Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Holi

বাংলার হোলির ইতিহাসে মিশে আছে সম্প্রীতির রং

শুধু দেবতাকে রাঙিয়ে তোলা নয়, দোল উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে জীবনের নানা রং। দোল উৎসবে যেমন মিশে আছে উদ্‌যাপনের বৈচিত্র, তেমনই বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে দেখা যায় এই উপলক্ষে মেলাও।

উত্তর ২৪ পরগনার ইছাপুরে দোল উত্সব 

উত্তর ২৪ পরগনার ইছাপুরে দোল উত্সব 

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৭:৪৯
Share: Save:

শাস্ত্র অনুসারে বৈষ্ণবীয় উৎসবের শেষ উৎসব হোলি বা দোল উৎসব। ফাল্গুনী পূর্ণিমায় উদ্‌যাপিত এই উৎসবের উল্লেখ মেলে বিভিন্ন পুরাণে।

বৈষ্ণব কবি গোবিন্দদাসের রচনায় তার নানা উল্লেখ মেলে। ‘‘খেলত ফাগু বৃন্দাবন-চান্দ।। ঋতুপতি মনমথ মনমথ ছান্দ। সুন্দরীগণ কর মণ্ডলি মাঝ। রঙ্গিনি প্রেম তরঙ্গিনী সাজ।। আগু ফাগু দেই নাগরি-নয়নে। অবসরে নাগর চুম্বয়ে বয়নে।।’’

তবে শুধু দেবতাকে রাঙিয়ে তোলা নয়, দোল উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে জীবনের নানা রং। দোল উৎসবে যেমন মিশে আছে উদ্‌যাপনের বৈচিত্র, তেমনই বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে দেখা যায় এই উপলক্ষে মেলাও।

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় বগড়ী কৃষ্ণনগরের কৃষ্ণরায়জীউ-র দোল আজও সাড়ম্বরে পালিত হয়। কৃষ্ণরায়জীউ-র মন্দিরটি ১৮৫৫-এ নির্মিত। শোনা যায় আগে রাধিকা মূর্তিটি ছিল না, পরে সেটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন থেকেই প্রতি বছর দোলের সময় উৎসব ও মেলা হয়। আগের দিন হয় চাঁচড়। সেই উপলক্ষে বাজি পোড়ানো হয়। পূর্ণিমার দিন হয় মূল উৎসব। এ দিন বিকেলে পাল্কি করে দেবতার বিগ্রহ পুরনো মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। দ্বিতীয়া তিথি পর্যন্ত বিগ্রহ এখানেই থাকে। পুরনো মন্দির সংলগ্ন আম বাগানে মেলা বসে। দোলের দিন এখনও বহু মানুষের সমাগম হয়। তাঁরা একে অপরকে আবিরে রাঙিয়ে তোলেন।

দক্ষিণ ২৪ পরগনার রাজপুরে মহা সমারোহে পালিত হয় দোল উৎসব। এখানে রয়েছে কিছু ব্যতিক্রমী আচার অনুষ্ঠান। এর মধ্যে ‘দোল ফোঁড়াফুঁড়ি’ উল্লেখ্য। এতে যুবকরা দু’টি দলে ভাগ হয়ে যান। এক দল রাধার পক্ষে, আর এক দল কৃষ্ণের পক্ষে। পূজাস্থলে একটি পুরনো সিংহদরজা রয়েছে। এক দল সেই দরজার সামনে দাঁড়ান, আর এক দল তাঁদের বাধা অতিক্রম করে দরজা পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেন। যে দল যে বার জয়ী হন তাদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। আজও এটি দেখতে বহু মানুষ ভিড় করেন।

নদিয়া জেলার শান্তিপুরে বিভিন্ন গোস্বামী বাড়িতে এবং শ্যামচাঁদ মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় দোলযাত্রা। দোল উপলক্ষে এখনও পথে হরিনাম সংকীর্তনের মিছিল বের হয়। বিশেষ উল্লেখযোগ্য শ্যামচাঁদ মন্দির প্রঙ্গণে আজও দোল উপলক্ষে এক দিনের একটি মেলা বসে। তবে শুধু দোলের দিন নয়। শান্তিপুরে দোল উৎসব চলতে থাকে পূর্ণিমা থেকে রামনবমী পর্যন্ত।

উত্তর ২৪ পরগনার ভাটপাড়ায় দোলের দিন নয়, পঞ্চম দোলের দিন মধ্য ভাটপাড়া অঞ্চলে অমরকৃষ্ণ পাঠশালার কাছে বসে পঞ্চম দোলের মেলা। আজও দাঁড়িয়ে অতীতের দোল মঞ্চটি। তবে পুরনো বিগ্রহটি আজ আর আসে না। মাটির বিগ্রহ স্থাপন করে পূজা করা হয়। তবু ছোট এই মেলাটির আকর্ষণে আজও আশপাশের মানুষ ভিড় করেন।


দোল উত্সবে ইছাপুরের বিগ্রহ

তেমনই কাছেই নারায়ণপুরে দোলের ঠিক সাত দিন বাদে হয় জয়চণ্ডীর সপ্তম দোলের বহু প্রাচীন মেলাটি। কিংবদন্তি অনুসারে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সময় ভবানী পাঠক উত্তরবঙ্গ থেকে নারায়ণপুরে এসে কিছু দিন আত্মগোপন করেছিলেন। এক দিন সন্ধ্যায় তিনি দেখেছিলেন বহুমূল্য অলঙ্কারে সজ্জিতা এক নারী তাঁর সামনে দিয়ে হেঁটে চলেছেন পুকুরের দিকে। ভবানী তাঁকে দাঁড়াতে বললেও তিনি অগ্রাহ্য করে এগিয়ে গেলেন। এমনই এক সময় ভবানী পাঠক তাঁর তলোয়ার দিয়ে সেই নারীর উপর প্রহার করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই নারী সামনের পুকুরের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন। ভবানী পাঠকও তাঁকে ধরার জন্য সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপ দিলেন। কিন্তু সেই নারীর কোনও সন্ধান পেলেন না। বরং হাতে পেলেন একটি ছোট শিলাখণ্ড আর একটি ছোট দেবীর বিগ্রহ। সেই উপলক্ষেই মেলা বসে।

দোল সাধারণত বৈষ্ণবীয় উৎসব হলেও বাংলার কোথাও কোথাও শাক্ত দেবী এমনকী হিন্দু ধর্মের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও উৎসব ও মেলা দেখা যায়।

যেমন কল্যাণীর ঘোষপাড়ার সতীমায়ের মেলাটি। মেলাটি মূলত কর্তাভজা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত। কল্যাণীর ঘোষপাড়া স্টেশনে নেমে জনস্রোতের পিছু পিছু পৌঁছে যাওয়া যায় সতীমার মেলায়। ‘জয় সতীমা-র জয়’ ধ্বনি-মুখরিত মেলা প্রাঙ্গণ আবিরে রাঙা। চারদিক থেকে এলোমেলো ভাবে ওড়ানো হয় ফাগ। মেলার বিভিন্ন জায়গায় আউল, বাউল, ফকির, কিংবা সন্ন্যাসীদের আখড়া। তাঁরা গেয়ে চলেছেন ‘ভাবের গান’। এ মেলা যেন বৈরাগ্য আর আনন্দের এক মিলনক্ষেত্র। প্রচলিত রয়েছে একাধিক কাহিনি। একটি হল আউলেচাঁদ বা আউলচন্দ্র রামশরণ পাল-সহ একুশ জনকে দীক্ষা দেন। এই রামশরণের স্ত্রীর সরস্বতী দেবীই হলেন ‘সতীমা’। আউলচন্দ্র মৃতপ্রায় সতীমাকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন।


ঘোষপাড়ায় সতী মায়ের মেলা

অপর একটি কিংবদন্তি অনুসারে, উলা বীরনগরের মহাদেব বারুইয়ের পানের বরজে একটি শিশুকে পাওয়া যায়। শিশুটির নাম হয় পূর্ণচন্দ্র। পরে সাধনায় সিদ্ধিলাভের পরে পূর্ণচন্দ্রের নাম হয় আউলচাঁদ। নানা স্থানে ধর্ম প্রচার ও অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ করে তিনি এসেছিলেন এই ঘোষপাড়ায়। বহু মানুষের বিশ্বাস আউলচাঁদই নবদ্বীপের শ্রীচৈতন্য। বিষ্ণুপ্রিয়ার অভিশাপে তাঁকে আবার জন্মগ্রহণ করতে হয়েছিল। ইনি কর্তাভজাদের কর্তা। সতীমার গর্ভে জন্ম নেন দুলালচাঁদ। লোকবিশ্বাসে এই দুলালচাঁদই হয়ে ওঠেন নবদ্বীপের নিমাইচাঁদের অবতার। তাঁর সময়ই মেলা ও কর্তাভজা সম্প্রদায় ব্যাপক প্রসার ঘটে।

ভক্তরা ডালিমতলায় মানত করেন, হিমসাগরের জলে স্নান করে পুণ্যার্জন করেন, সতী মায়ের সমাধিতে সিঁদুর আর নোয়া দেন। আর মনস্কামনা পূর্ণ হলে দণ্ডি কেটে কিংবা ভাবের গান গেয়ে জানিয়ে যান কৃতজ্ঞতা। ডালিমতলার চারপাশে অসংখ্য ডালার দোকান। পুজোর উপকরণ বলতে মাটির সরায় খই-বাতাসা কিংবা মট। এই হল পুজোর ডালি। পুজো দিয়ে ভক্তেরা এই মহার্ঘ্য প্রসাদটুকু নিয়েই ঘরে ফিরে যায়। দোলের আগের দিন থেকে দোলের পরে পাঁচ দিন পর্যন্ত চলে উৎসব। তবে মেলা চলে দু’সপ্তাহ। মেলায় এক দিকে যেমন রয়েছে সার্কাস, বিদ্যুত্চালিত নাগরদোলা, কিংবা ছোটদের মনোরঞ্জনের হরেক উপকরণ, তেমনই অন্য দিকে পাওয়া যায় পিতলের বাসনপত্র, বেতের ধামা, সাজি থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় নানা জিনিস।


শোভাবাজার রাজবাড়ির দোল উত্সব

তবে শুধু হিন্দুরা নন, দোলের রঙে বহু যুগ ধরে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলে আনন্দ উপভোগ করেছেন। শোনা যায় মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ইংরেজদের সঙ্গে আলিনগর চুক্তি সেরে তড়িঘড়ি মুর্শিদাবাদ ফিরে গিয়েছিলেন হোলি উৎসবের জন্য। নবাবের প্রিয় হিরাঝিল প্রাসাদে মহা সমারোহে হোলি উৎসব পালন করা হত। তেমনই ঢাকার নবাব নওয়াজিস মহম্মদ খান পটনা থেকে আগত শওকত জঙ্গের সঙ্গে সাত দিন ধরে মুর্শিদাবাদের মোতিঝিল প্রাসাদে হোলি উৎসব পালন করেছিলেন। তবে শুধু নবাবরা নন, সেই প্রাচীন কাল থেকেই হোলি উৎসবে মুসলমানরাও যোগ দিতেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE