Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

নবান্নের তোড়জোড় সার, কিটই পৌঁছায়নি উত্তরবঙ্গে

এনসেফ্যালাইটিস নিয়ে নবান্ন তেড়ে-ফুঁড়ে ওঠার সাত দিন পরেও উত্তরবঙ্গে রোগ নির্ণয় ও প্রতিরোধ ব্যবস্থায় বিশেষ গতি এল না। গাফিলতি ও তথ্য গোপনের অভিযোগে খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যে উত্তরবঙ্গের তিন স্বাস্থ্য-কর্তাকে সাসপেন্ড করেছেন। তাঁদের জায়গায় নতুন লোক দায়িত্বও নিয়েছেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৪ ০২:৩৫
Share: Save:

এনসেফ্যালাইটিস নিয়ে নবান্ন তেড়ে-ফুঁড়ে ওঠার সাত দিন পরেও উত্তরবঙ্গে রোগ নির্ণয় ও প্রতিরোধ ব্যবস্থায় বিশেষ গতি এল না।

গাফিলতি ও তথ্য গোপনের অভিযোগে খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যে উত্তরবঙ্গের তিন স্বাস্থ্য-কর্তাকে সাসপেন্ড করেছেন। তাঁদের জায়গায় নতুন লোক দায়িত্বও নিয়েছেন। খোদ স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা ওখানে ঘাঁটি গেড়ে বসে রয়েছেন। অথচ উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ছাড়া সেখানকার অন্য কোনও মেডিক্যাল কলেজে এনসেফ্যালাইটিস নির্ণয়ের কিট-ই পৌঁছায়নি! ফলে অনেক রোগীর মৃত্যুর পরেও চিহ্নিত করা যায়নি যে, তাঁরা কোন রোগের কবলে পড়েছিলেন। রোগটা কোথা থেকেই বা এল।

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

পরিণামে উত্তরবঙ্গের রোগ-চিত্র আবছাই রয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন জীবাণু বিজ্ঞানীরা। তাঁদের মতে, বিপর্যয় রোখার পথে এটাই মূল অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে। অবস্থা ওখানে ঠিক কী রকম?

দার্জিলিং জেলা স্বাস্থ্য দফতরের খবর: যথেষ্ট কিট না-থাকায় উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে এনসেফ্যালাইটিস-উপসর্গ নিয়ে ভর্তি থাকা সমস্ত রোগীর রক্ত ও সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড (সিএসএফ) পরীক্ষা করা যায়নি। গত জানুয়ারি থেকে সেখানে এমন ১৩১ জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এঁদের ২৭ জনের রক্তে জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের ভাইরাস পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু বাকিদের মৃত্যুর কারণ কী, স্বাস্থ্য দফতর সে ব্যাপারে অন্ধকারে। উপরন্তু উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল ছাড়া সেখানকার আর কোনও জেলা হাসপাতালে এনসেফ্যালাইটিসের জীবাণু পরীক্ষার কিট না-পৌঁছানোয় সঙ্কট দিন দিন ঘোরালো হচ্ছে। ওই সব হাসপাতালে জ্বরের রোগী এলে তাঁর রক্তের নমুনা পাঠাতে হচ্ছে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালেই। এ দিকে সেখানে রক্ত পরীক্ষার জন্য অপেক্ষমানদের তালিকা এতই লম্বা যে, রিপোর্ট আসার আগে হয় রোগী সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন কিংবা মারা যাচ্ছেন। রোগ শনাক্ত হওয়ার আগেই!

যেমন, রায়গঞ্জ জেলা হাসপাতাল থেকে জুলাইয়ে ৩৩ জনের রক্তের নমুনা উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে পাঠানো হয়। এখনও হাসপাতালে পৌঁছয়নি অর্ধেক রিপোর্ট। রোগ নির্ণয় না-হওয়ায় অনেককে অন্যত্র রেফার করা হয়েছে। কেউ কেউ কলকাতা বা অন্য জায়গায় চিকিৎসা করাতে গিয়েছেন।

এতেও স্বাস্থ্য প্রশাসনের তরফে বিশেষ হেলদোল দেখা যাচ্ছে না বলে আক্ষেপ শোনা গিয়েছে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা হাসপাতালের একাধিক আধিকারিকের মুখে। যাঁদের প্রশ্ন: স্বাস্থ্যভবন কথা দিলেও সব জেলা হাসপাতালে এনসেফ্যালাইটিসের রক্ত পরীক্ষার কিট পৌঁছল না কেন? মেডিক্যাল কলেজেই বা কেন পর্যাপ্ত কিট মজুত রাখা হচ্ছে না? হাসপাতালে মাইক্রোবায়োলজি-বিশেষজ্ঞের সংখ্যা কেন বাড়ানো হল না, সে প্রশ্নও উঠছে। সরকারের কী বক্তব্য?

বর্তমানে উত্তরবঙ্গ সফরকারী স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবাব, “সব কিছুই প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে।” ঘটনা হল, ‘প্রক্রিয়া’ সাঙ্গ হয়ে কিট ও মাইক্রোবায়োলজিস্ট কবে এসে পৌঁছবে, আর তত দিনে উত্তরবঙ্গের রোগ-পরিস্থিতিই বা কী চেহারা নেবে, তা ভেবে স্বাস্থ্য-কর্তাদের একাংশ যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। ওঁদের উদ্বেগ যে অমূলক নয়, আক্রান্ত বিভিন্ন এলাকার ছবিতেও তার প্রতিফলন। কী রকম?

ধূপগুড়ি ব্লকের কথা ধরা যাক। শুধু জুলাইয়েই সেখানে খিঁচুনি-জ্বরে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এঁদের এক জন হলেন গদেয়ারকুঠি গ্রাম পঞ্চায়েতের রাজকান্ত রায়। ১০ জুলাই ইস্তক ধূপগুড়ির হাসপাতাল ও জলপাইগুড়ি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর পরে, ১৫ জুলাই বৃদ্ধ মারা যান। তাঁর ছেলে দিলীপ জানাচ্ছেন, কোথাও তাঁর বাবার রক্ত পরীক্ষা হয়নি। “জানি না, কেন হয়নি। জিজ্ঞাসা করলে ডাক্তারবাবুরা জবাব দেননি।” অভিযোগ তাঁর। ধূপগুড়ি ব্লকের শালবাড়ি দু’নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের চামটিমারি গ্রামের বৃদ্ধ কৃষ্ণকান্ত অধিকারীর মৃত্যু হয়েছে ১৬ জুলাই। জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন তাঁরও রক্ত পরীক্ষা হয়নি। ধূপগুড়ি শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নরেন্দ্রনাথ অধিকারী ৯ জুলাই উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে মারা গিয়েছেন। ওই বৃদ্ধের রক্ত পরীক্ষা হলেও বাড়ির লোকজনকে কোনও রিপোর্ট দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন তাঁর ছেলে।

ফলে জানা যায়নি, ওঁরা কী রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ঘেরাটোপের আড়ালে থেকে এ ভাবে দাপিয়ে বেড়ানো জীবাণু নিয়ে বিশেষজ্ঞেরা স্বভাবতই উদ্বেগে। চিকিৎসক সংগঠন ‘মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টার’-এর এক প্রতিনিধিদল জলপাইগুড়ি-দার্জিলিং-কোচবিহার ঘুরে এসে বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়েছে। তাতে ওখানকার চিকিৎসা-পরিকাঠামোর বেহাল দশার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। উত্তরবঙ্গের রোগ-পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন কংগ্রেস নেতা-বিধায়ক মানস ভুঁইয়াও। বুধবার উত্তরবঙ্গের দলীয় পাঁচ বিধায়ক ও দলের বিভিন্ন পদাধিকারীকে নিয়ে তিনি তিন জেলার অবস্থা দেখতে গিয়েছিলেন। এ দিন কলকাতায় ফিরে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে তিনি দাবি করেছেন, সঙ্কট মোকাবিলায় অবিলম্বে সবর্দল বৈঠক ও বিধানসভার অধিবেশন ডাকা হোক। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী ও কংগ্রেস পরিষদীয় নেতা মহম্মদ সোহরাবকেও তিনি রিপোর্ট দিয়েছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

north bengal encephalitis kits nabanna
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE