Advertisement
E-Paper

অন্য কারও কথায় বিশ্বাস বদলে যাচ্ছে? মানসিক রোগের শিকার হচ্ছেন না তো?

অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়ে পড়েন সহজেই? এতটাই মানসিক দ্বন্দ্বে পড়ে যান যে, আদৌ যে ঘটনা ঘটেছে তাকেও মনে মনে অস্বীকার করতে শুরু করেন অন্যের চাপিয়ে দেওয়া বিশ্বাসে ভর করে? তা হলে সাবধান!

মনীষা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৮ ১৭:৫০
মানসিক জোর খাটিয়ে কাছের কেউ বদলে দিচ্ছে আপনার ভাবনা? তা হলে আজই সতর্ক হোন। ছবি: শাটারস্টক।

মানসিক জোর খাটিয়ে কাছের কেউ বদলে দিচ্ছে আপনার ভাবনা? তা হলে আজই সতর্ক হোন। ছবি: শাটারস্টক।

এক মহিলা চেম্বারে এসেই ভেঙে পড়লেন মনোবিদের সামনে। ছোটবেলায় তাঁর উপর ঘটে যাওয়া এক নির্মম ঘটনাকে পারিবারিক স্বার্থে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন তাঁর মা। মেয়েটির বয়স তখন পাঁচ কি ছয়। মায়ের কথা ও দৃঢ়তার সামনে নিজের বিশ্বাস, নিজের ভাবনা বেশি দিন আঁকড়ে থাকতে পারেনি মেয়েটি। ধীরে ধীরে বাস্তব ঘটনাকে অস্বীকার করে মায়ের তৈরি করে দেওয়া বিশ্বাসকেই ‘সত্য’ ভাবতে শুরু করল মেয়েটা। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক পরিবর্তন এলে তিনি বুঝে ফেলেন মায়ের ভুল বোঝানোর শিকার তিনি। মানসিক অস্থিরতা থেকে রক্ষা পেতে ছুটে যান চিকিৎসকের কাছে।

কিংবা সেই ভদ্রমহিলার কথাই ধরা যাক। যৌন মিলনের সময় স্বামীর মুখে অন্য কারও নাম শুনে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন প্রথমে। বার বার স্বামীকে জি়জ্ঞেস করেও সঠিক উত্তর তো মেলেইনি, উল্টে, চরম উত্তেজনার সময় ওই মহিলাই ভুল শুনেছেন বলে দেগে দেওয়া হয়। সেই বিশ্বাসেই অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলেন স্ত্রী। পরে জানতে পারেন, দিনের পর দিন আসলে তাঁকে ঠকিয়ে অন্য এক জনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছেন স্বামী।

উপরের দুই ঘটনাই আধুনিক জীবনের এক কঠিন সমস্যার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে আমাদের। ‘গ্যাসলাইটিং’। মাইন্ড গেম-এর একটি ধরনকে নতুন এই শব্দবন্ধ দিয়েই বিশ্বের কাছে তুলে ধরছেন পাশ্চাত্যের চিকিৎসকেরা।

আরও পড়ুন: হার্ট অ্যাটাক হতে পারে! আগাম বুঝবেন কী ভাবে?

আপনিও কি অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়ে পড়েন সহজেই। এতটাই মানসিক দ্বন্দ্বে পড়ে যান যে, আদৌ যে ঘটনা ঘটেছে তাকেও মনে মনে অস্বীকার করতে শুরু করেন অন্যের চাপিয়ে দেওয়া বিশ্বাসে ভর করে? ক্রমশই হারাচ্ছেন আত্মবিশ্বাস? তা হলে সাবধান! আপনিও আদতে এই মানসিক নিপীড়নের শিকার নন তো?

সম্প্রতি ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে এই মানসিক অসুখ নিয়ে আলোচনার পরেই এ দেশেও ‘গ্যাসলাইটিং’ শব্দটি নিয়ে বিশেষ আগ্রহী হয়েছেন চিকিৎসকেরা। মনোবিদ অমিতাভ মুখোপাধ্যায়ের মতে, সাইকোলজিক্যাল নাটকে এই শব্দের প্রয়োগ অনেক আগে থেকে থাকলেও চিকিৎসা শাস্ত্রে এই শব্দের চল খুব আগে হয়নি। যদিও এর প্রকোপ বহু পুরনো। আদি কাল থেকেই এই অসুখের শিকার নানা মানুষ।

একই মত মনস্তত্ত্ববিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। ইচ্ছাকৃত নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে নিজেরভাবনা অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন অনেকেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার শিকার দু’জন মানুষের মধ্যে তুলনায় কম প্রভাবশালী মানুষটি। শুধু পারিবারিক ক্ষেত্রে নয়, ‘গ্যাসলাইটিং’ ঘটতে পারে বন্ধুমহল, অফিস সর্বত্রই।

আদতে কেন এমন নামকরণ

অমিতাভবাবুর মতে, ভিক্টোরিয়ান আমলে গ্যাসপাইপ দিয়ে আলো জ্বালানো হত। আলোর মাত্রা কমানো-বাড়ানোর জন্য সুইচের ব্যবস্থা ছিল। এই ব্যবস্থা চালুর পর স্ত্রী’কে ভয় দেখাতে চাইলে স্বামী মাঝে মাঝেই সেই আলো কমানোর সুইচটি চালু করে দিতেন। এতে অনেক সময় আলো কমে গিয়ে কাঁপত। স্ত্রী কিছু বুঝে ওঠার আগেই আলো বাড়ানোর সুইচ জ্বালিয়ে দেওয়া হত। ফলে স্ত্রী বুঝেই উঠতে পারতেন না, আদৌ আলো কমেছিল না কি তিনি ভুল ভাবছেন! বারংবার স্ত্রীর বিশ্বাসে ধস নামিয়ে বাস্তবকে অস্বীকার করানোতেই ছিল স্বামীর লক্ষ্য।

এই ‘সাইকোলজিক্যাল ম্যানিপুলেশন’–কে ১৯৩৮-এ নাটকেও ফুটিয়ে তুলেছিলেন নাট্যকার প্যাট্রিক হ্যামিল্টন। অমিতাভবাবুর মতে, প্যাট্রিকের আগে ভিক্টোরিয়ান আমলের মানুষের এই স্বভাব নিয়ে খতিয়ে কেউ ভাবেনি, নাটকের পর এই ‘সাইকোলজিক্যাল ম্যানিপুলেশন’ অনেকটাই সামনে আসে। তখন এই ‘গ্যাসলাইটিং’ শব্দটির সঙ্গেও পরিচিত হতে থাকে মানুষ। মানসিক পীড়নের অসুখকে বর্ণনা করতে গিয়ে মনস্তত্ত্ববিদ ও মনোবিদরা ‘গ্যাসলাইটিং’ শব্দের প্রয়োগ ইদানীং বেশি করছেন।

নাট্যকার বিভাস চক্রবর্তী এই ‘গ্যাসলাইট’ নাটকটি বাংলায় মঞ্চস্থ করার কথাও ভাবেন। কিন্তু পিছিয়ে আসতে হয়। বিভাসবাবুর কথায়: ‘‘মঞ্চে কী ভাবে ওই ভিক্টোরিয়ান আমলের গ্যাসবাতির দপদপানি দেখানো যায়, এটাই আমরা ঠিক ভাবে বুঝে উঠতে পারিনি। তাই আমার এক বন্ধু অনুবাদ করে ফেলার পরেও ওই নাটক মঞ্চস্থ করতে পারিনি আমরা। মানসিক নির্যাতনের এক অনবদ্য নাটক এটি।’’

আরও পড়ুন: ব্রণ নিয়ে চিন্তিত? ওষুধ ছাড়াই এ ভাবে দূর করুন এই সমস্যা

চিকিৎসকের সাহায্য দরকার। তার সঙ্গে নিজের উপর বিশ্বাসও বাড়ান। ছবি: শাটারস্টক।

এই ধরনের মাইন্ড গেমের যাঁরা শিকার, তাঁরা কি ‘অসুস্থ’?

অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, এটি এক ধরনের মানসিক নিগ্রহ। যাঁরা দীর্ঘ দিন এর শিকার তাঁরা ধীরে ধীরে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভিক্টোরিয়ান আমলে নিতান্ত খেলার ছলে যা হত, আধুনিক জীবনে তাকে অস্ত্র করে নিয়মিত স্বার্থসিদ্ধি ঘটাচ্ছেন এক শ্রেণির মানুষ। তুলনামূলক দুর্বল মনের মানুষ ও কম ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষরাই এর শিকার হন। যাঁরা এর দ্বারা প্রভাবিত হন, তিনি ধীরে ধীরে একপ্রকার মানসিক অসুস্থতার শিকার হয়ে পড়েন। নিজের আত্মবিশ্বাস চলে যায় তলানিতে। একা একা ভাবনাচিন্তা করতেও ভয় পান।

কী ভাবে এই অসুখ সারে?

মনোবিদদের মতে, গ্যাসলাইটিং বা মাইন্ড গেম সারানোর একটাই উপায়, ব্যক্তিত্বে শান দেওয়া। এ ছাড়া বার বার মনোবিদদের সঙ্গে আলোচনা, হালকা কিছু ওষুধ নিলেই ধীরে ধীরে কমে এই রোগ।

এ ছাড়া প্রতি দিন মেডিটেশন ও হালকা কিছু ব্যায়ামও আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে সাহায্য করে। অন্যের চাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে এই আত্মবিশ্বাসই একমাত্র হাতিয়ার।

Psychology Human Psychology Abuse Mental Health Fitness Tips Health Tips Health
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy