E-Paper

কোন পথে জেন জ়ি?

নানা অভিযোগে বিদ্ধ আজকের প্রজন্ম, অর্থাৎ জেনারেশন জ়েড। কতটা সত্যি সে সব অভিযোগ? জেন জ়ি নিজেরা কী বলছে এ নিয়ে?

সায়নী ঘটক

শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:৫১
ছবি: সর্বজিৎ সেন।

ছবি: সর্বজিৎ সেন।

এই হচ্ছে আজকের জেনারেশন— এমন একটা বাক্যবাণ প্রায়ই ধেয়ে আসে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের উদ্দেশে। অনেক সময়েই নেতিবাচক অর্থে। ডিজিটাল বিস্ফোরণের যুগে দাঁড়িয়ে জেনারেশন জ়েড ঠিক কোন পথে চলেছে, তা নিয়ে একটা চালু ধারণা রয়েছে। সারাক্ষণ মুঠোফোনে মগ্ন, নিজেদের আশপাশটা সম্পর্কে অসচেতন, দায়িত্বজ্ঞানহীন, অধৈর্য, স্বার্থপর... ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এর সব ক’টাই কি সত্যি? এই ‘অভিযোগ’ নিয়ে তারা নিজেরা কী বলছে?

স্পষ্ট কথায় কষ্ট নেই

জেনারেশন জ়েড স্পষ্টবাদী, এটা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই কারও। সেই স্পষ্টবাদিতা, সত্যকথন অনেক সময়েই অপ্রিয় করে তোলে তাদের, এ-ও ঘটনা। ছোট মুখে বড় কথা বলার খেসারতও দিতে হয় অনেক সময়ে। এ প্রসঙ্গে অভিনেতা ঋদ্ধি সেন বললেন, “এই প্রবণতা কিন্তু বাঙালিদের মধ্যেই বেশি। ছোটদের বিশেষ পাত্তা না দেওয়া। আমি নিজেও এই প্রবণতার শিকার। স্পষ্ট মতামত দেওয়ার মাসুল হিসেবে ‘পাকা’ বলে দাগিয়ে দেওয়া। রাজ্যের বাইরে কাজ করে দেখেছি, এ জিনিস আর কোথাও হয় না।”

রাখঢাক করে কথা না বলা, প্রচলিতকে প্রশ্ন করা, প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করা... এ সবই জেন জ়ির বৈশিষ্ট্য। আর একটা শিক্ষণীয় গুণ, নিজেদের বিপন্নতা না লুকোনো। বিশ্বকাপজয়ী মহিলা ক্রিকেট দলের জেমাইমা রডরিগ্‌স যখন বলেন তিনি অ্যাংজ়াইটির শিকার হয়ে দিনের পর দিন কেঁদেছেন, কিংবা জাহ্নবী কপূর যখন জনপ্রিয় টক শোয়ে এসে নিজের কসমেটিক সার্জারির কথা আলোচনা করেন, তখন তাঁদের প্রতি সম্মান বাড়ে বই কমে না।

গত বছর আর জি করের ঘটনার প্রতিবাদে প্রথম রাত দখলের ডাক দিয়েছিলেন রিমঝিম সিনহা। সোশিয়োলজি নিয়ে পড়াশোনা করা রি‌মঝিম স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন, কেন প্রতিবাদ করার জন্য আদর্শ জেন জ়ি-রাই। “সমাজে বা অন্য কোথাও কোনও বদল আসুক, এইটা মেনে নিতে আমাদের সব সময়েই অসুবিধে হয়। যা এত দিন ধরে চলে আসছে, তার সঙ্গে মানিয়ে চলতে হবে, সেটা জেন জ়ি-দের ধাতে একেবারেই নেই। আর সেটা খুবই অনুপ্রেরণাদায়ক।”

সমাজমাধ্যম: ব্যবহার না ব্যবহৃত?

আগে টেলিভিশনে যা দেখানো হত, সেটাই দেখা ছাড়া বিকল্প ছিল না। ইন্টারনেটের যুগে জেন জ়ি-দের প্রথম থেকেই ‘চয়েস’ তৈরি হয়ে গিয়েছে যে, তারা কী দেখবে। সারা পৃথিবীর কনটেন্টের সঙ্গে ছোট থেকে পরিচিত হওয়ায় দুনিয়াটা প্রথম থেকেই খুলে যায়। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বলছেন, “যে ভাবে টেকনোলজিকে আত্মস্থ করতে করতে তারা বড় হয়েছে, তাতে প্রচুর নতুন আইডিয়া কিন্তু এই জেনারেশনের মাথা থেকেই বেরোচ্ছে। শুধুই যে মোবাইল স্ক্রল করে অলস মস্তিষ্ক তৈরি হচ্ছে, সেটা পুরোটা সত্যি নয়। বিভিন্ন স্টার্ট আপ, ইনফ্লুয়েন্সার-সহ বহু নতুন পেশার জন্ম দিয়েছে এই প্রবণতা।”

উল্টো দিকে সমাজমাধ্যমে ডুবে থাকার ক্ষতিকর দিক থেকেও নিজেকে মুক্ত রাখা কঠিন। জেন জ়ি-দের মধ্যে যে ধৈর্য-অধ্যবসায়ের অভাব, কোনও বিষয়ের গভীরে না ঢোকার প্রবণতা দেখা যায়, তা-ও কিন্তু এই ‘রিলস-সর্বস্ব’ সামাজিক-দুনিয়ারই পরিণাম। শহরতলি কিংবা রাজ্যের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিলে জানা যাবে, সেখানে দিনের পর দিন ক্লাস করতে আসে না ছাত্রছাত্রীরা। সমকালীন রাজ্য-রাজনীতি-খেলাধুলো কোনও কিছু নিয়েই যে তারা চিন্তিত নয়, তা বোঝা যায় ভাবলেশহীন প্রতিক্রিয়া থেকে। ভাবনাচিন্তার এই দৈন্য প্রসঙ্গে তরুণ অভিনেতা উজান চট্টোপাধ্যায় বললেন, “গভীরে ভাবতে না পারার রোগে শুধু জেন জ়িরা নয়, প্রায় সকলেই এখন আক্রান্ত। এর ফল হিসেবে এক ধরনের অন্তঃসারশূন্যতা এসে যায়। যে কোনও সোশ্যাল সিস্টেম দাবি করে, মানুষ যেন গভীরে গিয়ে কিছু ভাবতে না পারে। তার আড়ম্বরের পসরা সাজিয়ে বসার একটা জগৎজোড়া প্রক্রিয়া বহু দিন থেকেই কার্যকর রয়েছে। এই আয়োজনের মাঝে যদি সত্যিই গভীরে গিয়ে ভাবার চেষ্টা করা যায়, সেটাই হবে এ যুগের একমাত্র বিপ্লব।”

একমেবাদ্বিতীয়ম

সমাজমাধ্যমে ভাসতে ভাসতে আসল সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, ‘আমিত্ব’র বুদবুদে ডুবে যাওয়া জেন জ়ি ক্রমশ একা হয়ে যাচ্ছে। আর এই একাকিত্ব জন্ম দিচ্ছে অবসাদের, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য। পরাজয় মেনে নিতে না পারা থেকে জন্মানো প্রতিশোধ প্রবণতা... এই ক্ষতিকর দিকগুলো গ্রাস করে ফেলছে জেন জ়িকে। সম্পর্কের ক্ষেত্রে কমিটমেন্ট ফোবিয়াও ঠিক এই জায়গা থেকেই শুরু হয়। “নিজেকে ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না এরা। একাকিত্বে ভুগতে ভুগতে যখনই কোনও সম্পর্কে জড়ায়, তখনই সেটাকে জাপটে ধরে, যেটা কিছু দিন পরেই দমবন্ধকর হয়ে ওঠে,” বললেন পায়েল।

দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে পরিবারের শিক্ষা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্ক নিয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন শ্রেয়সী দাস। তাঁর মত, “এ প্রজন্ম যে দায়িত্ব নিতে পারে কি না, সেটা নির্ভর করে কী ভাবে তারা বড় হচ্ছে। আগেকার দিনে অনেক সন্তান হওয়ায় মা-বাবারা সকলের প্রতি যত্ন নিতে পারতেন না। এখন একটা বা দুটো সন্তান, আদরে-প্রাচুর্যে মানুষ হয়। দায়িত্ব না দিলে দায়িত্ব নিতে শিখবে কী করে?”

অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের পালা চলবে। তার মধ্যেই ঘটে যাবে নেপাল কিংবা বাংলাদেশে জেন জ়ি-র ডাকা গণআন্দোলন। যা জিইয়ে রাখে আশা। এখন পৃথিবীর বুকে শ্বাস নিচ্ছে জেন আলফাও। জেন জ়ি ছাড়া তাদের পথ দেখাবে কে?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Gen Z

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy