Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Mycobacterium indicus pranii

মাইকোব্যাকটেরিয়াম কী? কোভিডের চিকিৎসায় কতটা কাজে আসবে এই ওষুধ?

এই ওষুধের আবিষ্কারক  গুরশরণ প্রাণ তলোয়ার ভারতীয় জীববিজ্ঞানী।

কোভিড-যুদ্ধে মাইকোব্যাকটেরিয়াম ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে। ফাইল চিত্র।

কোভিড-যুদ্ধে মাইকোব্যাকটেরিয়াম ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে। ফাইল চিত্র।

সুজাতা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ মে ২০২০ ১৪:২৬
Share: Save:

সারা পৃথিবী যখন কোভিডের ওষুধ ও প্রতিষেধক খুঁজে চলেছে, মাইকোব্যাকটেরিয়াম-ডব্লিউ নামের ওষুধ সেখানে আর একটু আশার আলো দেখাল। মাইকোব্যাকটেরিয়াম-ডব্লিউ মূলত কুষ্ঠের ওষুধ৷ প্রথমে কুষ্ঠের জন্য ব্যবহার হলেও পরবর্তীতে ব্যবহার হতে লাগল টিবি রোগের প্রতিষেধক হিসেবে৷ তার পর এই ওষুধ ব্যবহার করা হয় ক্যানসারে৷ ব্লাডার ক্যানসারে মৃতপ্রায় রোগীরা প্রাণ ফিরে পেলেন এই ওষুধের ছোঁয়ায়৷ এ বার এল কোভিডের পালা৷

পিজিআই চণ্ডীগড়ের চিকিৎসক-বিজ্ঞানীরা চার জন গুরুতর অসুস্থ কোভিড রোগীর উপর পর পর তিন দিন ০.৩ মিলি মাত্রায় এই ওষুধ ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করেন। দেখা যায়, রক্তে যে সংক্রমণের বিষ মারাত্মক ভাবে ছড়িয়েছিল, তার মাত্রা কমতে শুরু করেছে৷ শরীরের আভ্যন্তরীন প্রত্যঙ্গদের অকেজো হওয়ার হারও কমেছে কিছুটা৷ ওষুধের বিরূপ প্রতিক্রিয়াও হয়নি৷ ফলে কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাসট্রিয়াল রিসার্চের তত্ত্বাবধানে ‘ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অব ইন্ডিয়া’-র অনুমতিক্রমে শুরু হয়ে গেল মাইকোব্যাকটেরিয়াম-ডব্লিউ নিয়ে ক্লিনিকাল ট্রায়ালের প্রস্তুতি পর্ব৷ তাতে সীলমোহর পড়ল এফডিএ এবং আইসিএমআর-এর৷

কী ভাবে হবে এই ক্লিনিকাল ট্রায়াল

আপাতত ঠিক করা হয়েছে, মোট তিনটি পর্যায়ে এই ট্রায়াল হবে। চলবে তিনটি আলাদা সেন্টারে৷ পিজিআই চণ্ডীগড়ে, অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্স, ভোপাল ও দিল্লিতে৷

আরও পড়ুন: হার্ড ইমিউনিটি-ই কি করোনার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে আমাদের?

• প্রথম পর্যায়ে ট্রায়াল হবে পিজিআই চণ্ডীগড়ে। আইসিইউ-তে ভর্তি ৫০ জন জটিল কোভিড রোগীর উপর৷ তার মধ্যে অর্ধেক রোগীকে দেওয়া হবে এই ওষুধ ও অর্ধেক রোগীকে প্ল্যাসিবো অর্থাৎ ওষুধের মতো দেখতে কিন্তু ওষুধ নয় এমন কিছু। এ ক্ষেত্রে তা নুন-জল৷ অন্যান্য চিকিৎসা যেমন চলছিল তেমনই চলবে৷ ৩-৪ সপ্তাহ রোগীদের খুব ভাল ভাবে নজরে রাখা হবে৷ তাঁরা কতটা সেরে উঠছেন, অক্সিজেনের চাহিদা কমছে কি না, ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন কমছে কি না, প্রত্যঙ্গেরা হারানো কার্যকারিতা কতটা ফিরে পাচ্ছে, মৃত্যুহার কতটা কমছে ইত্যাদি৷

• দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে যোগ দেওয়ার জন্য ৫০০ জন এমন মানুষকে বেছে নেওয়া হবে যাঁরা কোভিড রোগীর ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে রয়েছেন, অথচ এখনও কোনও উপসর্গ হয়নি৷ কোভিড রোগীর আত্মীয় ও হাসপাতালের কর্মীদের মধ্যে থেকেই বাছা হবে এঁদের৷ ওষুধ দিয়ে দেখা হবে রোগের বিরুদ্ধে তাঁদের পুরোদস্তুর বা আংশিক প্রতিরোধ গড়ে উঠল কি না৷

• তৃতীয় পর্যায়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন অথচ রোগ তত জটিল নয়, এমন রোগীদের দিয়ে দেখা হবে কত তাড়াতাড়ি তাঁরা সেরে উঠলেন, কত জনের অবস্থা খারাপ হল, কত জনের আইসিইউ-এর প্রয়োজন হল কত জনের হল না ইত্যাদি খুঁটিনাটি৷

সিএসআইআর-এর কোভিড-১৯ কার্যক্রমের কোঅর্ডিনেটর রাম বিশ্বকর্মা জানিয়েছেন, “প্রথম ট্রায়ালটির ফলাফল বুঝতে ৩৫-৪০ দিনের মতো সময় লাগবে৷ তাতে আশানুরূপ ফল পেলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শুরু হবে৷” অর্থাৎ মাইকোব্যাকটেরিয়াম-ডব্লিউ ওষুধ হিসেবে কাজ করবে কি না বা কতটা করবে তা যেমন দেখা হবে, প্রতিষেধক হিসেবে তার ভূমিকাও দেখা হবে খতিয়ে৷

মাইকোব্যাকটেরিয়াম-ডব্লিউ নিয়ে চলছে গবেষণা।

ওষুধ ও প্রতিষেধক: মাইকোব্যাকটেরিয়াম-ডব্লিউ

যে কারণটির জন্য মাইকোব্যাকটেরিয়াম ওষুধ এবং প্রতিষেধক দুই হিসেবেই কাজ করার ক্ষমতা রাখে, তা হল ইমিউনোমডিউলেশন৷ এটি ইমিউনোমডিউলেটরি ড্রাগ৷ অর্থাৎ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে সে প্রয়োজনমতো বাড়াতে-কমাতে পারে৷ ফলে গুরুতর রোগীর শরীরে যখন জীবাণুকে হারানোর চেষ্টায় প্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মক বেড়ে যায়, নানা রকম রাসায়নিক হু হু করে বেরিয়ে শরীর জুড়ে বিরূপ প্রভাব ফেলে, যাকে বলে ‘সাইটোকাইন স্টর্ম’, সেই বেড়ে যাওয়া প্রতিরোধ ক্ষমতাকে এই ওষুধ কমিয়ে এমন মাত্রায় নিয়ে আসতে পারে যাতে জীবাণুও মরে, সঙ্গে কমে শরীর জুড়ে এই ক্ষতির হার৷ এই কারণের জন্য গুরুতর কোভিড রোগীর চিকিৎসায় এই ওষুধের ভূমিকা থাকতে পারে বলে ভাবছেন বিজ্ঞানীরা৷

আরও পড়ুন: বিবর্তিত হতে হতে করোনা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে, বলছে গবেষণা

অন্য দিকে আবার প্রয়োজনে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও পারে সে৷ ফলে যে সব মানুষের রোগের আশঙ্কা রয়েছে, অথচ রোগ এখনও হয়নি, তাঁদের শরীরে প্রয়োগ করলে সে জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যতটা প্রতিরোধ শক্তি দরকার, ততটার জোগান দিতে পারে৷ হালকা ও মাঝারি অসুস্থ রোগীদের ক্ষেত্রেও তার এই একই কাজ৷ জীবাণুর পরিমাণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, যাতে রোগ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যেতে না পারে, রোগী সুস্থ হতে পারেন চটপট৷

সত্যিই কি সে এত কিছু করে উঠতে পারবে? ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ সৌতিক পান্ডা জানিয়েছেন, “কয়েক প্রজাতির ইনফ্লুয়েঞ্জার বিরুদ্ধে এই ওষুধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। কাজেই আশা করা যেতেই পারে যে সে কোভিডের বিরুদ্ধেও কাজ করতে পারবে৷’’

চিকিৎসকদের মতে, যে সব দেশে জন্মের পরই টিবি ঠেকাতে এই ওষুধ ভ্যাকসিন হিসেবে দেওয়া হয় (বিসিজি ভ্যাকসিন) কিছু দেশে। যেমন, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্থান, ইথিওপিয়া, ইজিপ্ট, সাউথ কোরিয়া ও সাউথ ইস্টের অন্যান্য দেশ। এই সব দেশে কোভিডের ভয়াবহতা বিসিজি না নেওয়া দেসের তুলনায় অনেক কম। কাজেই রোগ প্রতিরোধ, এমনকি, ওষুধ হিসেবেও মাইকোব্যাকটেরিয়াম-ডব্লিউ-এর ভূমিকা থাকা অসম্ভব কিছু নয়৷ তবে প্রথম ট্রায়াল শেষ না হওয়া অবধি ঘটনার গতিপ্রকৃতি বোঝা সম্ভব নয়৷

দেশজ ওষুধ মাইকোব্যাকটেরিয়াম-ডব্লিউ

এ ওষুধের আবিষ্কারক গুরশরণ প্রাণ তলোয়ার ভারতীয় জীববিজ্ঞানী। তাঁর নাম ও আমাদের দেশের নাম যুক্ত হয়ে এই ওষুধের নাম ‘মাইকোব্যাকটেরিয়াম ইন্ডিকাস প্রাণীই’ বা সংক্ষেপে ‘এমআইপি’৷ কুষ্ঠ নিয়ে জেরবার থাকার কালে, সেই ১৯৭০ সালে, জীববিজ্ঞানী তলোয়ার ও তাঁর সতীর্থরা এই জীবাণুর আদ্যোপান্ত বুঝে তাকে কুষ্ঠের প্রতিষেধক হিসেবে গড়ে তোলেন৷ এর পর সময়ের সঙ্গে যত এই ওষুধের অন্যান্য গুণের খবর প্রকাশ্যে এসেছে, তত সে ব্যবহৃত হয়েছে টিবির প্রতিষেধক হিসেবে, ক্যানসারের চিকিৎসায়৷ কোভিডের সঙ্গে লড়াইয়ে আজ এই ওষুধের দিকে তাকিয়েও আশায় বুক বাঁধছেন বিজ্ঞানীরা।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE