Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

নিয়ম মানলে, ভয় নেই হৃদরোগে

হৃদস্পন্দন অনিয়মিত হলে নানা সমস্যা শুরু হয়। এর জন্য অনেক সময়ে পেসমেকার বসাতে হয়। যন্ত্রটি বসানোর পরে নিয়ম মেনে চললে, সুস্থ জীবনযাপন করা যায়। পেসমেকার নিয়ে কথা বললেন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ জয়ন্ত পাল হৃদস্পন্দন অনিয়মিত হলে নানা সমস্যা শুরু হয়। এর জন্য অনেক সময়ে পেসমেকার বসাতে হয়। যন্ত্রটি বসানোর পরে নিয়ম মেনে চললে, সুস্থ জীবনযাপন করা যায়।

 রোগী দেখছেন চিকিৎসক। নিজস্ব চিত্র

রোগী দেখছেন চিকিৎসক। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:২৮
Share: Save:

প্রশ্ন: পেসমেকার কী?

উত্তর: পেসমেকার হৃদস্পন্দন নিয়মিত রাখার কৃত্রিম বৈদ্যুতিক যন্ত্র। যা ইলেকট্রিক্যাল ইমপা‌ল্‌স তৈরি করে হৃদপেশিকে সরবরাহ করে এবং হৃদপিণ্ডের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। পেসমেকারের প্রাথমিক কাজ হল, যখন হৃদপিণ্ডের নিজস্ব পেসমেকার বা এসএ নোড যথেষ্ট পরিমাণে বা গতিতে ইমপাল্‌স তৈরি করতে পারছে না বা হৃদপিণ্ডের তড়িৎ পরিবহণের রাস্তা আটকে যাচ্ছে, তখন হৃদপিণ্ডের গতি একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় নিয়ে যাওয়া। যাতে হৃদপিণ্ড ঠিক ভাবে কাজ করতে পারে।

প্রশ্ন: পেসমেকার কত রকমের হয়?

উত্তর: পেসমেকার প্রধানত দুই প্রকারের— অস্থায়ী বা টেম্পোরারি পেসমেকার এবং স্থায়ী বা পারমানেন্ট। অস্থায়ী পেসমেকার সাধারণত হার্ট অ্যাটাক বা হৃদপিণ্ডের অস্ত্রোপচার বা অতিরিক্ত ওষুধ সেবনে ফলে যখন হৃদপিণ্ডের গতি কমে যায়, তখন বসানোর প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন শেষ হলে, মানে হৃদপিণ্ড নিজস্ব গতি ফিরে পেলে এটি সরিয়ে নেওয়া হয়। স্থায়ী পেসমেকার তাঁদেরই বসানো হয়, যাঁদের হৃদপিণ্ডের গতির স্থায়ী সমস্যা রয়েছে। হৃদপিণ্ডের শ্লথ গতির জন্য যে সমস্যাগুলি হয়, যেমন ক্লান্তি, হার্ট ফেলিওর, বারবার চোখে অন্ধকার দেখা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং রোগীকে সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।

প্রশ্ন: একটি সাধারণ ধারণা আছে যে, হার্টের সব ধরনের ব্লকের জন্যই পেসমেকার বসানো হয়। এই ধারণাটি কি ঠিক?

উত্তর: এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। পেসমেকার কেবলমাত্র ইলেকট্রিক্যাল ব্লকের জন্যই বসানো হয়। যা হার্ট অ্যাটাকের ব্লকের থেকে আলাদা। সেখানে পেসমেকার নয়, দরকার হয় অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি বা বাইপাস সার্জারির।

প্রশ্ন: কাকে পেসমেকার বসাতে হবে এটা কী ভাবে ঠিক করা হয়?

উত্তর: পেসমেকার বসানোর প্রাথমিক ইঙ্গিতগুলি হল, হৃদপিণ্ডের গতি কমার কারণে বার বার অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা চোখে অন্ধকার দেখা। সিক সাইনাস জনিত সমস্যা ও কমপ্লিট হার্ট ব্লক।

প্রশ্ন: স্থায়ী পেসমেকার কত রকমের হয়?

উত্তর: পারমানেন্ট বা স্থায়ী পেসমেকার সাধারণত পাঁচ ধরনের হয়, ১) এক চেম্বার বিশিষ্ট: এখানে একটি লিড তার ডান দিকের ভেন্ট্রিকুলার মাংসপেশিতে লাগানো বা বসানো হয়। ২) দুই চেম্বার বিশিষ্ট: এখানে একটি লিড ডান দিকের ভেন্ট্রিকুলার এবং একটি ডান দিকের এট্রিয়ামে বসানো হয়। ৩) লিডলেস বা লিড ছাড়া পেসমেকার: সাধারণত সরাসরি ভেন্ট্রিকুলার পেশিতে বসানো হয়। ৪) ইমপ্ল্যান্টেবল কার্ডিওভার্টর ডেফিব্রিলেটর (আইসিডি): এটি একটি বিশেষ ধরনের পেসমেকার যা নিজে থেকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে হৃদপিণ্ডের অতিরিক্ত এবং অনিয়মিত গতিকে নিয়মিত এবং নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। ৫) বাই ভেন্ট্রিকুলার পেসমেকার: এটি একটি বিশেষ ধরনের পেসমেকার যেখানে সিঙ্গেল বা ডুয়েল চেম্বার পেসমেকারের সঙ্গে আরও একটি লিড বাম ভেন্ট্রিকলের পিছনের দিকে বসানো হয়। এটি বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে হার্টের সংকোচন ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। একে কার্ডিয়াক রিসিংক্রোনাইজেশন থেরাপিও বলে।

প্রশ্ন: স্থায়ী পেসমেকারের কতগুলি অংশ থাকে?

উত্তর: স্থায়ী পেসমেকারের দু’টি অংশ। প্রথম অংশ বা লিড। এটি হার্টের সঙ্গে পেসমেকারের ব্যাটারিকে যোগ করে এবং দ্বিতীয় অংশ বা ব্যাটারি, এটি সাধারণত ২০-২৫ গ্রামের একটি সেটালিক ক্যান যা সাইজে ছোট দেশলাই বাক্সের থেকেও ছোট। এর মধ্যে থাকে ব্যাটারি এবং সার্কিট যা তড়িৎ শক্তি তৈরি করে এবং নির্দিষ্ট গতিতে লিডের মাধ্যমে হার্টে সরবরাহ করে হার্টের গতিকে নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত বাড়াতে সাহায্য করে। একটি ব্যাটারি সাধারণত ৮-১০ বছর পর্যন্ত যায়। ব্যাটারি শেষ হলে ব্যাটারির ক্যানটি পরিবর্তন করতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে লিড ঠিক থাকলে লিড পরিবর্তন করতে হয় না।

প্রশ্ন: পেসমেকার বসানোর পদ্ধতি সম্পর্কে যদি কিছু বলেন?

উত্তর: পেসমেকার সাধারণত ক্যাথল্যাব বা সি-আর্ম এর সাহায্যে বসানো হয়। সাধারণ ভাবে লোকাল অ্যানাস্থেশিয়া একটি পেসমেকার বসানোর জন্য যথেষ্ট। পেসমেকার বাম বা ডান কাঁধের নীচে ত্বকের ভিতরে বসানো হয়। প্রথমে ত্বক কেটে সেফালিক শিরা বার করে তার ভিতর দিয়ে লিড পাঠানো হয়। যদি সেফালিক শিরা দিয়ে লিড পাঠানো সম্ভব না হয়, তা হলে, পিএলআইয়ের সাহায্য নেওয়া হয়। সেখানে সাবক্লেভিয়ান শিরা সরাসরি ফুটো করে লিড পাঠানো হয়। সিঙ্গেল চেম্বার পেসমেকারের লিড ডান দিকের ভেন্ট্রিকলের এপেক্সে বসানো হয় এবং ডুয়েল চেম্বার পেসমেকারের একটি লিড ডান দিকের ভেন্ট্রিকলের এপেক্সে এবং আর একটি লিড ডান দিকের এট্রিয়ামের উপাঙ্গে বসানো হয়। লিডগুলি দু’ভাবে হার্টের সঙ্গে যোগ করানো যায়। প্রথমত, পেসিভ ফিক্সেসন এবং দ্বিতীয়ত স্ক্রুর সাহায্যে। বাই ভেন্ট্রিকুলার পেসমেকারের ক্ষেত্রে আর একটি লিড করোনারি সাইনাসের ভিতর দিয়ে বাম ভেন্ট্রিকলের পিছন দিকে বসানো হয়। লিডের পজিশন এবং কাজ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরে যে দিক দিয়ে লিড ঢোকানো হয়েছে সেখানকার কাছাকাছি মাংসপেশি বা ফেসিয়ার সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হয়, যাতে পরে লিড কোনও কারণে ওই জায়গা থেকে না নড়ে। এর পরে ওই জায়গায় ত্বকের নীচে একটি পকেট তৈরি করা হয়। পেসমেকারের ব্যাটারির সঙ্গে লিডকে যোগ করে ওই পকেটে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। রক্ত বেরানো বন্ধ করার পরে চামড়া সেলাই করে দেওয়া হয়। পদ্ধতিতে কোনও সমস্যা না হলে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। পেসমেকার বসানোর আগে এবং পরে দুই দিন পর্যন্ত অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়, যাতে সংক্রমণ না হয়।

প্রশ্ন: পেসমেকার বসানোর পরে রোগীর যত্ন কী ভাবে নেওয়া হয়?

উত্তর: পেসমেকার বসানোর পরে প্রথম ২৪ ঘণ্টা সাধারণত এক ভাবে শুইয়ে রাখা হয়, যাতে লিড নড়ে না যায়। পরের দিন থেকে রোগী উঠে বসতে পারেন। কিন্তু যে দিকে পেসমেকার বসেছে, সেই হাতকে শরীরের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়, সাত থেকে দশ দিনের জন্য। এতে হাতের নাড়াচাড়ার জন্য লিডে টান না পড়ে। এর পরে দ্বিতীয় বার ড্রেসিং এবং সেলাই কাটার পরে ওই হাতটিকে আস্তে আস্তে নাড়াতে বলা হয়। পেসমেকারের লিড, হার্টের সঙ্গে ঠিক ভাবে যোগ হতে ছয় থেকে আট সপ্তাহ সময় লাগে। এই সময়টুকু খুব সাবধানে থাকতে হয়। এবং হাত কম নাড়াতে বলা হয় যাতে লিড জায়গা থেকে সরে না যায়।

প্রশ্ন: পেসমেকার বসানোর পরে কী ভাবে যত্ন নেওয়া হয়?

উত্তর: প্রথম এক সপ্তাহ যে দিকে পেসমেকার বসানো আছে সেই দিকের হাত নাড়াবেন না। তার পরে আস্তে আস্তে ব্যায়াম শুরু করুন যাতে এক মাসে কনুই, মাথার লেভেল পর্যন্ত ওঠে। তার পরে আস্তে আস্তে হাত নাড়ানোর রেঞ্জ বাড়ান। তবে কখনই ঝাঁকুনি দেবেন না বা জোর করবেন না। যে হাতের উপরে পেসমেকার আছে সেই হাতে ভারী ওজন (পাঁচ কিলোগ্রামের বেশি) বেশিক্ষণ বইবেন না। কখনই পেসমেকারের হাতে জোরে ঝাঁকুনি বা চোট লাগাবেন না, তাতে লিড ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। পেসমেকার যেখানে বসছে তার উপরের ত্বকে চুলকনি বা ফুঁসকুড়ির মতো দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। বছরে এক বার পেসমেকার প্রস্তুতকারী সংস্থাকে দিয়ে পেসমেকার পরীক্ষা করান। নিয়মিত ইসিজি করান এবং চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন। সমস্যা হলে তাঁকে জানান। আউটডোর গেমস, যেখানে অনিয়ন্ত্রিত হাত, পা চলে এবং পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে সেগুলি থেকে বিরত থাকুন। পেসমেকার সংক্রান্ত কাগজপত্র সামলে রাখতে হবে।

প্রশ্ন: অনেকেরই ধারণা, পেসমেকার থাকলে, ইলেকট্রিক্যাল বা ইলেকট্রনিক্স গ্যাজেট ব্যবহার করা যায় না। এটা কতটা যুক্তিযুক্ত?

উত্তর: এটি সম্পূর্ণ ভুল। এগুলি স্বাভাবিক ভাবেই ব্যবহার করা যায়। অতিরিক্ত কোনও সাবধানতা নিতে হয় না। তবে জোরালো ইলেকট্রিক শক খেলে অসুবিধা হতে পারে। ঝড়, বৃষ্টির সময় বাইরে থাকলেও আলাদা কিছু অসুবিধা হয় না।

প্রশ্ন: পেসমেকারের কী কী সমস্যা হতে পারে?

উত্তর: পেসমেকারের সমস্যা সাধারণত দুই ধরনের— প্রথমত, তাৎক্ষণিক সমস্যা। সাধারণত পেসমেকার বসানোর সময় বা পরবর্তী ২৪ ঘন্টার মধ্যে এগুলি হয়। যেমন, পকেট হেমাটোমা বা পেসমেকারের পকেটে রক্ত জমে যাওয়া, নিউমোথেরাক্স, হিমোথেরাক্স, লিড সরে যাওয়া বা লিড ডিসলজমেন্ট। দ্বিতীয়ত হচ্ছে বিলম্বিত জটিলতা। যেমন, পেসমেকার সংক্রমণ, পকেট ক্ষয়ে যাওয়া, লিড ভেঙে যাওয়া, অক্সিলারি শিরায় রক্ত জমে যাওয়া এবং পেসমেকার সিন্ড্রোম।

সাক্ষাৎকার: বিপ্লব ভট্টাচার্য

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Heart Patient Heart Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE