হাসপাতালে মায়ের কোলে ছ’মাসের ময়ূখ সিংহ। সঙ্গে ক্যানসার আক্রান্ত আরও শিশু। ছবি: সুমন বল্লভ।
লিভারের ক্যানসার চতুর্থ পর্যায়ে পৌঁছেছে। শুধু তা-ই নয়, তা ছড়িয়ে গিয়েছে ফুসফুসেও। ছ’মাসের একরত্তি শিশু তার দুই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে এমনই মারণ ব্যাধি নিয়ে ভর্তি রয়েছে শহরের এক বেসরকারি ক্যানসার হাসপাতালে। ইতিমধ্যেই দু’টি কেমোথেরাপি হয়ে গিয়েছে। ক্যানসার চিকিৎসকেরা মনে করছেন, আরও একটু আগে অসুখটা ধরা পড়লে হয়তো এতটা ছড়াতে পারত না।
শিশুটির বাবা-মা বলছেন, দু’মাস বয়স থেকেই সন্তানের ফুলে ওঠা পেট নিয়ে একাধিক ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু কেউই রোগটা ধরতে পারেননি। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, শিশুদের ক্যানসার নিয়ে কি এখনও যথেষ্ট সচেতনতা তৈরি হয়নি খোদ চিকিৎসকদের মধ্যে? নাকি রোগ ধরা না পড়ার অন্য কোনও কারণ রয়েছে?
দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজের বাসিন্দা ছ’মাসের ময়ূখ সিংহ যে চিকিৎসকের অধীনে ভর্তি, সেই আশিস মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘শিশু ক্যানসার রোগীর সংখ্যাটা আগের তুলনায় অনেকটাই বাড়ছে। পরিবেশ দূষণের কারণে জিনের পরিবর্তন ঘটে ক্যানসার ছড়াচ্ছে বলে আমাদের অনুমান। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে চিকিৎসার ফল অনেকটাই ভাল মেলে। কিন্তু বহু সময়েই আমাদের কাছে যখন আসছে, তখন অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে।’’
যেমন, দিন কয়েক আগেই ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চোখের ক্যানসার (রেটিনোব্লাস্টোমা) নিয়ে এসেছিল তিন বছরের একটি শিশু। তারও অসুখ পৌঁছে গিয়েছিল চতুর্থ পর্যায়ে। ন্যাশনালে তার অস্ত্রোপচার করেছেন যে চিকিৎসক সেই জ্যোতির্ময় দত্ত বলেন, ‘‘এই সব ক্ষেত্রে বেড়ালের চোখের মতো জ্বলতে থাকে শিশুর চোখ। এতে অনেক আগেই অসুখটা ধরা পড়া উচিত ছিল। বাড়ির লোক দেরি করেছেন। সংশ্লিষ্ট শিশু চিকিৎসকও দেরি করেছেন। ওর চোখটা তুলে ফেলতে হল। আগে এলে চোখটা বাঁচানো যেত।’’ আর দেরি করলে শিশুটির মস্তিষ্ক এবং যকৃতেও ক্যানসার ছড়িয়ে পড়তে পারত বলে মনে করছেন জ্যোতির্ময়বাবু।
শিশুদের সাধারণত রক্ত, লিম্ফ গ্ল্যান্ড এবং চোখের ক্যানসার বেশি হয়। মাঝেমধ্যে কিডনিতেও ক্যানসার হয়। ক্যানসার হয় মস্তিষ্কেও। সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, এর মধ্যে ৭০ শতাংশেরও বেশি ধরা পড়ে তৃতীয় বা চতুর্থ পর্যায়ে।
কেন এই দেরি? ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় মনে করছেন, অভিভাবক এবং ডাক্তার— দুই তরফেই শিশুদের ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা অনেকটাই কম। তিনি বলেন, ‘‘কেউ ভাবতেই চায় না শিশুর ক্যানসার হয়েছে। যেমন মায়েরা বাচ্চা ফরসা হতে শুরু করলে খুশি হয়ে যান। কিন্তু যে বাচ্চা কালো ছিল, আচমকাই ফরসা হতে শুরু করল— তার নিশ্চয়ই কোনও অস্বাভাবিকতা রয়েছে। পরীক্ষা করলে হয়তো জানা যাবে, রক্তের ক্যানসার।’’
ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য প্রশ্ন তুলছেন, বাইরে থেকে অস্বাভাবিকতা বুঝতে না পারলে কী ভাবে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন বাবা-মায়েরা? বাচ্চারা তো নিজেরা কষ্ট বুঝিয়ে বলতে পারে না। শুধু কাঁদে। যেমন, কিডনির টিউমার। বাইরে থেকে বোঝার উপায় থাকে না। তার পর পেট অনেকটা ফুলে ওঠার পরেও অনেকে বলেন, পেট ফেঁপেছে। তা হলে উপায়? সুবীরবাবুর পরামর্শ, ‘‘বাচ্চা যত ক্ষণ ছটফটে আছে, খাওয়াদাওয়া করছে, মলমূত্র ত্যাগ ঠিকঠাক হচ্ছে তত ক্ষণ চিন্তা নেই। তা না হলেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া দরকার। সব সময়ে যে ক্যানসার ধরা পড়বে, তা একেবারেই নয়। কিন্তু যা-ই হোক না কেন, সমস্যাটা চিহ্নিত করা যাবে।’’ তিনি জানালেন, চোখের ওই ‘রেটিনোব্লাস্টোমা’ ক্যানসারটি বহু ক্ষেত্রেই বংশগত। তাই পরিবারে কারও ওই ক্যানসার থাকলে অন্য শিশুদেরও পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া ভাল।
শিশুদের ক্যানসার যে বাড়ছে এবং রোগ নির্ণয়ে বিলম্ব যে বহু ক্ষেত্রেই জটিলতা তৈরি করছে তা মেনে নিয়েছেন ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ-এর অধিকর্তা অপূর্ব ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘শিশুদের ক্যানসারের উপসর্গ খুবই অস্পষ্ট থাকে। তাই সহজে ধরা পড়ে না। তা ছাড়া কোনও বাচ্চার চিকিৎসার গোড়াতেই যদি ক্যানসার বলে সন্দেহ করতে শুরু করি, তা হলে বাবা-মায়েরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়বেন। তাই আমাদেরও নিজস্ব বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে কাজ করতে হয়।’’ তাঁদের ইনস্টিটিউটে মৃণালিনী ক্যানসার রিসার্চ সেন্টার নামে শিশুদের ক্যানসারের একটি পৃথক কেন্দ্র খুলতে চলেছেন অপূর্ববাবুরা। টাটা ক্যানসার সেন্টারের প্রযুক্তিগত সহায়তায় ওই কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হবে। অপূর্ববাবু জানান, কলকাতার মেয়ে মৃণালিনী ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চার বছর বয়সে মারা গিয়েছিল। তার চিকিৎসার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন বহু মানুষ। মূলত সেই অর্থেই গড়ে উঠবে ওই প্রতিষ্ঠান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy