E-Paper

এই কর্কটরোগে সুস্থ হওয়ার হার বেশি

থাইরয়েড গ্রন্থিতে কর্কটরোগ ঠিক সময়ে শনাক্ত হলে চিকিৎসার মাধ্যমে দীর্ঘ দিন সুস্থ জীবনযাপন সম্ভব। রইল বিশেষজ্ঞের পরামর্শ।

ঊর্মি নাথ 

শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২৫ ০৭:২৯

—প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।

কর্কটরোগ, এই শব্দটির সঙ্গে পরতে পরতে জড়িয়ে আছে সংশয়, ভয়। কিন্তু থাইরয়েড গ্রন্থিতে কর্কটরোগ শনাক্ত হওয়ার পরে, ঠিক সময়ে চিকিৎসা হলে দীর্ঘ দিন সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকা যায়। এই প্রসঙ্গে কর্কটরোগের শল্য চিকিৎসক ডা. গৌতম মুখোপাধ্যায় বললেন, “বেশির ভাগ রোগীর থাইরয়েড ক্যানসার থেকে সেরে ওঠার সম্ভাবনা বেশি, প্রায় ৯৯ শতাংশ। তবে এই আরোগ্য বয়সের সঙ্গে সম্পর্কিত। ৫৫ বছরের কম বয়স হলে, সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।” অন্যান্য ক্যানসার নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে যতটা সচেতনতা দেখা যায়, এই ক্যানসার সম্পর্কে তা নেই। তাই অনেক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় অজ্ঞতা।

থাইরয়েড গ্রন্থি সম্পর্কে ধারণা

গলায় শ্বাসনালির সামনের দিকে থাকে থাইরয়েড গ্রন্থি, যার আকার অনেকটা প্রজাপ্রতির মতো। এই গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত টি-ফোর বা থাইরক্সিন, টি-থ্রি বা ট্রাইআয়োডোথাইরোনিন বিপাকক্রিয়া ঠিক রাখতে, বুদ্ধির বিকাশ ঘটাতে, শিশুদের স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠতে, মহিলাদের ঋতুচক্র ও গর্ভধারণ ইত্যাদি শারীরবৃত্তীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে হরমোন অতিরিক্ত নিঃসৃত হলে বা প্রয়োজনের কম নিঃসৃত হলে শরীরে নানা সমস্যা হয়। রক্তে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কমে যাওয়াকে বলে হাইপোথাইরয়েডিজ়ম আর এর উল্টো হলে অর্থাৎ রক্তে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা বেড়ে গেলে বলে হাইপারথাইরয়েডিজ়ম। দু’টি ক্ষেত্রেই হরমোনের ঠিক মাত্রা নিয়ন্ত্রিত রাখার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে আজীবন ওষুধ খেতে হয়।

কর্কটরোগ বোঝার উপায়

থাইরয়েড গ্রন্থিতে মাংসল পিণ্ড বা টিউমারের জন্ম হলে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা দানা বাঁধে। টিউমারের আকার খুব ছোট হলে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, কিন্তু একটু বড় হলে তার উপস্থিতি বাইরে থেকে বোঝা যায়। এ ছাড়া কিছু ক্ষেত্রে গলার স্বরে বদল আসে, কোনও কারণ ছাড়াই ওজন কমে যাওয়া, ঢোঁক গিলতে গিয়ে ব্যথা অনুভব হয় ইত্যাদি।

সব সময় গলায় ব্যথা নাও হতে পারে। যদি দেখা যায় মাংসপিণ্ড ঢোঁক গেলার সঙ্গে উঠছে ও নামছে (বাইরে থেকে দেখে বোঝা যাবে), তা হলে সজাগ হতে হবে। ব্যথা নেই বলে অবজ্ঞা করা চলবে না। অনেকেই এই ভুলটা করেন। এমন হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। “এ ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল টেস্টের পরে আমরা আলট্রাসোনোগ্রাফি করে দেখে নিই থাইরয়েড গ্রন্থিতে টিউমার আছে কি না। টিউমার থাকলে এফএনএসি করা হয়। ম্যালিগন্যান্ট হোক বা বিনাইন, টিউমার হলেই বাদ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রসঙ্গত বলি, থাইরয়েড গ্রন্থিতে টিউমার হলেই দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিনাইন হয়। তবে যেমনই হোক না কেন, বেশি দিন ফেলে না রেখে সার্জারি করে বাদ দিয়ে দেওয়াই ভাল,” পরামর্শ দিলেন ডা. মুখোপাধ্যায়। প্রচলিত ধারণা, হাইপোথাইরয়েডিজ়ম বা হাইপারথাইরয়েডিজ়ম থাইরয়েড ক্যানসারকে তরান্বিত করে। এই বিষয়ে ডা. মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “এই ধারণা ভুল। রক্তে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক থাকলেও ক্যানসার হতে পারে। বরং হাইপারথাইরয়েডিজ়ম থাকলে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলক ভাবে কম।”

—প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।

সেরে ওঠার পথ

প্যাপিলারি, ফলিকিউলার, অ্যানাপ্লাসটিক... থাইরয়েড ক্যানসারের একাধিক ভাগ দেখা যায়। “প্যাপিলারি থাইরয়েড ক্যানসার কমবয়সি মহিলাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। প্যাপিলারি ও ফলিকিউলার থাইরয়েড ক্যানসার থেকে সেরে ওঠার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। খারাপ ভ্যারাইটি হল অ্যানাপ্লাসটিক। কিন্তু এটি সচারাচর হতে দেখা যায় না,’’ বললেন ডা. মুখোপাধ্যায়। থাইরয়েড ক্যানসার সারিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে দীর্ঘ জীবন যাপন করা সম্ভব। অবশ্যই যত আগে এই ক্যানসার ধরা পড়বে, তত ভাল ফল পাওয়া যাবে। এই ক্যানসার আগে ধরা পড়লে থাইরয়েড গ্রন্থির দু’টি লোবের মধ্যে একটি বাদ দিলেই হয়, কিন্তু দেরি হলে বা কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনেও গোটা থাইরয়েড গ্রন্থি সার্জারি করে বাদ দিতে হয়। শণাক্তকরণে বা চিকিৎসায় দেরি হলে ক্যানসার ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যেমন, প্যাপিলারি ক্যানসার গলায়, কিছু ক্ষেত্রে ফুসফুসে ছড়াতে পারে। ফলিকিউলার ক্যানসার কিছু ক্ষেত্রে হাড়ে ছড়িয়ে যায়।

“থাইরয়েড ক্যানসারের ক্ষেত্রে ছড়িয়ে গেলেও সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। তবে থাইরয়েড ক্যানসারের সার্জারি বেশ জটিল। এই গ্রন্থির নীচ দিয়ে দুটো রেকারেন্ট ল্যারিনজিল নার্ভ যায়, যা আমাদের কণ্ঠস্বর নিয়ন্ত্রণ করে। অপারেশন করতে গিয়ে দুটো নার্ভের মধ্যে কোনও একটার ক্ষতি হলে গলার স্বর চিরতরে বদলে যাবে। থাইরয়েড গ্রন্থির পিছনে থাকে প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি, যা শরীরে ক্যালশিয়াম, ফসফরাস ও মেটাবলিজ়ম নিয়ন্ত্রণ করে। এই প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থিও বাঁচাতে হয়। তাই এই অপারেশনের জন্য একজন দক্ষ, অভিজ্ঞ সার্জনের প্রয়োজন।” সাধারণত ক্যানসারের চিকিৎসায় রেডিয়োথেরাপি বা কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। থাইরয়েডের ক্যানসারে তা দিতে হয় না। অস্ত্রোপচারের পর প্রয়োজন পড়লে রোগীকে আয়োডিন খাওয়ানো হয়। এই পদ্ধতিকে বলে রেডিয়োঅ্যাবলেশন। এতে রোগী রেডিয়ো অ্যাকটিভ হয়ে যান, তখন তাঁকে দু’-তিন দিন আইসোলেশনে রাখা হয়।

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কোনও বয়সে থাইরয়েড ক্যানসার হতে পারে। কিন্তু তার মধ্যে কমবয়সি মহিলাদের মধ্যে এই ক্যানসার হওয়ার প্রবণতা বেশি। অনেকেরই মনে সংশয় থাকে থাইরয়েড গ্রন্থি বাদ দিলে শরীরে থাইরয়েড হরমোনের কাজ বন্ধ হয়ে যাবে, এতে ঋতুচক্র বা ভবিষ্যতে সন্তানধারণে সমস্যা হবে। “থাইরয়েড গ্রন্থি বাদ দিলেও ওষুধ দিয়ে হরমোনের কাজ স্বাভাবিক রাখা হয়। সারা জীবন সে ওষুধ খেয়ে যেতে হবে। ব্লাডসুগার বা ব্লাডপ্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখতে যেমন সারা জীবন ওষুধ খেতে হয়, অনেকটা তেমনই। থাইরয়েড ক্যানসার থেকে নিরাময়ের পরে দাম্পত্য জীবনে বা গর্ভধারণে কোনও সমস্যা হয় না,” আ‌শ্বাস দিলেন ডা. মুখোপাধ্যায়।

গলায় মাংসল পিণ্ড অনুভব করলে বা বাইরে থেকে বোঝা গেলে, ব্যথা থাকুক বা না থাকুক, অবজ্ঞা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। না হলে এই অবহেলা ক্যানসার থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Thyroid Cancer treatment cancer awareness Cancer Patient Health care Cancer Care

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy