Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Colostrum

জন্মের পর মায়ের হলুদ দুধ কোলোস্ট্রামই আজীবন রোগ প্রতিরোধের হাতিয়ার

করোনার অতিমারির সময় প্রত্যেক নবজাতকের মাকে মনে রাখতে হবে, স্তন্যপান করানোর ব্যাপারে কোনও রকম আপস চলবে না

কোলোস্ট্রামে উপস্থিত অ্যান্টিবডি সদ্যোজাতর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ভিত মজবুত করে। ছবি: শাটারস্টক

কোলোস্ট্রামে উপস্থিত অ্যান্টিবডি সদ্যোজাতর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ভিত মজবুত করে। ছবি: শাটারস্টক

সুমা বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২০ ১২:০৩
Share: Save:

নভেল করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে সবাইকে,এমনকি সদ্যোজাতদেরও। করোনাভাইরাস ছাড়াও জীবন ভর নানান অসুখ বিসুখ আটকাতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে জোরদার করে তুলতে হবে। আর এর প্রথম ধাপ জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই শিশুকে কোলোস্ট্রাম দেওয়া।

১ – ৭ অগস্ট পৃথিবী জুড়ে পালন করা হচ্ছে মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ। করোনার অতিমারির সময় প্রত্যেক নবজাতকের মাকে মনে রাখতে হবে, স্তন্যপান করানোর ব্যাপারে কোনও রকম আপস চলবে না। বিশেষজ্ঞদের মতে মায়ের দুধ সদ্যোজাতর প্রথম ভ্যাকসিন। বিশেষ করে শিশু ভূমিষ্ঠ হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই মায়ের যে হালকা হলদেটে দুধ নিঃসৃত হয় তার নাম কোলোস্ট্রাম।

এতে আছে নানা ধরনের অ্যান্টিবডি যা সদ্যোজাতর রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার ভিত মজবুত করতে সাহায্য করে। যাঁরা মা হতে চলেছেন এবং সদ্য মা হয়েছেন তাঁদের মনে রাখা দরকার, যতই শারীরিক কষ্ট হোক না কেন, বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হবার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে স্তন্যপান করানো উচিত কোলোস্ট্রামের জন্যে, বললেন শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ শান্তনু রায়।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যেই শিশুকে স্তন্যপান করালে ভবিষ্যতে নানা অসুখ বিসুখকে দূরে রাখার পাশাপাশি বুদ্ধির বিকাশ হয় দ্রুত। প্রসবের ঠিক পরে পরেই মায়ের স্তন বৃন্ত থেকে ঈষৎ হলদেটে ঘন দুধ নিঃসৃত হয়। এই দুধকে বলা হয় কোলোস্ট্রাম। পুষ্টি বিজ্ঞানীরা বলেন তরল সোনা।

আরও পড়ুন: নিজে থেকে কোভিড টেস্ট করা কতটা জরুরি? কী বলছেন চিকিৎসকরা?

এই কোলোস্ট্রাম নামক যৎসামান্য মাতৃদুগ্ধ সদ্যোজাতকে দিলে ভবিষ্যতে নানা রোগ প্রতিরোধ করা সহজ হয় বললেন শান্তনু বাবু। প্রসবের পর ম্যামারি গ্ল্যান্ডে জমে থাকা ঘন কোলোস্ট্রাম, স্বাভাবিক মাতৃদুগ্ধের থেকে প্রায় ১০ গুণ ঘন। মাত্র ২– ৩ দিন এই দুধ নিঃসৃত হয়। কোলোস্ট্রাম নিঃসরণের পরিমাণ অত্যন্ত কম সারা দিনে মাত্র কয়েক চামচ। তবে তা নিয়ে চিন্তা করার কোনও কারণ নেই, কারণ সদ্যোজাতর পাকস্থলীর আকার একটা মার্বেল গুলির মত। (যদিও প্রতি মুহুর্তে পাকস্থলির আকারে বাড়ে) তাই প্রথম দু’তিন দিন যৎসামান্য অমৃতেই সে ভরপেট হয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোয়, বললেন ল্যাকটেশন নার্স সায়ন্তী নাগচৌধুরী।

কোলোস্ট্রামে আইজিএ (IgA) নামক এক বিশেষ ধরনের অ্যান্টিবডি থাকে যা সদ্যোজাতর মুখগহ্বর, গলা, থেকে শুরু করে ফুসফুস ও অন্ত্র প্রতিটি অঙ্গের রক্ষাকারী আবরণ মিউকাস মেমব্রেনকে সুরক্ষিত রাখে। মিউকাস স্তর মজবুত হলে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সহজ। এমনকি যদিও বা ইনফেকশন হয় তা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌছতে পারে না। বিশেষ করে প্রিটার্ম বেবি অর্থাৎ সময়ের আগেই ভূমিষ্ঠ হয়েছে যে শিশু, তাদের শ্বাসনালী ও ফুসফুসের সংক্রমণের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় বেশি।

টিউমার তৈরিতে বাধা প্রদান করে কোলোস্ট্রাম। ছবি: শাটারস্টক

প্রসূতির যতই শারীরিক কষ্ট থাকুক না কেন, বাচ্চার ভবিষ্যত সুরক্ষিত রাখতে জন্মের পর দ্রুত কোলোস্ট্রাম পান করাতেই হবে। শুধুই যে IgA অ্যান্টিবডি আছে তা নয়, সদ্য মায়ের প্রথম দুধে আছে এমন কিছু পুষ্টিকর উপাদান যা শিশুকে দিলে তার জীবনভর সুরক্ষা প্রায় সুনিশ্চিত। স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় জানালেন যে মায়ের এই দুধ পান করলে শিশুকে জন্ডিসের সমস্যায় ভুগতে (ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস) হয় না। একই সঙ্গে মায়ের শরীরের সব হরমোন নিঃসরণ দ্রুত নির্দিষ্ট ছন্দে ফিরে আসে।

কোলোস্ট্রাম নিয়ে নানান গবেষণায় এর অজস্র গুণাগুণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেগুলি একে একে জেনে নেওয়া যাক।

· কোলোস্ট্রামে এক বিশেষ ধরনের প্রোটিন সাইটোকাইনস থাকে যথেষ্ট পরিমাণে। শরীরের প্রতিটি কোষের গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয় এই সাইটোকাইনস। একই সঙ্গে ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে, পেন রিলিভিং অর্থাৎ ব্যথা কমাতে এবং টিউমার তৈরিতে বাধা দেয় সাইটোকাইনস।

· লাইসোজাইম নামে এক বিশেষ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এনজাইম থাকে। এটি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।

আরও পড়ুন: করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে টিকে থাকতে কী কী প্রয়োজন? কী বললেন চিকিৎসকেরা?

· মায়ের প্রথম দুধে আছে ল্যাক্টো অ্যালবুমিন যা মস্তিষ্কের সেরোটোনিন নামে নিউরোট্র্যান্সমিটারের কার্যকারিতা বাড়িয়ে দিয়ে বুদ্ধির বিকাশ ও মন ভাল রাখতে সাহায্য করে। গবেষণায় প্রমাণিত যে ল্যাক্টো অ্যালবুমিনের টিউমাররোধক ও ক্যানসাররোধক ক্ষমতা আছে।

· সদ্য মায়ের প্রথম দুধ কোলোস্ট্রাম গ্রোথ ফ্যাক্টরে পূর্ণ। বাচ্চার ত্বক, পেশি, কার্টিলেজ, নার্ভ টিস্যু ও হাড় গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা নেয় গ্রোথ ফ্যাক্টর। জন্মের পর প্রথম দু’তিন দিন এই দুধ পান করলে প্রায় জীবন ভর সুরক্ষিত থাকবে আপনার পরবর্তী প্রজন্ম।

· প্রোটিন রিচ পলিপেপটাইড বা পিআরপিএস সমৃদ্ধ কোলোস্ট্রাম নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে ই-কোলাই, রোটা ভাইরাস, সিগেলার মত মারাত্মক সংক্রমণের হাত থেকে এটি আজীবন সুরক্ষা দিতে পারে। এই প্রসঙ্গে একটা কথা জেনে রাখা ভাল যে আমাদের দেশ-সহ প্রায় সবকটি উন্নয়নশীল দেশে রোটা ভাইরাসের সংক্রমণে অজস্র সদোজাত শিশুর মৃত্যু হয়। কোলোস্ট্রাম খাওয়ানোর অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে অনায়াসে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধ করা যায়। আর এই কারণেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এবং ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর ব্রেস্ট ফিডিং অ্যাকশন জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যেই মায়ের দুধ খাওয়ানোর ওপর জোর দিচ্ছেন।

আরও পড়ুন: কোভিড সারার পর কতদিনে স্বাভাবিক হবে জীবন?

এগুলি ছাড়াও কোলোস্ট্রামে আছে গ্লাইকোপ্রোটিন, ইমিউনোগ্লোবিউলিন, ল্যাক্টোফেরিন-সহ অজস্র উপাদান। যা একজন মানব শিশুর সুস্থ শরীর ও মন গড়ে তুলতে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা নেয়। তাকে দিতে পারে সুস্থ নীরোগ দীর্ঘজীবন। করোনাই হোক বা অন্যান্য অসুখ বিসুখ, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত রাখতে মাতৃদুগ্ধই হোক শিশুর একমাত্র খাবার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE