Advertisement
০৭ ডিসেম্বর ২০২৪
travel

Women’s Day Special: জীবনের লড়াই যখন একাই লড়তে হবে, তবে ঘুরতে গেলে সঙ্গী কেন প্রয়োজন

আমরা যারা প্রতি মুহূর্তে লড়াই করি, তারা বোধ হয় পালাতে জানি না। বহু কাল ধরে লড়তে লড়তে মনে হয় লড়ে যাওয়াটাই বোধহয় আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি।

দীর্ঘ দিন ধরে যে ইচ্ছেটা ঘুমিয়েছিল, সেটাই মাথাচাড়া দিয়েছিল হঠাৎ। মনে হয়েছিল, দিনকয়েকের জন্য সব ‘চেনা’দের জটলা থেকে যদি হারিয়ে যাওয়া যেত!

দীর্ঘ দিন ধরে যে ইচ্ছেটা ঘুমিয়েছিল, সেটাই মাথাচাড়া দিয়েছিল হঠাৎ। মনে হয়েছিল, দিনকয়েকের জন্য সব ‘চেনা’দের জটলা থেকে যদি হারিয়ে যাওয়া যেত!

সঞ্চারী কর
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২২ ১১:৫৫
Share: Save:

প্রায় চলে-যাওয়া শীতের কোনও এক দুপুর। রোজকার মতো চোখের সামনে হাট করে খোলা ল্যাপটপ। ঠকাঠক-ঠকাঠক শব্দ তুলে কপি লিখছি। কাজের সুবিধার্থে খুলে রাখা অগুনতি ট্যাবের ভিড়ে গুম মেরে থাকা ইউটিউব থেকে ভেসে এল— ‘হারিয়ে গিয়েছি/এই তো জরুরি খবর’।

অর্ণবের এই গানটা আমার কাছে একটা নিস্তরঙ্গ নদীর মতো। যেখানে ব্যস্ততা নেই। আছে প্রশান্তি, স্থিরতা। যার দিকে শুধুই তাকিয়ে থাকা যায়। শব্দহীন হওয়া যায়।

বলিউডের হালহকিকৎ লিখতে লিখতে সেই দুপুরে এই চিন্তাগুলোই ভিড় করেছিল মনে। অবাক হয়েছিলাম। ভেবলে গিয়েছিলাম বললেও অবশ্য ক্ষতি হবে না! দীর্ঘ দিন ধরে যে ইচ্ছেটা ঘুমিয়ে ছিল, সেটাই মাথাচাড়া দিয়েছিল হঠাৎ। মনে হয়েছিল, দিনকয়েকের জন্য সব ‘চেনা’দের জটলা থেকে যদি হারিয়ে যাওয়া যেত! যেখানে কেউ আমায় চিনবে না, কোনও প্রশ্ন করবে না। আমি কেমন আছি, জানতে চাওয়ার সৌজন্যটুকুও দেখাবে না। এর পর আর কিছু ভাবিনি। ভাবতে পারিনি। দিন চারেকের জন্য ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। গন্তব্য বোলপুর।

আমরা যারা প্রতি মুহূর্তে লড়াই করি, তারা বোধ হয় পালাতে জানি না।

আমরা যারা প্রতি মুহূর্তে লড়াই করি, তারা বোধ হয় পালাতে জানি না।

আমরা যারা প্রতি মুহূর্তে লড়াই করি, তারা বোধ হয় পালাতে জানি না। বহু কাল ধরে লড়তে লড়তে মনে হয় লড়ে যাওয়াটাই বোধহয় আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি। যতই রক্তক্ষরণ হোক বা দুমড়েমুচড়ে যাই, ভাঙা টুকরোগুলোকে যেনতেন প্রকারেণ জুড়ে নিয়ে আবার মাঠে নেমে পড়ি। দাঁত-নখ বার করে লড়ে যাই।

এই লড়াইয়েরও কিন্তু প্রকারভেদ আছে। আমার লড়াই নিজের সঙ্গে। যাদের সবটা দিয়ে ভালবেসেছি, তাদের সঙ্গেও। সেই কাঁচা বয়স থেকে লড়তে লড়তে এ বার হাঁপিয়ে গেলাম। শরীর হার মানল। মনেরও অসুখ হল। ধীরে ধীরে বুঝলাম আমি ‘অবসাদগ্রস্ত’। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ডিপ্রেশন’। একটু একটু করে গুটিয়ে নিচ্ছিলাম নিজেকে। মনে হচ্ছিল আমার গোটা পৃথিবীটাই বদলে যাচ্ছে। সেই পৃথিবীতে কোনও রং নেই। যা আছে, তা ধূসর।

রং দেখতে চাইছিলাম— শান্তিনিকেতনের লাল মাটি আর পলাশের রং। সাত-পাঁচ না ভেবে ব্যাগপত্র গুছিয়ে ব্যারাকপুর থেকে উঠে পড়েছিলাম রামপুরহাট প্যাসেঞ্জারে। একা।

সময় গড়াল। ট্রেন ছুটল গতি বাড়িয়ে। মফস্‌সলের মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বহুতলগুলো যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে থাকল। চোখের সামনে শরীর মেলল খোলা মাঠ। যত দূর চোখ যায়, শুধু সবুজ। এক ধরনের ভেজা গন্ধ ভেসে আসে। যে গন্ধ শহুরে পরিবেশে বেড়ে ওঠা নাকের কাছে খানিক অপরিচিতই বটে। অবাক হয়ে দেখতে থাকি। চেনা পরিসরের অনেকটা বাইরে চলে আসতে পেরেছি ভেবে শরীরে যেন শিউলি ফুটতে থাকে!

বোলপুর নামতে নামতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল। গুগল ঘেঁটে ঠিক সোনাঝুরির ভিতরের একটা রিসর্ট বুক করেছিলাম। ব্যাগপত্র কোনও রকমে ঘরে রেখেই এক ছুটে শনিবারের হাটে। তত ক্ষণে একটা নরম অন্ধকারের চাদর ঢেকে ফেলেছে চারদিক। খানিক এগোতেই মাদলের আওয়াজ। গোল করে তার তালে তালে নাচছেন আদিবাসী মহিলারা। শহর থেকে আসা ‘দিদিমণি’রাও সঙ্গ দিচ্ছেন। পর্যটকদের বহুমূল্য সব ফোনে লেন্সবন্দি হচ্ছে মুহূর্তরা। এ ভাবেই আগন্তুক আসে আর যায়। স্মৃতি তৈরি হয়। সুখের স্মৃতি। কিন্তু রোজ যে মহিলারা ওখানে নিয়ম করে নাচেন, তাঁদের সুখের খবর কে রাখে? ওঁদের কি মন খারাপ হয় না? কখনও চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চায় না? চায় হয়তো। রোজগারের দায়ে সে সব কিছুকে বুকের ভিতরে কবর দিয়ে এসেই বোধহয় ওঁরা নাচেন। হাসেন। আবার বাঁচেনও।

আমরাও কি তাই করি না? ওদের থেকে আমাদের যাপন খুব আলাদা?

ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েই প্রশ্নগুলো বুকে খোঁচা দিচ্ছিল। মনে পড়েছিল গত সেপ্টেম্বরের একটা দিনের কথা। আর পাঁচটা দিনের মতোই সে দিনও অফিস এসেছিলাম। কাজ করেছিলাম। এক অল্পবয়সি বলিউড তারকার প্রয়াণের খবর দ্রুত লিখে প্রশংসাও পেয়েছিলাম। নিউজরুমে তখন সেই মৃত্যু নিয়ে হইচই। আমার দমবন্ধ হয়ে এসেছিল। ওয়াশরুমে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম। অসহায়ের মতো সেখানকার স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতে বসে নিজের মাথায় হাত বুলিয়েছিলাম। নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম। আসলে মৃত্যু মানে তো হারিয়ে যাওয়া। যাকে ভালবাসি, তাকে আর ছুঁয়ে দেখার সুযোগ না থাকা। কষ্ট হলে বুকে মাথা রেখে কেঁদে ওঠার আরাম না থাকা। তারা চলে যায়। তাদের দেওয়া নাম হারিয়ে যায়। ক্রমশ মুছে যেতে থাকে চেনা গন্ধ। হাজার ঝড়ঝঞ্ঝায় যাকে আঁকড়ে বাঁচা যায়, সে দূরে সরে গেলেও তা এক প্রকার মৃত্যুই তো! আমি সেই মৃত্যুই দেখেছিলাম। হারিয়ে যাওয়ার মৃত্যু।

জীবনে আগে কখনও একা থাকিনি। মা-বাবা আগলে রেখেছেন সব সময়। যাওয়ার আগে অনেককেই বলতে শুনেছিলাম, “মেয়ে মানুষ! একা যাবি? কাউকে সঙ্গে নিয়ে গেলেই তো হয়।”

কেন বলুন তো? জীবনের লড়াই যখন একাই লড়তে হবে, তবে ঘুরতে গেলে সঙ্গী কেন প্রয়োজন? মা-বাবাকে যখন একা যাওয়ার কথা প্রথম জানিয়েছিলাম, দু’জনের মুখেই চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছিল। কিন্তু আমার সিদ্ধান্তকে কোনও প্রশ্ন করা হয়নি। সহজেই একা ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি পেয়ে যাই। সব মধ্যবিত্ত পরিবারে মেয়েরা এমন ‘ছাড়’ পায় কি না জানা নেই। তবে আমি পেয়েছি। শান্তিনিকেতনের রিসর্টের ঘরে একা থাকাটাই যেন আমাকে কিছুটা বড় করে দিল। মনে হল, চাইলেই আমি সব পারি। বাঁচতে গেলে কাউকেই প্রয়োজন নেই। শুধু নিজেকে একটু ভালবাসতে হয়। বই পড়ে, সিরিজ দেখে দিব্যি সময় কাটিয়েছি। চার দেওয়ালের ঘেরাটোপেও যে মুক্তির স্বাদ আছে, এই ‘সোলো ট্রিপ’-এ এসে সেটা প্রথম বুঝলাম।

শান্তিনিকেতনের রিসর্টের ঘরে একা থাকাটাই যেন আমাকে কিছুটা বড় করে দিল। মনে হল, চাইলেই আমি সব পারি। বাঁচতে গেলে কাউকেই প্রয়োজন নেই।

শান্তিনিকেতনের রিসর্টের ঘরে একা থাকাটাই যেন আমাকে কিছুটা বড় করে দিল। মনে হল, চাইলেই আমি সব পারি। বাঁচতে গেলে কাউকেই প্রয়োজন নেই।

ওই কয়েকটা দিন নিজের মনের মতো করে সেজেছি। একা একাই ঘুরেছি কোপাই, কঙ্কালীতলা। লাল মাটির পথ ধরে হেঁটেছি। হাট থেকে নিজের জন্য ইচ্ছে মতো জিনিস কিনেছি। এই প্রথম অন্য কারও কথা ভাবতে ইচ্ছে করেনি। শুধু নিজেকে নিয়ে ভেবেছি। ভাবতে পেরেছি। একা থাকাই আমাকে এগুলো শিখিয়েপড়িয়ে নিল। বুঝলাম, ভাল থাকতে আসলে কাউকে লাগে না। শুধু নিজেকে নিয়ে বাঁচাতেও অনেক আনন্দ, শান্তি। কাউকে মনে রেখেও প্রতি পদে মনে না করে থাকা যায়।

তা হলে কি এই একা ঘুরতে যাওয়া আমার সব মুশকিল আসান করে দিল?

না। যা সমস্যা ছিল, এখনও তা আছে। হয়তো থাকবেও। আমিও বিশেষ বদলাইনি। কিন্তু নিজেকে ভরসা করতে শিখেছি। লতানে গাছের মতো এখন আর কাউকে আঁকড়ে ধরতে হয় না। কয়েক দিনের জন্য হলেও পরিবার, বন্ধুবান্ধবদের থেকে এই দূরত্ব আমায় নিজেকে চিনতে শিখিয়েছে। এই বা কম কী!

অন্য বিষয়গুলি:

travel Women's Day Mental Health Solo Trip
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy