Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Durga Puja Sarees

পুজোয় দক্ষিণ ভারত, বেনারসকে টক্কর দিচ্ছে গুজরাত! শাড়ি বিকিকিনির মোড় ঘুরল কেন? 

বাঙালিদের শাড়ির ব্যবসাটুকু অন্তত আগের মতো আছে তো? এ বছর কেমন হচ্ছে বিক্রি? অতিমারির পর জমেছে কি পুজোর বাজার?

এ বছর পুজোয় বাঙালিদের শাড়ির বাজারে টক্কর দিচ্ছে কোন শাড়ি?

এ বছর পুজোয় বাঙালিদের শাড়ির বাজারে টক্কর দিচ্ছে কোন শাড়ি? ছবি: সংগৃহীত

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৯:০১
Share: Save:

বাংলার পুজোর বাজারের সুতো গুজরাতের হাতে! বাঙালির ব্যবসা হয় না। এ কথা যত জন যত বার বলুন না কেন, পুজোর গড়িয়াহাট-কলেজ স্ট্রিট-নিউ মার্কেট দেখলে তা বোঝা যেত না। শাড়ির দোকানে ঠেলাঠেলি। মারামারি। হাতাহাতি। একই শাড়ি ধরে তিন জনের টানাটানি! কত কী না দেখেছে এ শহর। তিন-চার প্রজন্ম ধরে সে সব শাড়ির দোকানের বাড়তে থাকা পরিসর বলে দেয়, সে কালে ব্যবসা মন্দ হয়নি। তবে অতিমারির দু’বছর প্রশ্ন তুলেছে। ভিড় কি যথেষ্ট? এ বছর কেমন হচ্ছে বিক্রি? বাঙালিদের শাড়ির ব্যবসাটুকু অন্তত আগের মতোই আছে তো? ধাক্কা কঠিন। যাতায়াত কমেছে। অনলাইনে কেনাবেচা বেড়েছে। তার চেয়েও বেশি কমেছে ক্রেতাদের পকেটের জোর। তাই রকমারি জিনিস আনলেই যে ব্যবসার চমক বাড়বে, এমন নয়। দু’বছর পরেও পুজোর বাজার সে কথা বার বার মনে করাচ্ছে। ‘‘ভিড় দেখে ভুলবেন না। ব্যবসা তেমন নেই,’’ বক্তব্য গড়িয়াহাটের ফুটপাথের ধারে এক চিলতে জায়গা নিয়ে তৈরি হওয়া একটি শাড়ির দোকানের কর্মী প্রতাপ পালের। বিক্রি কি সামগ্রিক ভাবেই মন্দ? প্রতাপের মুখ শুকনো। বলেন, ‘‘বড় দোকানের ব্যাপার আলাদা। আমাদের পরিস্থিতি এখনও তেমন ভাল নয়। খুব সস্তার কিছু শাড়ির চাহিদা রয়েছে। বাকি তো পড়েই আছে।’’ ফুটপাথে টিপ-দুল-সেফটি পিন কেনার জটলা দফায় দফায় ঠেলে পৌঁছে যাওয়া গেল ‘গড়িয়াহাটার মোড়ের শোভা’, বাঙালির পরিচিত দোতলা দোকানটিতে।

হিসাবের ল্যাপটপ আগলে বসে আছেন বাহাত্তরের রতন সাহা। বলেন, ‘‘এক সময়ে কেউ আমাদের ভুলতে পারতেন না। প্রতি পুজোয় ঘুরে ঘুরে আসতেন মহিলারা। এখন অবশ্য অনলাইনের যুগ। দোকানে কম লোকে আসেন। করোনার সময়ে দু’বছর বিক্রি খুব কম ছিল। মাঝে আমার বউমাও অনলাইনে কাজ করল। এখন লোকে একটু একটু করে বাজারে ফিরছে। তবে ২০১৯ সালের আগে যেমন ব্যবসা ছিল, তা আর কখনও হবে কি না কে জানে!’’ এখনও বড় দোকানের দামি শাড়ি কেনার অবস্থা ফিরে পাননি সাধারণ মানুষ। তাই ব্যবসার হালও ফিরছে না। এমনই বক্তব্য ৫০ বছর ধরে শাড়ি কেনাবেচায় যুক্ত থাকা রতনের। অতিমারির ধাক্কার জেরে কি তবে কলকাতা আর থাকছে না শাড়ির শহর হয়ে? সে ব্যবসাও টিকিয়ে রাখতে পারবেন না বাঙালিরা?

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারলে তবেই ব্যবসা থাকবে বলে মনে করেন ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের শাড়ি বিপণির কর্ণধার সৌমজিৎ লাহা। তিনি পুরনো ভাবনায় আটকে থাকতে চান না। পরিস্থিতি বদলালে সে বদলের সঙ্গে পা মেলানোয় বিশ্বাসী তিনি। তাই পুজোর বাজার খারাপ যাচ্ছে না তাঁদের। পুরনো পরিস্থিতি প্রায় ফিরে এসেছে বললেই চলে। মুনাফা একটু একটু করে বাড়ছেও। তিনি বলেন, ‘‘এখন যেমন সুরাটের শাড়ি আনছি বেশি করে। ওখানে কম দামে সব ধরনের কাপড় তৈরি হয়। দক্ষিণে যে ধরনের শাড়ি কিনতে হবে ১৪-১৫ হাজার টাকায়, সুরাটে তেমন শাড়ির দাম হবে হাজার পাঁচেক। আরও কমেও সুন্দর সিল্কের শাড়ি পাওয়া যায়।’’

সৌমজিৎও উৎসাহ নিচ্ছেন গুজরাতের শাড়ি কেনায়। নিজেদের খরচ বাঁচাতে নয়। খদ্দের ধরে রাখতেই। ব্যবসার গতি তবেই বাড়বে। কারণ লকডাউনের পর দামি শাড়ি কেনার ভিড় কমেছে। এ দিকে সিল্ক-সুতি, সব ধরনের সুতোর দাম বেড়েছে। সাবেক শাড়ি কিনতে খরচ বেশি হয়। যত বেশি সাধ্যের মধ্যে শাড়ি এনে দিতে পারবেন কলকাতার ক্রেতাদের কাছে, ততই ব্যবসা চালু থাকবে। সে ভাবনা থেকেই ‘পিয়োর সিল্ক’-এর পাশাপাশি সুরাটের সিল্কে ভরছে ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের দোতলা বিপণির তাকের পর তাক।

সুরাটে কম দামেও সুন্দর সিল্কের শাড়ি পাওয়া যায়।

সুরাটে কম দামেও সুন্দর সিল্কের শাড়ি পাওয়া যায়। ছবি: সংগৃহীত

ইনস্টাগ্রামেও পেজ আছে কলকাতা শহরের সবচেয়ে পুরনো শাড়ির দোকানের তালিকাভুক্ত এই দোকানের। ঊনিশ শতকের শেষের দিকে তৈরি এই বিপণির অনলাইন কেনাবেচায় নির্ভর করতে হয় না এখনও। তবে আগামী দিনে যদি সে দিকেই ঘোরে ব্যবসার বাঁক, তবে তা নিতেও আপত্তি নেই। যুগের দাবি মেনে চলাই কর্ণধারের কাছে ব্যবসায় ভাল করার সবচেয়ে বড় মন্ত্র। সে কারণেই এখন তিনি সুরাটের শাড়ি আনার দিকে মন দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘অনেক বেশি মানুষ কিনতে পারছেন সেখানকার শাড়ি। যাঁর আসল কাঞ্জিভরম, বেঙ্কটগিরি কেনার সাধ্য নেই, তিনি কি সাজবেন না? সুরাট থেকে আনা সিল্ক আসলের মতো হয় না। মান তো কিছুটা কম বটেই। তাই আমরা আগের মতো দক্ষিণ ভারত বা বেনারসের শাড়িও যথেষ্ট রাখি। তবে কম দামি বিকল্পও রাখতে হচ্ছে। লকডাউন পরবর্তী সময়ে অনেকেরই ক্রয়ক্ষমতা কমেছে।’’

সুরাটে এখন সব প্রদেশের শাড়ির প্রতিলিপি তৈরি হয়। বেনারসি কাজ করা জর্জেট থেকে দক্ষিণের চওড়া পাড় সিল্ক, বাংলার জামদানি— সব ধরনের শাড়ি অবিকল তৈরি করে ফেলছে সুরাটের বিভিন্ন কারখানা। তুলনায় কম দামি সুতো ব্যবহার করা হচ্ছে। আসল সিল্ক বা সুতি নয়। কিন্তু দেখতে আসলের মতো। তাতে খরচ কম হচ্ছে। অনলাইনে শাড়ি বিক্রি করেন পারমিতা মিত্র। তিনি জানালেন, সুরাটে তৈরি চওড়া পারের গঙ্গা-যমুনা সিল্ক দু’-তিন হাজার টাকাতেও পাওয়া যায়। পরলে একেবারে দক্ষিণের সিল্কের মতো দেখায়। পারমিতার বক্তব্য, ‘‘কম খরচে জমকালো শাড়ি কিনতে পছন্দ করছেন অনেকেই।’’

কম খরচে জমকালো শাড়ি কিনতে পছন্দ করছেন অনেকেই।

কম খরচে জমকালো শাড়ি কিনতে পছন্দ করছেন অনেকেই। ছবি: সংগৃহীত

তেমন শাড়ি রাখছেন শাড়ির আদি বিপণির কর্ণধার সঞ্জয় সাহাও। আগে সুরাটের শাড়ি আনতেন না, এমন নয়। তবে তখন রকমারি পাওয়া যেত না সেখানে। সাধারণত কম দামি শিফন, জর্জেট কিনে আনতেন। কলকাতায় বর্ষাকাল ছাড়া সে সব শাড়ি বিক্রি হত না। পুজোয় তো নয়ই। সঞ্জয় বলেন, ‘‘এখন অনেক রকম শাড়ি তৈরি হয় সুরাটে। দামেও কম। বেঙ্গালুরু আর বেনারসে যেমন যাই, তেমন সুরাটেও যাই পুজোর স্টক তুলতে।’’ সুরাটের শাড়ি বিক্রি হচ্ছে বেশি। সঞ্জয় দেখেছেন, সামগ্রিক ভাবে ব্যবসার হালও ফিরছে। গত দু’বছরের অবস্থা আর নেই। আর কিছু দিনেই অতিমারির আগের সময়ের জায়গায় পৌঁছে যাবে বিক্রি। প্রায় চার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল অতিমারি আর ২০১৯-এর অগ্নিকাণ্ড মিলিয়ে। তবে তা পূরণ হয়ে যাচ্ছে বলে জানান সঞ্জয়।

ক্ষতি আরও বেশি ছিল রতনদের। আগুনের পরেই লকডাউন। সব মিলে প্রায় সাত কোটির ধাক্কা। রতন অবশ্য মনে করেন, আভিজাত্যই আসল। যাঁদের কেনার, তাঁরা ঠিক কিনবেন। ফলে নিজেদের জায়গায় অনড় থাকতেই হবে। না হলে মান থাকে না। বলেন, ‘‘শাড়ি লোকে হাতে ধরে কিনবেন। আর ভাল জিনিস না হলে ক্রেতারা কিনবেন কেন?’’ তাই সব প্রদেশের কাপড় রাখেন। কোনও একটি প্রদেশের প্রতি ঝুঁকে লাভ নেই বলেই মত তাঁর। তবে এখনই ব্যবসার হাল ফিরবে বলেও মনে করেন না। তিনি বলেন, ‘‘ব্যবসার হাল আবার কবে ফিরবে, কে জানে! আমরা তো তবু সামলে চলছি। ছোট ব্যবসায়ীদের কথা ভাবুন! লাভের আশা করার এখনও কারণ নেই।’’

পুজোয় কাতান শাড়ি অনেকেরই পছন্দ।

পুজোয় কাতান শাড়ি অনেকেরই পছন্দ। ছবি: সংগৃহীত

এক সময়ে কোন দোকানের তাঁত আর কোন চত্বরের সিল্ক ভাল, তা নিয়ে রীতিমতো চর্চা করে পুজোর কেনাকাটা করা হত। কোথায় কোন শাড়ি এসেছে? সব দোকানেই কি একই ধরনের স্টক? তা-ও জানার চেষ্টা ছিল মহিলাদের জটলায়। এখন এমনিই সে সময় গিয়েছে। অনেকেই শাড়ি পরেন না। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে পড়ে না আর শাড়ি। তাই কম দামি শাড়ি রাখলেও খুব একটা রোজের ব্যবহারের শাড়ি রাখা হয় না তাঁর দোকানে। জানালেন বেনারসি ব্যবসার অন্যতম কর্ণধার মানব ভট্টাচর্য। বাবা বেনারসের সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য চর্চা করতেন। কলকাতায় এসে ১৯৫৪ সালে এই বিপণি চালু করেন। ৭০ বছরের পুরনো রেওয়াজ এখনও ছাড়েননি তাঁরা। এই বিপণিতে শাড়ি আসে শুধুমাত্র বেনারস আর দক্ষিণ ভারত থেকে। আগের মতো এখনও ভারী সিল্কের উপর নকশা করা শাড়িতে জোর দেন। তবে লকডাউনের পর ক্রয়ক্ষমতা অনেকের কমেছে। তাই এখন সুতির উপর হালকা কাজ করা কিছু শাড়ি রাখছেন দোকানে।

তাতে হাল ফিরেছে কি ব্যবসার? মানব বলেন, ‘‘সারা বছর ব্যবসা তেমন দেখতেই হচ্ছিল না। তবে পুজোর সময়ে নিয়মিত দোকানে আসছি আগের চেয়ে বেশি ভিড় হচ্ছে শুনে। তবে ব্যবসা পুরনো মেজাজে ফিরতে দেরি আছে।’’ লকডাউনের ধাক্কা সামলানো কঠিন বলেই টের পাচ্ছে এই বিপণিও।

এই মরসুমে সুতির উপর হালকা কাজ করা শাড়ি পরতে পছন্দ করেন অনেকেই।

এই মরসুমে সুতির উপর হালকা কাজ করা শাড়ি পরতে পছন্দ করেন অনেকেই। ছবি: সংগৃহীত

এখন যে সাধারণের মধ্যে বেশি দামি শাড়ি কেনার চল কমেছে, তা খেয়াল করেছেন পারমিতাও। বাড়ি থেকে ব্যবসা করেন পারমিতা। পুজোর আগে বড়বাজার থেকে বেশি করে কমদামী কাতান, জামদানি, ব্রোকেড তুলেছেন। বলছিলেন, ‘‘শুনেছি এই শাড়িগুলো গুজরাতে তৈরি। দেখতে অবিকল আসলের মতোই। অবশ্য আসলের মতো আরাম নয়। কিন্তু আজকাল একটা শাড়ি আর ক’দিনই বা কেউ পরেন! তাই কমদামের জিনিস পছন্দ করেন অনেকে।’’ তাতে নানা রকম কেনা যায়। আবার যত্নেরও কম প্রয়োজন পড়ে।

আর কম দামে রকমারি শাড়ি মানেই এখন বাংলার মুখ ঘুরছে সুরাটের দিকে। সেখানে যেমন চাইবেন, তেমন মিলবে। তবে কি গুজরাতের সঙ্গে হাত মেলালেই টিকবে শাড়ির বাজার? কে বলবে শেষ কথা?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja 2022 Saree
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE