E-Paper

শরীর ও মনকে সুস্থ রাখার মন্ত্র লুকিয়ে আছে মস্তিষ্কের যত্নে

মানবদেহের অপরিহার্য তিন পাউন্ড ওজনের মস্তিষ্ক বুদ্ধিমত্তার কেন্দ্র, ইন্দ্রিয়ের ব্যাখ্যা, দেহের নড়াচড়ার সূচক ও আচরণের নিয়ন্ত্রক। হাড়ের খোলের ভিতরে থাকা এই মস্তিষ্কই মানবিক গুণাবলীর কেন্দ্রবিন্দু।

সুস্মিতা হালদার

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০২৫ ০৮:৪২
শরীর এবং মনের যোগসূত্র হিসাবে মস্তিষ্কের যত্ন জরুরি।

শরীর এবং মনের যোগসূত্র হিসাবে মস্তিষ্কের যত্ন জরুরি। —প্রতীকী চিত্র।

সাম্প্রতিক কালে শরীরকে সুস্থ রাখার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যও আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। তবে শরীর এবং মনের যোগসূত্র হিসাবে মস্তিষ্কের যত্ন জরুরি। শুধু স্মৃতিশক্তি বা চিন্তাশক্তির জন্য নয়। মানসিক স্থিতি, আবেগের নিয়ন্ত্রণ এবং দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে মস্তিষ্কের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মানবদেহের অপরিহার্য তিন পাউন্ড ওজনের মস্তিষ্ক বুদ্ধিমত্তার কেন্দ্র, ইন্দ্রিয়ের ব্যাখ্যা, দেহের নড়াচড়ার সূচক ও আচরণের নিয়ন্ত্রক। হাড়ের খোলের ভিতরে থাকা এই মস্তিষ্কই মানবিক গুণাবলীর কেন্দ্রবিন্দু। এটি আমাদের সমস্ত কাজ ও প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। চিন্তা করতে, অনুভব করতে, স্মৃতি গঠন ও সংরক্ষণ করতে সাহায্য করে— অর্থাৎ, সে সব কিছুই, আমাদের মানুষ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে।

জটিল থেকে জটিলতর ও বৈচিত্র্যপূর্ণ কাজ করতে সক্ষম মস্তিষ্ক। মস্তিষ্কের কার্যবিধি বোঝার জন্য প্রয়োজন তাকে পর্যবেক্ষণ করা, মস্তিষ্কজনিত সম্ভাব্য রোগের লক্ষণ এবং কী ভাবে সুস্থ রাখা যায় সে সব বিষয়ে ধারণা রাখা।

বর্তমান যুগ প্রযুক্তিনির্ভর ও তথ্যভিত্তিক। তাই এই জীবনধারণের সঙ্গে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বজায় রেখে চলার পদ্ধতিগুলির প্রতিও নজর দিতে হবে। বেশ কয়েক বছর ধরে মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে একটি বিষয় উপলব্ধি হয় যে, সুস্থ যাপনের জন্য মস্তিষ্কের যত্ন গুরুত্বপূর্ণ। শরীর সুস্থ রাখতে যেমন যোগাসন, শারীরচর্চার প্রয়োজন, ঠিক সে ভাবেই মস্তিষ্কেরও প্রয়োজন পরিচর্যা ও যত্নের।

সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, সমাজমাধ্যমের কোনও পোস্ট বা তার প্রেক্ষিতে বক্তব্য যেন যুদ্ধের ময়দানে বদলে যাচ্ছে। যেখানে একে অপরের প্রতি অসংযত ভাষার প্রয়োগ, অপমানজনক উক্তি এবং রাগের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানানোর প্রবণতা প্রকট। এই ধরনের কথাবার্তা ও তর্ক-বিতর্ক মস্তিষ্কে অতিরিক্ত উত্তেজনা তৈরি করে, স্ট্রেস হরমোন বাড়ায়, যার ফলে মাথাব্যথা, ঘুমের সমস্যা, মনোযোগের ঘাটতি ও উদ্বেগ তৈরি হয়। দীর্ঘদিন ধরে এই রকম নেতিবাচক পরিবেশে থাকলে মানসিক স্বাস্থ্যে কুপ্রভাব পড়ে। বার বার এই ধরনের বিষয় দেখলে ও তাতে অংশ নিলে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সব এড়াতে আমাদের উচিত, অপ্রয়োজনীয় বিতর্কে না জড়ানো, এবং অন্যের মতামতকে শ্রদ্ধা করা। এর ফলে মানসিক শান্তি বজায় থাকবে এবং সামাজিক সম্পর্কও সুস্থ থাকবে।

মনের সুস্থ থাকার সঙ্গে মস্তিষ্কের সুস্থ থাকার ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে। উদ্বেগ, বিষণ্ণতা ও মানসিক ক্লান্তি মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতার হ্রাসের সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে নেট নির্ভর এই অস্থির সময়ে যখন মানুষ অনেক বেশি অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন, তখন মনে রাখতে হবে, মস্তিষ্ককে আরও সুস্থ রাখার সময় এসেছে। কারণ, সুস্থ মস্তিষ্কই মনের চাপ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে এবং মানসিক স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখতে সক্ষম। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, উদ্দীপক কাজ, সামাজিক যোগাযোগ এবং সচেতন চর্চা নিউরোনের সংযোগ শক্তিশালী করে এবং স্মৃতিভ্রংশের ঝুঁকি কমায়। বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশক্তি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতার চাবিকাঠি। শিক্ষার্থী বা প্রবীণ নাগরিক— সবার জন্যই তীক্ষ্ণ চিন্তাশক্তি অপরিহার্য।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অ্যালঝাইমার’স ও পার্কিনসন’স রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে নিয়মিত ব্যায়াম, সুষম আহার, পর্যাপ্ত ঘুম এবং মানসিক ভাবে সক্রিয় থাকা এই সব রোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমাতে পারে। এ ছাড়াও, আবেগজনিত বুদ্ধিমত্তা ও সামাজিক সম্পর্ক গঠনেও মস্তিষ্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অন্যদের প্রতি সহানুভূতি, যথাযথ যোগাযোগ, এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ— এই সবই মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতার উপর নির্ভর করে।

বিষণ্ণতা, মনের ক্লান্তি, বিষাদ, উদ্বেগ মস্তিষ্কের রাসায়নিক পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মস্তিষ্ক উদ্দীপক কার্যবিধি, সামাজিক যোগাযোগ এবং সচেতন চর্চা, স্নায়ুর সংযোগকে শক্তিশালী করে এবং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। মস্তিষ্ক অত্যন্ত নমনীয় এবং সঙ্গতিপূর্ণ। অর্থাৎ, পরিবেশের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম। মস্তিষ্কের থেকে নিঃসৃত রাসায়নিক পদার্থই স্নায়ু কোষ থেকে অন্য স্নায়ু কোষ, পেশি কোষ বা গ্রন্থিতে সঙ্কেত পরিবহণ করে। সহজ ভাবে বলতে গেলে, এটি একটি স্নায়ু সঙ্কেত বাহক।

তবে মস্তিষ্কের নমনীয়তা হ্রাস পায় প্রাপ্তবয়সে পৌঁছে। তাই নমনীয়তা বা পরিবেশের সঙ্গে পরিবর্তন করার ক্ষমতা বজায় রাখতে বই পড়া, ধাঁধা মেলানো, নতুন ভাষা শিক্ষার পাঠ নেওয়া যেতে পারে। একটি সুস্থ জীবনের জন্য ধ্যান, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকারে লিপ্ত থাকা যেতে পারে। এ ভাবে মস্তিষ্কের যত্ন নিলে শুধু মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিই নয়, আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং উৎপাদনশীলতাও বৃদ্ধি পাবে।

গবেষকেরা এখনও উদ্ঘাটন করে চলেছেন, কী ভাবে একটি সুস্থ মস্তিষ্ক স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে কাজ করে। সুস্থ মস্তিষ্ক এক জন ব্যক্তির সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিনের ছোট ছোট সচেতন অভ্যাস মস্তিষ্ককে শক্তিশালী রাখতে পারে। তাই শরীর ও মনের যত্নের পাশাপাশি মস্তিষ্কের যত্নেও সমান গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে।

সুস্মিতা হালদার (মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক, সেন্ট জ়েভিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Psychology Health

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy