো শুধু নয়, এটি ছিল পঁয়তাল্লিশ মিনিটের থিয়েট্রিক্যালও। কারণ, সঙ্গীত, নৃত্যও হাত ধরেছিল ফ্যাশনের। ‘উনা সেরাতা ফিওরেন্তিনা’য় রোহনের তৈরি অনসম্বলের পাশাপাশি এই গোটা অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন কুন্তনীল দাস এবং রোহন পারিয়ার নিজে। কোরিয়োগ্রাফির দায়িত্বে ছিলেন পিঙ্কি কেনওয়ার্দি এবং সুদর্শন চক্রবর্তী। মেক আপ ও চুলের স্টাইলিং করেছেন অভিজিৎ চন্দ। নৃত্য পরিবেশন করে ‘স্যাফায়ার ডান্স কোম্পানি’। দ্য ক্যালকাটা স্কুল অফ মিউজিকের স্ট্রিং অর্কেস্ট্রায় যখন ভিভালদি বা তোস্কানিনির মূর্চ্ছনা ওঠে, তখন সময় সত্যিই থমকে থাকে।

তবে কোথায় অনুষ্ঠান হচ্ছে, সেটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভিক্টোরিয়ার কোয়্যাড্র্যাঙ্গল যখন মিলে গিয়েছে ইটালির পালাৎজোর সঙ্গে, তখন দুই দেশ, দুই শহর বা দুই সময়কালকে আলাদা করা একটু মুশকিলই হয়। কলকাতায় ইটালির দূতাবাসের ভাইস কনসাল জেনারেল দানিয়েলে পানফিলো যেমন বললেন, ‘‘ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ইতিহাস বহন করে। এখানে সময়ও থমকে থাকে। তাই ইতিহাস আর আধুনিকতার গল্প নতুন করে বলার জন্য ভিক্টোরিয়াকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। এই সন্ধ্যা তাই ঐতিহাসিকও।’’

অন্য কোনও শতক থেকে নারীরা এসে হেঁটে যান আর এক শতকে। অন্য কোনও অন্দরের গল্প করে অন্য কোনও সময়। আর এই প্রথম বারের মতো প্রত্যয়ী, যুগ বদলকারী নারীদের দিকে তাকিয়ে থাকে ভিক্টোরিয়ায় পরি।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy