বলুন তো গ্রিক বর্ণমালার অষ্টাদশ অক্ষর এবং বাইশ বছর বয়সি সুইডিশ এক পরিবেশবিদের মধ্যে মিল কোথায়? এই গোলমেলে হেঁয়ালির উত্তরটা ছোট— ‘সিগমা’। কারণ গ্রিক বর্ণমলার এই অক্ষরটিকে এখন ব্যবহার করা হয় বিশেষ এক ধরনের মেয়েদের বোঝাতে। কেমন সেই মেয়েরা?
এক কথায় বললে, ‘সামগ্রিক’ বা ‘পূর্ণ’। গ্রিক বর্ণ ‘সিগমা’র অর্থও তো তাই। সাম্প্রতিক কালে সমাজমাধ্যমে নানা ব্যক্তিত্বভিত্তিক ধ্যানধারণা বা ‘পার্সোনালিটি আর্কিটাইপ’ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এই ধরনের আলোচনার ফলেই উঠে এসেছে ‘সিগমা ফিমেল’ বা ‘সিগমা নারী’ শব্দবন্ধটি। সাধারণ ভাবে বললে, ‘আলফা নারী’র এক বিকল্প রূপ ‘সিগমা নারী’। তাঁকে সাধারণত আত্মনির্ভর, অন্তর্মুখী এক নারী হিসেবে তুলে ধরা হয়। এক জন সিগমা নারী প্রচলিত সামাজিক স্তরবিন্যাসের বাইরে নিজের পথ নিজেই তৈরি করে নেন।
কারা এই সিগমা ফিমেল?
সিগমা নারীর মূল বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে রয়েছে স্বনির্ভরতা, বিশেষ করে আর্থিক স্বনির্ভরতা এবং আত্মসচেতনতা। সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়ে তাঁরা একটু বেশি রকমের খুঁতখুঁতে। তাই অনেকেই কোনও বিশেষ এক জন ‘জীবনসঙ্গী’ ছাড়াই কাটিয়ে দেন গোটা জীবন। আলফা নারীরা যেখানে নেতৃত্ব দিতে পছন্দ করেন ও কর্মক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে ভালবাসেন, সেখানে সিগমা নারীরা নিজস্ব পথ বেছে নেন এবং অন্যের স্বীকৃতির প্রয়োজন বোধ করেন না। তাঁরা আত্মবিশ্বাসী, কিন্তু আত্মপ্রচারে বিশ্বাসী নন। তাঁরা উচ্চাকাঙ্ক্ষী, কিন্তু চোখে পড়ার মতো কোনও আচরণ করেন না। যাঁরা প্রচলিত নারীত্বের ছাঁচে নিজেদের খুঁজে পান না, তাঁদের জন্য এই রূপটি বেশ আকর্ষক।
সিগমা নারী নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেন এবং সমাজের চাপ বা জনপ্রিয় মতামতের দ্বারা সহজে প্রভাবিত হন না। তিনি ট্রেন্ড অনুসরণ করতে পছন্দ করেন না, বরং ট্রেন্ড সেট করেন। এর ফলে অনেক সময়ে তিনি অন্যদের কাছে ‘রহস্যময়ী’ বা ‘দূরবর্তী’ বলে মনে হতে পারেন, কিন্তু তাঁর এই আত্মপ্রত্যয় অনেকের শ্রদ্ধাও অর্জন করে।
সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রেও সিগমা নারীরা স্বতন্ত্র। অনেকের সঙ্গে মিশতে না চাইলেও, ঘনিষ্ঠদের প্রতি খুব বিশ্বস্ত ও আন্তরিক তাঁরা। সিগমা নারী শুধু গভীর ও আন্তরিক সম্পর্কেই আগ্রহী।
পেশাগত জীবনে সিগমা নারীরা সাধারণত নীরবে সফল হন। তাঁরা দক্ষ। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বাহ্যিক স্বীকৃতির চেয়ে অভ্যন্তরীণ তৃপ্তি ও উদ্দেশ্যকে প্রাধান্য দেন। তাঁরা সাধারণত অফিস রাজনীতি বা অতিরিক্ত প্রকাশ্য ভূমিকা এড়িয়ে চলেন।
মানবচরিত্র বোঝাতে ‘সিগমা’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন কট্টরবাদী আমেরিকান লেখক থিয়োডোর রবার্ট বেল ওরফে ভক্স ডে। কিন্তু নারীবিদ্বেষী এই লেখক বিশেষ ধরনের পুরুষদের গুণাবলি বোঝাতে ‘সিগমা’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। সেটা ২০১০-এর কথা। এর প্রায় দেড় দশক পরে এই শব্দটি মেয়েদের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা শুরু হয়। ঠিক যেমন ভাবে ‘আলফা মেল’ চরিত্রের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে তৈরি হয়েছিল ‘আলফা ফিমেল’-এর ধারণা। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, এই সব ধারণা বা শব্দচয়ন এখনও প্রাতিষ্ঠানিক মনোবিজ্ঞানের অংশ হয়ে ওঠেনি। মূলত বিভিন্ন সমাজমাধ্যমেই আধুনিক নারীর আত্মপরিচয় ও ক্ষমতায়নের রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয় ধারণাটি।
গ্রেটা থুনবার্গ, রিহানা, জ়েন্ডেয়া, জোডি ফস্টার সিগমা ফিমেলের বড় উদাহরণ। মজার কথা, যে চরিত্রে অভিনয় করে অস্কার জিতে নিয়েছিলেন জোডি ফস্টার, ‘দ্য সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস’-এর সেই ক্ল্যারিস স্টার্লিং-কেও সিগমা নারী ভাবা হয়। তা ছাড়া, হলিউডের বিভিন্ন সিনেমা বা সিরিয়ালেও সিগমা নারীকে মুখ্য ভূমিকায় দেখা গিয়েছে। যে তালিকায় রয়েছেন ‘দ্য গার্ল উইথ দ্য ড্র্যাগন ট্যাটু’র লিজ়বেথ স্যালান্ডার, ‘গেম অব থ্রোনস’-এর আরিয়া স্টার্ক এবং ‘মার্ভেলস জেসিকা জোনস’-এর জেসিকা জোনস।
বাস্তবে হোক বা রুপোলি পর্দায়, স্বাধীন, আত্মবিশ্বাসী, সম্পর্ক নিয়ে বিশেষ মাথা-না-ঘামানো মেয়েদের বোঝাতে ‘সিগমা’ শব্দের ব্যবহার বাড়ছে। বৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাসের অন্তর্গত না হলেও শব্দটি ক্রমশ আত্ম-অন্বেষণ ও অন্যকে বোঝার জন্য একটি কার্যকর ফ্রেমওয়ার্ক হয়ে উঠছে। এক নারীবিদ্বেষী লেখকের শব্দচয়ন যে ভাবে ধীরে ধীরে নীরব নারীশক্তির রূপক হয়ে উঠছে, তাতে নারীবাদী ভাষ্যেরই জয় দেখছেন সমাজবিজ্ঞানী ও ভাষাবিদদের একাংশ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)