Advertisement
E-Paper

সুধীরের ঘুগনির গন্ধে মাতোয়ারা শহর

তাঁর হাতে নাকি যাদু আছে। অনেকে আবার ঠাট্টা করে বলেন, “কী মেশান বলুন তো ঘুগনিতে? নেশার কিছু”— মুচকি হেসে কৃষ্ণনগরের সুধীর মোদক বলেন, “যাদু একটাই। ভালবাসা। রান্নাকে ভালবাসা, খেতে ভালবাসা, খাওয়াতেও।”

সুস্মিত হালদার

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৬ ১১:০২
ছবি তুলেছেন সুদীপ ভট্টাচার্য।

ছবি তুলেছেন সুদীপ ভট্টাচার্য।

তাঁর হাতে নাকি যাদু আছে। অনেকে আবার ঠাট্টা করে বলেন, “কী মেশান বলুন তো ঘুগনিতে? নেশার কিছু”— মুচকি হেসে কৃষ্ণনগরের সুধীর মোদক বলেন, “যাদু একটাই। ভালবাসা। রান্নাকে ভালবাসা, খেতে ভালবাসা, খাওয়াতেও।”

প্রায় ৫৫ বছর ধরে জনপ্রিয়তা ধরে রাখার কারণ হয়তো সত্যিই ভালবাসার দর্শন। আজও, এত বছর পরও, শুধু তাঁর নামেই বিক্রি হয়ে যায় দিনে প্রায় সাতশো থেকে আটশো প্লেট ঘুগনি। দুপুর ৩টে থেকে রাত প্রায় ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে দোকান। শ’য়ে শ’য়ে মানুষ ভিড় জমান জেলা আদালতের পাশের ফুটপাথের উপরে ‘সুধীরের ঘুগনি’র দোকানের সামনে। কৃষ্ণনগরের বধূ কৃষ্ণা সিংহরায় যেমন জানালেন, বাপের বাড়ি ব্যারাকপুর থেকে কলকাতা-সহ অনেক জায়গায় ঘুগনি খেয়েছেন তিনি। কিন্তু এর স্বাদ আলাদা। কেনাকাটা বা অন্য কারণে বাড়ির বাইরে পা রাখলেই সুধীরের দোকানে স্টপেজ আর এক প্লেট গরম-গরম ঘুগনি হয়ে যায়। এমনকী ছেলের টিফিনেও অনেক সময় সুধীরের ঘুগনি দিয়ে দেন তিনি। কৃষ্ণনগরের অবসরপ্রাপ্ত এক শিক্ষক নামটা গোপন রাখার অনুরোধ জানিয়ে বললেন, ‘‘প্রায় ৩৫ বছর পরে রাস্তায় কলেজ জীবনের এক বান্ধবীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এই সুধীরের ঘুগনির দোকানে বসে নস্টালজিয়া এসেছিল ফিরিয়া।’’

প্রতি দিন ৪০ কেজি মটর, ১০ কেজি আলু আর ৭ কেজি পেঁয়াজ দিয়ে ঘুগনি রান্না হয় সুধীরের বাড়িতে। তারপর বিশাল বিশাল দু’টি অ্যালুমিনিয়ামের গামলায় সেই ঘুগনি আসে জজ কোর্টের কাছে রাস্তার ধারে ছোট্ট কাঠের দোকানে। দূর থেকে গরম ঘুগনির গন্ধ শুঁকেই লোকজনে বলে দিতে পারে, “ওই সুধীরের ঘুগনি এসে গিয়েছে।” সমান ভাবে জনপ্রিয় থাকার রহস্য-সন্ধানে উঁকি মারা হল হেঁশেলে। মালোপাড়ার এক কাঠা জমির উপরে তিন তলা বাড়ি। বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই ডান পাশে বিশাল বিশাল দু’টো সিমেন্টের উনুন। সকাল ৯টার মধ্যে সেখানে ঘুঁটের আগুন দিয়ে কয়লার আঁচ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তার উপরে ফুটতে শুরু করে মটর। যেটা আগের দিন রাতে গামলায় ভিজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। একটু খাবার সোডা দিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে ফোটানো হয় মটরকে। তারপরে সিদ্ধ করা হয় আলু। সেই আলু কাটা হয় না, মাখা হয়। ঘুগনিটাকে ঘন-মাখামাখা করার জন্য। এরই মধ্যে প্রস্তুত হয়ে যায় মশলা। ৪০ কেজি মটরের জন্য ১ কেজি আদা, রসুন ৩০০ গ্রাম, পেঁয়াজ ৭ কেজি, কাঁচালঙ্কা আড়াই কেজি আর সর্ষের তেল ৮ কেজি। সঙ্গে আছে পরিমাণ মতো ধনে, জিরে, হলুদ। তবে তেল অল্প, ঘুগনির ঝোলে এতটুকু তেল ভাসবে না। আর শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো একেবারে সামান্য পরিমাণে। “রং ধরার জন্য যেটুকু দিতে হয় আর কি” মুচকি হেসে বলেন বৃদ্ধ সুধীর মোদক। তাঁর কথায়, “মশলাটাই আসল। আর মনোযোগ। রান্নার সময় অন্য কিছু নিয়ে ভাববেন না। মনটাকে শান্ত করে মশলা কষে যান। এখানেই যাদু বলেন তো যাদু আর নেশা বলেন তো নেশা।” কষা হয়ে গেলে ঢেলে দাও মটর, আলু। তারপর ফোটাও প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে। রান্নার শেষে ছোট এলাচ, দারচিনি আর লবঙ্গ গুঁড়ো ছড়িয়ে দেওয়া হয় ঘুগনির উপরে। এরও উপরে পরিবেশনের সময় পড়বে তেঁতুল। আর পড়বে বিট লবনের সঙ্গে ধনে, জোয়ান, গোলমরিচ আর জিরে ভেজে গুঁড়ো করা মশলা। যার খেঁাচায় বাড়বে ঘুগনির আস্বাদ

ছবি তুলেছেন সুদীপ ভট্টাচার্য।

এক দিনে তো সেই স্বাদ করায়ত্ত হয়নি। কবে কিশোর বয়েসে শুরু হয়েছিল নিজের পায়ে দাঁড়়ানোর লড়াই। বাবা ভোলানাথ মোদক ছিলেন সরকারি দফতরের পিওন। পাঁচ ভাই। সংসারে অভাব-অনটন। সুধীরবাবু থাকতেন গোয়াড়িবাজারে পিসির বাড়ি। সেখানেই দিলেন সব্জির দোকান। কিন্তু ব্যবসা কিছুতে জমে না। বুদ্ধি দিলেন ‘সাধুবাবা’ মুরারী দত্ত। বললেন, ‘ঘুগনির ব্যবসা করো।’

প্রথম দিন নিজেই রান্না করলেন। সুধীরবাবুর কথায়, ‘‘পুরোপুরি একা না। বাবা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। আমার বাবাও খুব ভাল রান্না করতে পারতেন। বলতে পারেন তাঁর কাছ থেকেই শেখা।” মাথায় গামলা ভরা ঘুগনি নিয়ে সারা কৃষ্ণনগর ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন সেই সময়। শাল পাতায় দাম ছিল ৫ পয়সা, ১০ পয়সা করে। এখন দাম বাড়তে বাড়তে ৫ টাকা আর ১০ টাকা প্লেট। তা-ও দাম বাড়ালে ভাল হয়। খরচ বাড়ছে আগুনে বাজারে।

বছর কয়েক আগে ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার পর থেকে দোকানে নিয়মিত আসতে পারেন না সুধীরবাবু। বয়স হয়েছে। তাই আগের মতো রান্না করার ধকল নিতেও পারেন না। ছেলেরা রান্না করেন। আর উনুনের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে তিনি নির্দেশ দিয়ে যান। মাঝে মধ্যে দোকানে আসেন ক্রেতাদের মন বুঝতে। তাঁর কথায়, “যারা খাচ্ছে, তাদের মুখের দিকে তাকালেই আমি বুঝে নিতে পারি রান্নাটা জুতসই হয়েছে কি না। তৃপ্তির আলাদা স্বাদ আছে।”

আরও পড়ুন: কলকাতায় কম খরচে মনের মতো শপিং করার সেরা ৮ ঠিকানা

Ghugni Sudgirer Ghugni
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy