Advertisement
০২ মে ২০২৪
Womens day special

শুধু নারী নন, ছিলেন দলিতও! দেশের সংবিধান তৈরিতে এমন নারীর অবদানের কথা ক’জন জানেন?

সংবিধান সভায় মহিলারাও সদস্য ছিলেন বুঝি? সাধারণ পাঠকের না-ই জানা থাকতে পারে এই তথ্য। সংবিধান সভা গঠনের সময়ে পনেরো জন মহিলা এর অংশ ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন এক দলিত নারীও।

Fifteen women were part of the constituent assembly and there was a Dalit woman in the group

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়
স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৪ ০৯:৫৯
Share: Save:

বিশ শতকের গোড়ার কথা। লক্ষদ্বীপ সমুদ্রের বোলঘাট্টি এলাকায় তটের কাছে মৃদু ঢেউয়ে দুলছে সারি সারি ছিপছিপে নৌকো। স্থানীয় ভাষায় একে বলে ক্যাটামারাণ। একটু নজর করলেই বোঝা যায়, নৌকোগুলি একেবারে পাশাপাশি গায়ে গা লাগিয়ে রয়েছে, মনে হয় যেন পরস্পরের সঙ্গে বাঁধা। ভ্রম নয়, সত্যিই তাই। দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হয়েছে নৌকোগুলি, যার ফলে তৈরি হয়েছে একটি বড়সড় মঞ্চের মতো। সেখানেই হবে প্রথম পুলায়া মহাজন সভা।

আপাত চমকপ্রদ এই ঘটনার মধ্যে লুকিয়ে আছে পুলায়াদের অপমান, বঞ্চনা ও নিগ্রহের ইতিহাস। কোচি সমাজে পুলায়া একেবারে নিচু জাত বলে গণ্য। তাঁরা ‘অস্পৃশ্য’। কিন্তু বিশ শতকের শুরুতে পুলায়ারা ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছেন প্রতিরোধ। জাতপাত বিদ্বেষের বিরূদ্ধে। নিজের এলাকায় পুলায়াদের সভা করার অনুমতি দেননি কোচির মহারাজ। অতএব জমিন না পাওয়া মানুষরা জেলেদের সহযোগিতায় সমুদ্রের বুকেই তৈরি করেছেন এই অভিনব প্রয়াস। সমুদ্রের জলে তো আর জাতের নামে বজ্জাতি করা যায় না।

এই কাহিনি নিজের স্মৃতিকথায় লিখেছেন সেই সম্প্রদায়েরই এক সাহসী লড়াকু নারী। নাম দাক্ষায়ণী ভেলাউধন ( ১৯১২-১৯৭৪)। কোচির উপকূলবর্তী এক ছোট্ট দ্বীপে জন্ম তাঁর। প্রথম থেকেই পুলায়াদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করেছেন তিনি। ব্রাহ্মণ বা অন্য উঁচু জাতের কাউকে হেঁটে আসতে দেখলে তাঁরা যেন সঙ্গে সঙ্গে পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ান। এই প্রথাকে একেবারেই তোয়াক্কা করেননি দাক্ষায়ণী। সরে দাড়াঁনো তো দূরস্ত্‌, তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছেন ‘উচ্চ বর্ণের’ হোমরাচোমরাদের দিকে। পুলায়াদের মধ্যে প্রথম মহিলা স্নাতক দাক্ষায়ণী। তা-ও আবার বিজ্ঞানে। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভেই সীমাবদ্ধ থাকেননি দাক্ষায়ণী, তিনি ক্রমশ প্রবেশ করেছেন রাজনীতির বৃত্তে। সদস্য হয়েছেন কোচিন লেজিস্লেটিভ কাউন্সিলের এবং শেষ পর্যন্ত ভারতের সংবিধান সভা বা ‘কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি’র। এই সংবিধান সভায় ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৯ প্রায় তিন বছর ধরে সংসদের অধিবেশনে তর্কবির্তক আলোচনার মধ্যে দিয়ে খসড়া করা হয় সেই দলিল, পরে যা সংবিধানের রূপ নেয়। দাক্ষায়ণীই ছিলেন এই গুরুত্বপূর্ণ সভার একমাত্র দলিত মহিলা সদস্য।

পাঠক কি চমকে উঠলেন? সংবিধান সভায় মহিলারাও সদস্য ছিলেন বুঝি? সাধারণ পাঠকের না-ই জানা থাকতে পারে এই তথ্য। ভারতের সংবিধানের ইতিহাস প্রণেতা তাবড় পণ্ডিতরাই মহিলা সদস্যদের উল্লেখমাত্র না করে কিতাব লিখেছেন ভূরি ভূরি। যদিও অবিশ্বাস্য ঠেকে যে, তাঁরা জানতেন না সংবিধান সভা গঠনের সময়ে পনেরো জন মহিলা এর সদস্য ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রাজ্ঞ সরোজিনী নাইডু, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের মতো মহিলা, অল ইন্ডিয়া উইমেন কনফারেন্সের হান্‌সা মেহতা, অমৃত কউর, আম্মু স্বামিনাথন, রেণুকা রায়, বেগম এজাস রসুল, কমলাদেবী চট্টপাধ্যায়। তা ছাড়া, সুচেতা কৃপালনী, দুর্গাবাঈ, সৈয়দা এক্রামুল্লাহ, বেগম জাহানারা শাহ নাওয়াজ, মালতি চৌধুরী, দাক্ষায়ণী ভেলাউধন প্রমুখ। ভারতের বিভিন্ন প্রভিন্সিয়াল অ্যাসেম্বলি, আমাদের সময়ের পরিভাষায় স্টেট বা রাজ্যের বিধানসভার সমতুল্য, থেকে নির্বাচিত হয়েই। পুরুষ রাজনৈতিকদের বদান্যতায় নয়। সলতে পাকানোর একটি পর্যায়ে কংগ্রেসের হাই কমান্ডের একটি ভূমিকা নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু একসঙ্গেই ছিল মহিলাদের নিজস্ব প্রয়াস। বিশেষ করে অল ইন্ডিয়া উইমেন্স কনফারেন্সের সদস্যদের। তাঁরাই অগ্রণী হয়ে বানিয়েছিলেন তালিকা— রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন যাঁরা, তাঁদের নাম। তার মধ্যে সকলেই যে সংবিধান সভায় আসতে পেরেছিলেন, তেমনটা নয়। কিন্তু যাঁরা ছিলেন, তাঁরা তো সব বিতর্কে, আলোচনায় একেবারে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন— তা হিন্দু কোড বিলের আলোচনা হোক বা স্টিয়ারিং কমিটিতে খসড়ায় সংশোধন করা, অথবা মেয়েদের কাজ নিয়ে আলোচনা।

Fifteen women were part of the constituent assembly and there was a Dalit woman in the group

দাক্ষায়ণী ভেলাউধন-সহ সংবিধান সভার অন্যান্য মহিলা সদস্য। —নিজস্ব চিত্র।

অর্থাৎ, সংবিধান সভায় মোটেই ফেলনা ছিলেন না মহিলারা। তবে কেন তাঁদের বিষয়ে কোনও আলোচনা হয় না? ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় সেটি। স্বাধীনতার পরে কী চেহারা নেবে রাষ্ট্র, কী হবে তার গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের মূলাধার, সে বিষয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দলিলে, মহিলাদের মতামতের কথা, তাঁদের ভূমিকা একেবারে নেই করে দেওয়া হয়েছে কেন? ইতিহাসের পাতা থেকে কেন নির্বাসিত হয়েছেন তাঁরা?

এ সব অত্যন্ত জরুরি নারীবাদী প্রশ্ন তুলেছেন লেখক অচ্যুত চেতন, তাঁর গবেষণা গ্রন্থ, ‘দ্য ফাউন্ডিং মাদার্স অফ দ্য ইন্ডিয়ান রিপাব্লিক: দ্য জেন্ডার পলিটক্স অফ দ্য কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি’-তে। তাঁর বক্তব্য, এই নেই করে দেওয়ার পিছনে কাজ করে এক ধরনের পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শ। সেখানে সংবিধান নিয়ে চর্চা করেন যাঁরা, তাঁদের দৃষ্টিতে থাকে অ্যামেরিকান সংবিধান চিন্তকদের অনুপ্রেরণায়, ফাউন্ডিং ফাদার্সদের ভূমিকা। তাই অম্বেডকর, নেহেরু, রাজেন্দ্র প্রসাদ, মৌলানা আজাদ, পটেল প্রমুখের ভূমিকা নিয়ে এতই ব্যস্ত পণ্ডিতেরা যে, নজরেই পড়ে না সংবিধান সভার মহিলা সদস্যদের। তাঁরা হয়ে যান মিসিং মাদার্স।

কিন্তু মূলধারার ইতিহাসে তাঁদের ঠাঁই না হলেও, অভিলেখাগারের নথিতে তো তাঁরা রয়েছেন। তাঁদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় পরস্পরকে লেখা চিঠিতে, যেখানে তাঁরা শুধু রাজনৈতিক সহকর্মী নন, প্রিয় বান্ধবীও বটে। সংবিধান সভার সদস্য হওয়ার আগে থেকেই রাজনীতিতে তাঁদের ভূমিকার কথা গবেষণা করে অচ্যুত তুলে এনেছেন তাঁর বইয়ে। এই প্রবন্ধের সব তথ্য এবং তত্ত্ব অচ্যুতের গবেষণা গ্রন্থের দৌলতে জানা।

দাক্ষায়ণীর অপ্রকাশিত স্মৃতিকথার যে অংশ দিয়ে এই প্রবন্ধ শুরু, সেটিও। তা হলে এ বার ফিরে আসা যাক সংবিধান সভার এই অসাধারণ দলিত মহিলার কথায়। ঠিক কতটা লড়াই করতে হয়েছিল তাঁকে এই সভার সদস্য হতে? বস্তুত, অনেকটাই বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে মাদ্রাজ কংগ্রেসের এবং সেখানকারই দলিত-হরিজন সম্প্রদায়ের তরফে। অবাক লাগছে? আদতে দাক্ষায়ণী নানা মৌচাকে খোঁচা দিয়ে ফেলেছিলেন তাঁর একেবারে নিজস্ব মতামতের ঢিল ছুড়ে।

মাদ্রাজের প্রবল প্রতাপান্বিত রাজাগোপালাচারীকে তিনি আক্রমণ করেছিলেন ‘সুযোগসন্ধানী চালাক ব্রাহ্মণ’ বলে। কারণ, রাজাগোপালাচারী অম্বেডকরের বিরোধিতা করেছিলেন। প্রত্যাশিত ভাবেই দাক্ষায়মী অম্বেডকরকে দেখেছিলেন সমাজের আমূল পরিবর্তনের হোতা হিসাবে। তাঁর প্রভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্য শেষ হবে। অস্পৃশ্য বলে সরিয়ে রাখা ‘নিচু জাতের’ মানুষেরা সমাজে তাঁদের যোগ্য সন্মান পাবেন। অথচ অম্বেডকর যখন সেপারেট ইলেক্টরেটের দাবি জানান, দাক্ষায়ণী তার বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, দলিতরা শুধু তাঁদের সম্প্রদায়ের মানুষকে ভোট দেবেন, এই পদ্ধতির মধ্যে গলদ রয়েছে। তা হলে তো তাঁরা স্বাধীন ভারতের বৃহত্তর সমাজের অংশ হয়ে উঠতে পারবেন না। তাঁর এই চিন্তা গান্ধীবাদী। মহাত্মা গান্ধী ও কস্তুরবা তো তাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন হরিজন দলিত নেতা আর ভেলাউধনের সঙ্গে। মূল কথা কংগ্রেস কর্মী ও অম্বেডকরপন্থীদের বিরোধ সত্ত্বেও দমে যাননি দাক্ষায়নী। ক্ষীণকায়া শ্যামলা এই মহিলার মনের জোর ছিল সাংঘাতিক। নির্বাচনে জিতে সংবিধান সভায় পা দেন দাক্ষায়ণী।

প্রত্যাশিত ভাবেই তাঁর আগ্রহের মূল বিষয় ছিল দলিত সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য কী পদক্ষেপ করা হচ্ছে, সে বিষয়টি। তিনি প্রশ্ন তুলতেন তাঁদের শিক্ষা প্রসঙ্গে, বিশেষ করে বিদেশে শিক্ষা পাওয়ার ব্যপারে কী বৃত্তি দেওয়া যেতে পারে এবং কী ভাবে বর্ণ হিন্দুদের হিংসা ও আক্রোশ থেকে তাঁদের রক্ষা করার বিষয় নিয়েও চিন্তাভাবনা করতেন দাক্ষায়ণী। তাঁর আগ্রহের আর একটি বিষয় মেয়েদের কাজ বা লেবার নিয়ে, যা অনেক সময়ে তাঁদের ঠেলে দেয় বিপদের মুখে। পিতৃতন্ত্রের হিংসার নানা রকমফের, যা দলিত সম্প্রদায় বা মহিলাদের ঘিরে প্রতিনিয়ত চলে তার প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রতি মনোনিবেশ ছিল তাঁর।

আজ ৮ মার্চ, আন্তজাতিক নারী দিবসে সংবিধান সভার মহিলাদের, বিশেষ করে দাক্ষায়ণীকে স্যালুট করার দিন।

(লেখক বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE