E-Paper

হাত বাড়ালেই বন্ধু?

প্রতি পদে মানুষের বন্ধু, সহযোগী হয়ে উঠছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। সত্যিই কি হচ্ছে? এর প্রভাব কিন্তু সুদূরপ্রসারী

সায়নী ঘটক

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২৫ ০৬:৫২

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে আলোচনা, বিতর্ক, আশঙ্কা, বিস্ময়ের শেষ নেই। এআই-এর ব্যবহার কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, পাল্টে দিতে পারে আমাদের দিনযাপন, তা কমবেশি অনেকেই জানেন। কিন্তু তা নিয়ে আমরা সত্যিই কতটা সচেতন? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বন্ধুত্ব, তার প্রতি নির্ভরশীলতা পাল্টে দিচ্ছে না তো আমাদের? মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক সংযোগের উপরে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে আমরা কি আদৌ চিন্তা করছি?

এমন বন্ধু আর কে আছে?

২০২৫-এ দাঁড়িয়ে বিশ্ব জুড়ে একাকিত্ব ‘সায়লেন্ট এপিডেমিক’-এর আকার নিয়েছে। বিভিন্ন বয়সের মানুষের একা হয়ে যাওয়া, মানসিক অবসাদে ডুবে যাওয়ার সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাত ধরা কতটা সমীচীন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। রোবটের সঙ্গে বন্ধুত্ব, চ্যাটজিপিটি, অ্যালেক্সা কিংবা জেমিনাই-এর সঙ্গে অনর্গল কথোপকথন চালিয়ে যাওয়া সাময়িক সাহচর্য দেয় ঠিকই। শেখায়ও অনেক কিছুই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি তা মানুষের পরিবর্ত হয়ে উঠতে পারে? তা কি সামাজিক ভাবে আরও বিচ্ছিন্ন করে দেয় না আমাদের?

এ প্রসঙ্গে পিজি হাসপাতালের রোবট কমিটির আহ্বায়ক শল্যচিকিৎসক ডা. দীপ্তেন্দ্র কুমার সরকার প্রথমেই একটি বিষয় স্পষ্ট করে দিলেন। তাঁর কথায়, “আমাদের একটা কথা সব সময়ে মনে রাখতে হবে যে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হল হিউম্যান ইন্টেলিজেন্সের মস্তিষ্কপ্রসূত। তাই সেটা মানুষকে সাহায্য করার জন্য, বিকল্প নয়। দিনের শেষে এআই কিন্তু সেই সব তথ্যের ভিত্তিতেই কাজ করে, যা মানুষ তার মধ্যে ভরে দিয়েছে। নিউরাল নেটওয়ার্ক মেকানিজ়মে কাজ করে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।’’

ডা. সরকার জানালেন, এআই নিয়ে যত কাজ হচ্ছে, তার মধ্যে হিউম্যান ইনটিউশনের উপরে কাজ শুরু হয়েছে সদ্য। ‘‘এআই দিয়ে মানুষের আবেগকে ম্যানিপুলেট করা খুব সহজ নয়। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তা ভিন্ন ভাবে কাজ করবে। এআই কিছু বিকল্প দিতে পারে মাত্র। তা কোন মানুষের মন কী ভাবে গ্রহণ করবে, সেটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়,’’ বললেন তিনি। একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েও দিলেন। পরিবারের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে এমন কোনও ব্যক্তি, পাশাপাশি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও ব্যক্তি— এই দু’জনের যদি প্রেমে বিচ্ছেদ ঘটে, দু’জনের রেসপন্স আলাদা হবে।

আমি সেই মানুষটা আর নেই

দিবারাত্রি অ্যালেক্সাকে নানা প্রশ্ন করে যাচ্ছে বাড়ির খুদেটি। অথবা, অবসরপ্রাপ্ত এক বৃদ্ধ রোজ সকালে উঠে চ্যাটজিপিটিকে ‘গুডমর্নিং’ লিখে দিন শুরু করছেন। আমাদের আশপাশে এমন উদাহরণ খুব বিরল নয় এখন আর। বাড়িতে পোষ্য থাকলে তার সঙ্গে যেমন মানুষের মানসিক সংযোগ তৈরি হয়, একই ভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হতে পারে।

কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালের কনসালট্যান্ট সায়কায়াট্রিস্ট দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘যার কোনও মুখ নেই, যে জাজমেন্টাল নয়, অনেক সময় তার সঙ্গে অবিরাম কথোপকথন চালিয়ে যেতে আমরা স্বচ্ছন্দ বোধ করি। কিন্তু এর কিছু পরিণতিও রয়েছে।’’ ইমোশনাল ফ্ল্যাটেনিং, সোশ্যাল ডিট্যাচমেন্ট এর একটা বড় ফলাফল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে চায়ের আড্ডা কিংবা বন্ধু-আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার একটা কারণ এটাও। ‘‘যাঁরা অতিমাত্রায় এআই-এর সঙ্গে কমিউনিকেট করেন, তাঁদের মধ্যে সব বিষয়েই একটা কৃত্রিম, সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া দেওয়ার প্রবণতা চলে আসে অনেক সময়ে। স্ক্রিপ্টেড রেসপন্স। উল্টো দিকের মানুষটার কথা ভেবে কথা বলার অভ্যেস পাল্টে যাচ্ছে,’’ বললেন ডা. বন্দ্যোপাধ্যায়।

দেশি-বিদেশি সিনেমায় রোবটের সঙ্গে মানুষের বন্ধুত্বের গল্প দেখানো হয়েছে একাধিক বার। সমস্যা হল, এই যে আমরা ধীরে ধীরে অ্যালেক্সা, জেমিনাই, চ্যাটজিপিটিকে প্রায় মানুষরূপ দিয়ে ফেলছি, একটা আদরের নাম ও লিঙ্গরূপ দিয়ে তাকে আপন করে নিচ্ছি... স্বাভাবিক সামাজিক আবর্ত থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ার শুরুও ঠিক সেখান থেকেই।

শিশুমন ও এআই

অনেক বাবা-মা বিভিন্ন আধুনিক গ্যাজেট বা সফটওয়্যার ব্যবহার করে বাচ্চাদের খেলায়, শেখায়, ব্যস্ত রাখেন। প্রথমত, এআই-এর সঙ্গে কমিউনিকেশন সব সময়েই এক তরফা। বাচ্চারা জানে, তারা কিছু বললেই অ্যালেক্সা সঙ্গে সঙ্গে সেটা করে দেবে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পেতে অভ্যস্ত হয়ে যায় তারা। তাই ছোটবেলা থেকেই অপেক্ষা করতে শেখে না বাচ্চারা। না পাওয়ার হতাশা সহ্য করার ক্ষমতা চলে যায়। সমবয়সি বাচ্চাদের সঙ্গে কী ভাবে মিশবে, কী করে দল বেঁধে খেলবে বা অনুষ্ঠানে অংশ নেবে, তাতেও অসুবিধে হতে পারে। তাই বাচ্চাদের সামাজিক বিকাশে দেরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় চিন্তাশক্তি, বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা। ছোটদের সৃজনশীলতা, কগনিটিভ কিউরিয়োসিটি হ্রাস পায় বলেও মনে করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে সমাজতত্ত্ববিদ সুহৃতা সাহা বলছেন, ‘‘ঘোড়া দেখলে খোঁড়া হওয়ার রোগ আমাদের সকলের আছে। বাচ্চারাও বাদ নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার ফলে, যে কোনও সমস্যায় নিজেদের সাধারণ বিচারবুদ্ধি কাজে লাগাতে পারছে না তারা।’’ শিক্ষার্থীদের সাহায্য করলেও এআই যেন ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের রূপ নিয়ে আমাদেরই ছাপিয়ে না যায়, সে খেয়াল রাখা দরকার বলে মনে করেন সুহৃতা।

ডা. সরকার এ প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘এআই কিন্তু মধ্যমেধাকে প্রোমোট করে। এর ফলে পারফরম্যান্স অব দ্য স্ট্যান্ডার্ড কমছে দিনে দিনে। প্রতিভা বা পরিশ্রমের কী দরকার যদি কৃত্রিম ইন্টেলিজেন্স দিয়েই তা হয়ে যায়? এই প্রবণতা কিন্তু আশঙ্কাজনক। একটা সময় আসতে পারে, যখন সকলে একই রকম লেখা লিখবেন, একই ধরনের মিউজ়িক তৈরি হবে।’’

ঘরদোর পরিষ্কার, অঙ্কের সমাধান, সিনেমা তৈরি থেকে শুরু করে একাকিত্ব কাটানো… এআই পারে না হেন কাজ নেই। তবে এখনও এআই পারে না অনেক কিছুই। তার মধ্যে অন্যতম হল, মানুষে-মানুষে সংযোগের সত্যিকারের বিকল্প তৈরি করতে পারেনি এআই। ‘‘ক্লিনিক্যাল জাজমেন্ট, এমপ্যাথি, এথিক্যাল মরাল রিজ়নিং এই সবকে এখনও প্রতিস্থাপন করতে পারেনি এআই,’’ মত ডা. বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

অতএব অন্ধ নির্ভরশীলতা নয়, এআই থাকুক সহযোগী রূপে। মানুষের আগে নয়, ঠিক পাশটিতেই।


মডেল: ময়না বন্দ্যোপাধ্যায় ও ওঙ্কার ভট্টাচার্য, মেকআপ: কুশল মণ্ডল, ছবি: দেবর্ষি সরকার, লোকেশন ও হসপিটালিটি:রান্নী, গড়িয়াহাট

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

human life AI

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy