চিত্রাঙ্কন: শৌভিক দেবনাথ।
যে সময়ে স্কুলে পড়েছি, তখনও সরস্বতী পুজোর সঙ্গে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র সম্পর্ক খোঁজার চল হয়নি। প্রাক্-বিশ্বায়ন যুগের সরস্বতী পুজো তো! অন্য রকম ছিল। সকলে অত ভ্যালেন্টাইন্স ডে সম্পর্কে জানতও না। ফলে সে সব তুলনার জায়গা ছিল না। কিন্তু তখনও সরস্বতী পুজো একটা ছাড় পাওয়ার দিন ছিল। ছাড়ের ধরনটা অবশ্য ততটা আধুনিক হয়নি।
সময়টা ’৭০-এর দশকের শেষ, ’৮০-র শুরু। তখনও কো-এড স্কুলে পড়ার চল হয়নি, আমির খানও আসেনি। তখন নারী-পুরুষের মেলামেশার ধরন খুব অন্য রকম ছিল। এই যে এখন কথায় কথায় পাশের স্কুলের পছন্দের মেয়েটিকে দেখা, মেয়েদের স্কুলের গেটের সামনে লাইন দেওয়া, এ সব উঠে আসে সে কালের সরস্বতী পুজো নিয়ে আলোচনায়— তা আসলে কেন হত? চলটা তৈরি হল কোথা থেকে? তা-ও তো ভাবার বিষয়! আসলে তখন বাকি দিনগুলো তো দূরত্ব বজায় রাখার। খোলামেলা মেলামেশা শুরু হয়নি। সবে রাজেশ খন্নাকে ছাপিয়ে অমিতাভ বচ্চনের জনপ্রিয় হয়ে ওঠার যুগ। নায়িকার ধরন বদলাচ্ছে বটে, তবে নায়ক-নায়িকা বন্ধু হয়ে উঠতে পারেনি তখনও।
ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
রাজেশ খন্নার নায়িকাদের তো প্রায় দেখাই যেত না। সে সময়ে সব গগনবিহারী নায়িকা। শুধু নায়কের সঙ্গে গান গাওয়ার জন্য মর্ত্যে আবির্ভূত হত। বাকি সময়টা পর্দায় শুধুই নায়ক। বড় পর্দায় বদল ঘটতে শুরু করল। অমিতাভ বচ্চনের যুগ এল অল্প দিনের মধ্যেই। কিন্তু সময়টা জরুরি অবস্থার ঠিক পর পর। নায়ক তখন ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’। দুনিয়া বদলে দিতে পারে বড় পর্দা জুড়ে থাকা রাগী সেই মানুষটা। কিন্তু নায়িকার বিশেষ ভূমিকা থাকত না সে কাজে। সাজানো একটা উপস্থিতি মাত্র। ফলে তখনও পরভিন বাবিকে দেখে আড়ষ্ট হয়ে যান দিওয়ারের অমিতাভ। আর বাকি দুনিয়ার কাছেও মেয়েদের দেখে আড়ষ্ট থাকাই দস্তুর। নারীদের সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ছিল পৌরুষের বিশেষ মাপকাঠি। যখন-তখন মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে চাওয়া বিশেষ ঠিক কাজ বলে দেখা হত না। কিন্তু তাতে কৌতূহল বাড়ে। যে কোনও কিছুতে আটকালেই যেমনটা হয় আর কি। ফলে যা হওয়ার তা-ই হত!
রাস্তায় মেয়েদের দেখতে পেয়ে দুটো মন্তব্য করা, আওয়াজ দেওয়া, এ সব বেশি ছিল। আর সরস্বতী পুজো ছিল সেই ছাড়ের দিনটা। যে দিন মেয়েরা রাস্তায় সেজেগুজে বেরোবে। শাড়ি পরবে খুদে থেকে কিশোরী। আর ছেলেরা তা দেখবে। হইচই করবে। মজা করবে। দুটো অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য করবে। মেয়েদের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলার চেষ্টা করবে। আমার ততটা সাহস ছিল না, তাই সে দলে যোগ দিইনি। তবে কৌতূহল ছিল না, এমন তো নয়। সময়টাই তো স্বাভাবিক মেলামেশাকে আটকে রাখার ছিল। তাই কৌতূহল বাড়ত। আর তার ফলিত রূপ ছিল সরস্বতী পুজোর দিনের মেয়েদের স্কুলের সামনে ছেলেদের সেই লম্বা লাইন। কখনও কখনও তা আবার হত সিগারেট হাতে!
ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
সে কালের সরস্বতী পুজোর সঙ্গে এ কালের পুজোর আসলে সেটাই অমিল। এমনিতে সরস্বতী পুজো কিন্তু বেশ আটপৌরে আছে এখনও। দুর্গা পুজোর মতো কর্পোরেট হয়ে যায়নি। স্কুলে পড়ার সময়ে যেমন ধরনের পুজো দেখতাম, এখন এত বছর পরে নিজের এলাকার যে সব পুজোয় নেমন্তন্ন রক্ষা করতে যাই, সে সব জায়গায় কিন্তু সেই পুরনো আন্তরিকতা চোখে পড়ে।
তবে ওই যে বললাম। ইতিমধ্যে আমিরের ছবি চলে এসেছে। ‘জো জিতা ওহি সিকন্দর’ পরবর্তী যুগ তো। কো-এড স্কুল, মেয়েদের পাশে বসে ক্লাস করা, একসঙ্গে চকোলেট ভাগ করে খাওয়া— সবের সঙ্গে অভ্যস্ত এখন ছেলেরা। নায়িকাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে শিখেছে। তাই সরস্বতী পুজোর চেহারাও খানিকটা বদলেছে। মেয়েদের স্কুলের সামনে এখনও কোনও ছেলে দাঁড়িয়ে থাকে না, এ তো বলা যায় না। হয়তো থাকে। তবে পছন্দের মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার জন্য সরস্বতী পুজো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। পুজোর দিনটা বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ করে কাটানোর দিন হয়ে থাকে।
ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
সরস্বতী পুজোর দিনটা বিশেষ করে স্কুলপড়ুয়াদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। স্কুলে তো রোজ যাওয়া হয়। কিন্তু এই একটা দিন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে ক্লাসঘরের গাম্ভীর্যের বেড়া ভেঙে মেশা যায়। ফলে স্কুলটা অন্য রকম দেখায়। আনন্দের ধরন বদলায় সময়ের সঙ্গে। সরস্বতী পুজোয় যে হেতু শিশু-কিশোরদের ভূমিকা অনেকটা, তাই হয়তো তার চেহারা ততটাও বদলায়নি। ওই বয়সের আহ্লাদটা তো সহজে বদলায় না, যুগ যতই পাল্টে যাক।
তবে এখন ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র সঙ্গে তুলনা করার মতো জায়গায় তবু গিয়েছে বিষয়টা। বিদেশে ‘নায়ক-নায়িকারা’ তো যৌথ উদ্যোগেই সেই দিনটা পালন করে। প্রেমের দিন একসঙ্গে কাটায়। এখন তেমন তো দেখাই যায় সরস্বতী পুজোর দিনটায়। স্কুল-কলেজে পড়া বাঙালি ‘নায়ক-নায়িকারা’ সরস্বতী পুজোয় একসঙ্গে শাড়ি-পাঞ্জাবিতে ঘুরতে বেরোয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy