Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
mental stress

লকডাউনে মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিন, তরতাজা মন তৈরি করবেন কী করে?

করোনার মতোই, মাথার ভেতর বেড়ে চলা অন্ধকার লুকিয়ে রাখেন অনেক মানুষ।

বাড়িতে কাজের পরিবেশ বজায় রাখুন।

বাড়িতে কাজের পরিবেশ বজায় রাখুন।

সংহিতা সান্যাল
শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০২০ ১৬:৩৭
Share: Save:

কোভিড-১৯ শরীরের পক্ষে কতটা ক্ষতিকারক, তা এত দিনে সবাই জেনে গিয়েছেন। কিন্তু লকডাউন উঠে গেলে দেশ পরবর্তী যে বিপদের মুখে পড়বে, তা হল দীর্ঘ গৃহবন্দি জীবনে জন্মানো একগুচ্ছ মানসিক অসুস্থতা। এমনিতেই মনের অসুখ নিয়ে যথেষ্ট সচেতনতা আমাদের দেশে নেই। থেরাপিস্ট, সাইকোলজিস্ট এবং সাইকিয়াট্রিস্ট— তিন জনকেই ‘পাগলের ডাক্তার’ মনে করা হয়। কর্মক্ষেত্রে ডিপ্রেশনের কথা জানাজানি হয়ে গেলে কর্তৃপক্ষ সুনজরে দেখবেন না, এমন ভয়ও পান অনেকে। ফলে করোনার মতোই, মাথার ভেতর বেড়ে চলা অন্ধকার লুকিয়ে রাখেন অনেক মানুষ।

• গৃহবন্দি থাকতে থাকতে অনেকেরই ক্লস্ট্রোফোবিক (claustrophobic) লক্ষণ দেখা দেয়। চার দেওয়ালের বাইরে যাওয়ার জন্য মন উতলা হয়ে ওঠে, দম আটকে আসে, শারীরিক অসুস্থতা দেখা দেয়।

• যাঁরা অন্তর্মুখী স্বভাবের, বাড়িতে অনেক মানুষের সঙ্গে আটকে পড়লে তাঁদের প্রবল অস্বস্তি হয়, যা সামাজিক সৌজন্যের কারণে প্রকাশ করা যায় না। যাঁরা ঠিক উল্টো স্বভাবের ও মিশুকে, তাঁরা বিপদে পড়েন যদি বাড়িতে সামান্য কয়েক জন সদস্য থাকেন। যথেষ্ট সামাজিক মেলামেশার সুযোগ না থাকায় তাঁরা ক্রমশ বিরক্ত হতে থাকেন। ফলে বদমেজাজ, খিটখিটে স্বভাব, অল্পেই রেগে যাওয়া ইত্যাদি ঘটতে থাকে। অল্পবয়সীদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও বেশি।

আরও পড়ুন: লকডাউনে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বদল আনুন ব্রেকফাস্টে, পাতে থাকুক এ সব

• যাঁদের ঘর থেকে কাজ করতে হচ্ছে, বিশেষত মহিলা, তাঁরা যদি কাজের সহায়ক পরিবেশ না পান, মানসিক চাপ অসম্ভব বেড়ে যায়। কাজে বাধা পড়ার দুশ্চিন্তা, কাজকর্ম সারার আগে-পরে নিয়মিত সাংসারিক কাজ, অফিস টাইমের বাইরে কাজ এলে পরিবারের অসন্তোষের মুখে পড়া— যে কাউকে উদ্বেগে রাখার পক্ষে যথেষ্ট। বাড়িতে সাহায্যকারী পরিচারক বা পরিচারিকা না আসার ফলে এই সমস্যা এক বিরাট স্ট্রেসের জন্ম দিচ্ছে নিরন্তর।

বাড়ি থেকে কাজে সরিয়ে রাখুন মানসিক উদ্বেগ।

• যাঁদের বাড়িতে অশান্তির পরিবেশ আগে থেকেই বিরাজমান, তাঁদের কাছে এই লকডাউন নরকের সমতুল্য। অপছন্দের মানুষের সঙ্গে বিরক্তিকর পরিবেশে দিনের পর দিন কাটানো মানসিক অস্বাস্থ্যের আঁতুড়ঘর।

• ফোনের প্রতি আমাদের নির্ভরতা এই সময়ে আরও বাড়ছে। হয়তো লকডাউন ওঠার পরেও এই অভ্যাস স্থায়ী হয়ে যাবে। সময় কাটানোর জন্য অন্য মানুষের চেয়ে স্মার্টফোন-ভিত্তিক বিনোদনে সবাই অভ্যস্ত হয়ে যাবেন।

• দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতায় কাটাতে কাটাতে অনেকেই তাঁদের কষ্টার্জিত সোশ্যাল স্কিল এবং কমিউনিকেশন স্কিল হারিয়ে ফেলবেন।

আরও পড়ুন: বাড়ি থেকে কাজই কি এখন নতুন কর্মসংস্কৃতি

ঝগড়াঝাঁটি নয়, বাড়ির পরিবেশ সুস্থ রাখুন।

এই সমস্যাগুলির দিকে আমাদের এখন থেকেই মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ করা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন মহিলা ফ্যাকাল্টি, যিনি কি না পূর্ণ সময় একা থাকছেন, তাঁর তরফে কিছু মতামত রইল।

• বাড়িতে যত ক্ষণ থাকবেন, খোলা জানলা বা বারান্দার পাশে থাকুন। আকাশ দেখুন। সামান্য শরীরচর্চা করুন ছাদে বা বারান্দায়।

• বাড়িতে থাকা প্রতিটি সদস্যের কমফর্ট জোন বোঝার চেষ্টা করুন। যে আত্মমগ্ন, তাকে অকারণ হইচইয়ের মধ্যে ফেলবেন না। যে বাইরে যেতে না পেরে মুষড়ে পড়ছে, তার সঙ্গে সময় কাটান। বাড়ির কমবয়সিটি ফোনে বা ভিডিয়ো কলে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে দেখলে বকাবকি করবেন না। এটা এখন তার প্রয়োজন, বিলাসিতা নয়। প্রয়োজনে বাড়ির সবাই বসে স্থির করে নিন, কে কী ভাবে সময় কাটাতে চায়। কথা বলুন নিজের অসুবিধা নিয়ে।

• যে মানুষটিকে অফিসের কাজ করতে হচ্ছে, তার ঘরের কাজের ভার নিন। তাকে একটা শান্ত, নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশ দিন। যে কাজ আপনি বা অন্য কেউ করতে পারে, তার জন্য তাকে বার বার ডাকবেন না। এমন একটা ঘর বা ডেস্ক তাকে দিন যেখানে বাকিদের যাওয়া বারণ করে দেওয়া হবে। ঘুম থেকে উঠে তাকে প্রস্তুত হওয়ার সময় দিন। অফিসের কাজের পর কিছুটা বিশ্রাম নিতে দিন। চা বানানো, রান্না, বাসন মাজা, ঘর সাফ, এগুলো ভাগ করে নিন। মনে রাখবেন, সে পরিশ্রম করছে যাতে বাকিরা ভাল থাকে। তার দক্ষতার প্রশংসা করুন। তার সমস্যা হলে গুরুত্ব দিয়ে সমাধান করুন।

• যদি বাড়িতে অপ্রীতিকর পরিবেশ থাকে, সচেতন ভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। কোনও কথা কাটাকাটি, তর্ক, ঝগড়ায় থাকবেন না। অপছন্দের মানুষটির মুখোমুখি হবেন না। নিজেকে কাজ দিন এবং মন ঘুরিয়ে নিন। এই পরিস্থিতি এক দিন কেটে যাবে যদি সামান্য বোঝাপড়া করে নেন— এই ভাবনা নিয়ে খুশিমনে কাটানোর চেষ্টা করুন।

• সময় দিন। একসঙ্গে সিনেমা দেখুন। কোনও ভাল ভিডিয়ো বা আর্টিকল পেলে পড়ে শোনান। যে ছেলেটি বা মেয়েটি অনলাইনে পড়াশোনা করছে তার পাশে বসে আপনিও কয়েকটা ক্লাস করুন। ফোন ব্যবহার করতে হচ্ছেই যখন, আত্মীয়বন্ধুদের খবর নিন। ভার্চুয়াল পৃথিবীতে ঘুরতে ঘুরতে কিছু বাস্তব চরিত্রের সামনেও আসুন। তাতে মনের ভারসাম্য বজায় থাকে।

• অনেক অনেক কথা বলুন। পরিবারের সঙ্গে, সহকর্মীর সঙ্গে, ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে। নিজেকে মানসিক ভাবে অন্তত বিচ্ছিন্ন ভাববেন না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রেজেন্টেশন অভ্যাস করুন, অনলাইন লেকচারের মহড়া দিন। ফাঁকা সময়ে কাজের বিষয়ে ভিডিয়ো বানান। টেড টক শুনুন। গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতি নিয়ে বাড়ির সবার সঙ্গে আলোচনা বা বিতর্কের আয়োজন করুন। যত বেশি কথা বলবেন, তত আপনার চর্চা বাড়বে।

আমাদের সমবেত উদ্দেশ্য, একটা স্বাস্থ্যোজ্জ্বল আগামী তৈরি করা। শরীরের পাশাপাশি একটা তরতাজা মন নিয়ে যেন আমরা সবাই কর্মক্ষেত্রে ফিরতে পারি, আমাদের ছাত্রছাত্রীরা যেন পূর্ণ উদ্যমে জীবনের মূল স্রোতে ফিরতে পারে।

(লেখক শিক্ষক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mental Stress COVID-19 coronavirus Health Tips
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE