Advertisement
E-Paper

ইলিশ বেশি খেলেই শরীরে বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা প্রবল!

বাজারে আগুন দর বলে যাঁদের পাতে এখনও ওঠেনি, তাঁরা হয়তো একটু বাঁকা হাসি হাসবেন! কিন্তু বাকি সবাই, যাঁরা আজন্ম জলের এই উজ্জ্বল শস্যটির প্রেমে মজে— তাঁদের জন্য এটি কিছুটা উদ্বেগের বিষয় বইকি!

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০১৬ ০২:২৩

বাজারে আগুন দর বলে যাঁদের পাতে এখনও ওঠেনি, তাঁরা হয়তো একটু বাঁকা হাসি হাসবেন! কিন্তু বাকি সবাই, যাঁরা আজন্ম জলের এই উজ্জ্বল শস্যটির প্রেমে মজে— তাঁদের জন্য এটি কিছুটা উদ্বেগের বিষয় বইকি!

কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অধীনস্থ ‘ফুড সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অব ইন্ডিয়া’ (এফএসএসআই), তাদের সাম্প্রতিক নোটিফিকেশনে তালিকাভুক্ত করেছে ১২০ রকমের সামুদ্রিক মাছকে। যাদের অতিরিক্ত উদরস্থ করলে হিস্টামিন-বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এই তালিকায় সার্ডিন, টুনা, ম্যাকরেল-এর মতো সামুদ্রিক মাছের পাশাপাশি রয়েছে ইলিশও!

কিন্তু হঠাৎ ইলিশ কেন? প্রথমত, আদি অনন্তকাল বাঙালির পাত আলো করে রাখা এই মীনশ্রেষ্ঠটি খেলে বিষক্রিয়া হয়, এমনটা তো কেউ কখনও শোনেনি। তা হলে হঠাৎ কী হল, যাতে বিজ্ঞানীদের কোপ পড়ল ইলিশের উপরে? বিষক্রিয়ার ধরনটাই বা কী? এটি কি দূষণের কারণে ঘটা সাম্প্রতিক কোনও সমস্যা, নাকি আগে থেকেই ইলিশ হিস্টামিন দোষে দুষ্ট ছিল? এর কোনও প্রতিকার আছে কি?

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কর্তা (যিনি এফএসএসআই-এর দায়িত্বপ্রাপ্তও বটে) রাকেশ শর্মা প্রথমেই একটি বিষয় স্পষ্ট করে দিচ্ছেন। সেটি হল, ইলিশের ছিদ্র খুঁজতে কিন্তু এই বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তে পৌঁছনো হয়নি। ঘটনা হল, অভ্যন্তরীণ সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে গোটা দেশে সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার প্রবণতা গত কয়েক বছর ধরে অনেকটাই বেড়েছে। যা আগে ছিল না। সামুদ্রিক মাছের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখতে পাচ্ছেন, এই ধরনের কিছু মাছে হিস্টিডিন নামে একটি অ্যামিনো অ্যাসিডের উপস্থিতি মাত্রাতিরিক্ত রকম বেশি। যা থেকে হিস্টামিন তৈরি হয়ে মানুষের শরীরে বিষক্রিয়া ঘটায়।

বিষক্রিয়ার ধরনটা কী?

অ্যালার্জি অ্যান্ড অ্যাজমা নেটওয়ার্ক ইন্ডিয়া (এএএনআই)-এর প্রেসিডেন্ট বৈয়াকারনাম নাগেশ্বরের ব্যাখ্যা, “শ্বাসের সমস্যা, গায়ে গোটা বেরনো, নাক দিয়ে জল, অবিরল হাঁচি, পেটে খিঁচ ধরা, গায়ে জ্বালা-ভাব তৈরি হওয়া, ফোড়া বেরোনোর মতো ঘটনা ঘটে। ওই সামুদ্রিক মাছগুলিতে বেশি হিস্টামিন থাকায় এমন অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া হয়।”

এফএসএসআই সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে মূল সমস্যাটার জন্য আদতে দায়ী ডিস্ট্রিবিউশন চেন-এর অবহেলা এবং যথাযথ ফ্রিজিং-এর অভাব। মৎস্যজীবী জল থেকে মাছটি তুললেন, তার পর সেটি মহাজনের কাছে এল, সেখান থেকে আড়তদার হয়ে বিভিন্ন প্রদেশের বাজারে পৌঁছচ্ছে। সেখানে আবার আড়তদারের হাত ঘুরে তা চলে যায় ছোট ছোট বাজারের মাছওয়ালাদের কাছে। তাঁদের কাছ থেকে কিনে বাড়িতে নিয়ে এসে তার পর রান্নায় বসানো হয়। কখনও বা ফ্রিজে রেখে দেওয়া হয়। এই যে সুদীর্ঘ পথপরিক্রমা, তার মধ্যে আগাগোড়া যে তাপমাত্রায় মাছটি থাকার কথা সেটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই থাকছে না বলে নজর করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রক। বহু ক্ষেত্রেই যে বাক্সগুলিতে মণ মণ মাছ চালান হয়, তাতে হিমায়নের ব্যবস্থা ঠিক মতো থাকে না। অভাব রয়েছে সচেতনতারও।

বাঁকুড়া ক্রিশ্চান কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রধান চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বিশদে জানালেন, “যে কোনও সামুদ্রিক মাছে কমবেশি হিস্টিডিন থাকে। সমস্যা হল, ডিকার্বোস্কিলেজ নামে একটি উৎসেচকের প্রভাবে এই হিস্টিডিন থেকে হিস্টামিন তৈরি হয়। সেটিই আসলে ক্ষতিকারক। কিছু বিশেষ ব্যাকটিরিয়া এই উৎসেচকটিকে সংশ্লেষ করতে বা বানাতে সাহায্য করে। সমুদ্র থেকে যখন নদীতে মাছ আসে তখন তাদের শরীরে হিস্টিডিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। জলের ভিতর হিস্টিডিন থেকে হিস্টামিন তৈরির বিক্রিয়াটি হয় না, কিন্তু ডাঙায় তোলার পরে ১৫ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রায় মাছ থাকলেই ওই ব্যাকটিরিয়া সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে সঠিক ভাবে বরফজাত না থাকলে কিছু ক্ষণের মধ্যেই হিস্টামিন তৈরির কাজ শুরু হয়ে যায়। যদি আগাগোড়া ১৫ ডিগ্রির নীচে মাছকে রাখা যায় তা হলে ব্যাকটিরিয়াগুলি অকোজো হয়ে থাকে, বিষক্রিয়ার সমস্যাও হয় না।”

তা হলে জল থেকে ধরার পরে কত ক্ষণ পর্যন্ত সামুদ্রিক মাছ খাওয়া নিরাপদ? এর কি কোনও নির্দিষ্ট সীমারেখা রয়েছে? চন্দ্রনাথবাবু জানাচ্ছেন, ‘‘জল থেকে তোলার পরে এই সামুদ্রিক মাছগুলির শরীরে হিস্টামিন সংশ্লেষ হতে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় অন্তত ৫ ঘণ্টা লাগে। ফলে এই সময়সীমার মধ্যে খেলে কোনও ক্ষতি নেই। তবে নদী বা সাগর মোহনা সন্নিকট ছাড়া এমন সুযোগ তো বড় একটা পাওয়া যায় না!’’ আরও একটি প্রয়োজনীয় তথ্য, এই সামুদ্রিক মাছগুলিতে যে হিস্টিডিন থাকে তা মানুষের শরীরের জন্য ভালই। এই অ্যামিনো অ্যাসিড (হিস্টিডিন) শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। ফলে টাটকা এই সব সামুদ্রিক মাছ খাওয়া বরং ভাল।

এই সূত্রে মনে পড়ে একটি গল্প। দাক্ষিণাত্যে বিজাপুর জয় করে সাবরমতী দিয়ে ফেরার পথে খামখেয়ালি বাদশা মহম্মদ বিন তুঘলকের ইচ্ছে হয়েছিল মাছ খাওয়ার। তার জন্য বিরাট জাল পড়েছিল। এবং তিনি এত মাছ খেয়েছিলেন যে পথেই অসুস্থতা এবং মৃত্যু। সৈয়দ মুজতবা আলি লিখেছেন, ওই মাছ অন্য কিছু নয়, নির্ঘাত ইলিশই ছিল! কারণ অনেকেরই ওই মাছ পেলে বাহ্যজ্ঞান থাকে না !

তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, ‘বাহ্যজ্ঞানটি’ না হারিয়ে ইলিশ খেলে, হিস্টামিন-আতঙ্কের কোনও কারণ নেই। হিসেব অনুযায়ী ১৮০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত হিস্টামিন শরীর নিতে পারে কোনও সমস্যা ছাড়াই। তাই খাওয়ার সময় একটু সতর্ক থাকলেই হল। তুঘলকি কায়দায় এক সঙ্গে ছ-আটটি গাদা-পেটির সম্মিলিত টুকরো পাতে না ফেললে, আপনি নিশ্চিন্তে ঢেকুর তুলতে পারবেন!

Hilsa Poison
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy