বন্ধুত্ব কি শুধুই মানুষে মানুষে হয়? ইন্টারনেট তা-ই বলছে। অভিধানও। কিন্তু তা যদি হবে, তবে ‘জাঙ্গল বুক’-এ মনুষ্য সন্তান ‘মোগলি’র সঙ্গে তথাকথিত হিংস্র ব্ল্যাক প্যান্থার ‘বাগীরা’র বন্ধুত্ব হয় কী করে? সাহিত্য, সিনেমা তো বাস্তব জীবন থেকেই প্রভাবিত বলে মনে করা হয়। আর সেই সাহিত্য এবং সিনেমাতেই এমন অদ্ভুত বন্ধুত্বের উদাহরণ ভূরিভূরি। ‘মানিক বাবুর মেঘ’ সিনেমায় এক মাঝবয়সি পুরুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় মেঘের, টিনটিনের অ্যাডভেঞ্চারে সঙ্গী হয় তার প্রাণের বন্ধু কুট্টুস, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গল্পে ভূত আর মানুষেরও বন্ধুত্ব হয়েছে। আবার ছোটদের গল্পকার বেথ ফেরির লেখা গল্প ‘দ্য স্কেয়ারক্রো’-এ কাকতাড়ুয়া বন্ধুত্ব করে বসে কাকের সঙ্গেই!
বাস্তবে এমন হয় কি হয় না, সে প্রশ্ন পরের। কল্পনায় তো বাধা নেই। সাহিত্যিক, সিনেমাকারেরা যেমন ভেবেছেন, তেমনই কিছু কাল্পনিক বন্ধুতার খোঁজ করতে আসা খাবারের দুনিয়ায়। কয়েক জোড়া ‘বন্ধু-খাবার‘ আর তাদের কাল্পনিক বন্ধুত্বের গল্প। তবে এক জন বন্ধুর নাম বলা হল। তার প্রিয় বন্ধু কে? সেটা পড়ে জানতে হবে।
চা
চায়ের সঙ্গে সঙ্গ দেওয়ার জবরদস্ত সঙ্গী নেহাত কম নেই। শিঙাড়া, পাকোড়া, চানাচুর থাকলে চায়ের আড্ডা জমে যায়। কিন্তু বন্ধু ‘চা’য়ের জন্য কথায় কথায় গলে পড়ার অভ্যাস এক জনেরই। সে বিস্কুট। কাপে, ভাঁড়ে বা কাচের গ্লাসে, ধোঁয়া ওঠা চায়ে বিস্কুট ডোবালে সময়ের হিসাব গোলাবেই। আর বিস্কুটও ওমনি গলে গিয়ে টুপ করে খসে পড়বে চায়ের ভিতরে। ঠিক তেমনি প্রাণের বন্ধুর সঙ্গে আড্ডাতেও ঘড়ির কাঁটায় খেয়াল থাকে না। কোথাও যেতে দেরি হল কি না, কাজের কোনও ক্ষতি হল কি না— প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে এই সব ফলের চিন্তা কেই বা কবে করেছে! বন্ধুর মুখোমুখি বসে একটি শব্দও না করে একসঙ্গে তেপান্তরে হারিয়ে যাওয়াই নিয়ম। যে মাঠে বন্ধুর টিমে থেকে তার পাশে খেলতে পারাই বড় কথা। আত্মত্যাগ সেখানে কিচ্ছুটি না।
পাউরুটি
এমনিতে খুবই ‘মিশুকে’। জ্যাম, জেলি, ঘুগনি, আলুর দম, ডিম সবের সঙ্গেই বন্ধুত্বে ডুগি-তবলার বোল তোলে। ছন্দ মেলায়। কারও কারও সঙ্গে সম্পর্ক একটু ‘মাখো মাখো’ও হয় বইকি (ডিম-পাউরুটির কথাই এক বার ভাবুন, এক জনকে আরেক জনের থেকে আলাদা করাই যায় না)। কিন্তু ‘প্রাণসখা’ তার একজনাই— মাখন। এমনই মানিকজোড় তারা, যে জনপ্রিয় আঠার বিজ্ঞাপনও হার মানে। জুড়ে না থেকেও জুড়ে থাকা কাকে বলে তা এদের দেখলে বোঝা যায়। একজনের নাম করলেই মনে আসে এক জনের কথা। ধরুন, গিন্নি বললেন, পাউরুটি ফুরিয়েছে। তক্ষুণি মনে হবে, ফ্রিজে মাখন আছে তো! সে কোন আদিকাল থেকে প্রাতরাশের সঙ্গী দু’জন। মাঝে যে নতুন পরিচয়, নতুন সম্পর্ক হয়নি, তা তো নয়। স্যান্ডউইচ, বার্গার, ফ্রেঞ্চ টোস্ট, ব্রেড-ওমলেট— আরও কত কী জন্ম নিয়েছে! তবু যুগ যুগ ধরে পাউরুটিকে আলাদা করা যায়নি মাখনের থেকে। মনে হতেই পারে প্রেম। কিন্তু প্রেমও ফিকে হয়। বন্ধুত্বে তেমন হওয়ার জো নেই। নিখাদ বন্ধুত্ব যেখানে, সেখানে মাঝে যা-ই ঘটুক, ঠিক যেখানে পথ চলা থেমেছিল, আবার একই ভাবে আবার চলা শুরু হয় সেখান থেকে। পাউরুটি আর মাখনের বন্ধুত্বও ঠিক তেমনি।
লুচি
ইনি একটু রাশভারী। একটু নাকউঁচুও বটে। হাওয়া দিলেই ফোলেন না। ফুললেও সামলেসুমলে রাখতে হয়। একটু যত্নে। একটু বাড়তি নজরে। চট করে চুপসে যাওয়ার রোগ আছে যে! তবে সময়ে সময়ে লালচে আর কড়াও হতে পারেন! এমন ক্ষণে ক্ষণে মুড সুইং হয় যাঁর, তাঁর বন্ধু হওয়া মুশকিল। সবাই হতে পারে না। কিন্তু আভিজাত্য গুণে টইটম্বুর লুচির সঙ্গীর অভাব নেই। ছোলার ডাল, বেগুন ভাজা, ফুলকপি, ধোঁকা, কষা মাংস, মাখোমাখো ঝাল ঝাল আলুচচ্চড়ি কিংবা কালো জিরে ফোড়ন দেওয়া ঝোল ঝোল ‘সাদা আলুর তরকারি’। সবাই লুচির সঙ্গ চায়। কিন্তু লুচি বললে যে শব্দটি ঠোঁটের ডগায় এসে উচ্চারণ হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকে, তা হল আলুর দম। লুচি কড়া হোক বা চুপসনো বা ফুলকো হোক বা মিয়োনো, কষা আলুর দমের আলুতে জড়িয়ে মুখে তুললেই পলে পলে বোঝা যায়, বন্ধুত্বের রসায়ন কাকে বলে। যেখানে কেউ কারও স্বাদকে পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে না। কেউ বেশি নয়, কেউ কমও নয়। তাই দুইয়ে মিলে তৈরি হয় ছন্দোবদ্ধ স্বাদের এক অদ্ভুত সঙ্গীত। খাবার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাঙালির পছন্দ। তাই লুচির সঙ্গী নিয়েও এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে। কেউ লুচি খেয়েছেন সুজির মোহনভোগ দিয়ে। কেউ খেয়েছেন লুচি-পায়েস। লুচির সঙ্গে বোঁদে খাওয়ারও আলাদা ভক্তকূল আছে। কিন্তু ইন্টারনেটে এই এআই যুগেও লুচি লিখে এক খানি স্পেস দিলে গুগল জানতে চায় ‘আপনি কি লুচি-আলুর দম খুঁজতে চাইছেন?’ মাংস নয়, পায়েস নয়, ছোলার ডাল আর বোঁটাসুদ্ধ বেগুন ভাজাও নয়। স্রেফ লুচি-আলুর দম। গুগলও জানে, কে কার সবচেয়ে কাছের বন্ধু।
পোলাও
ঝাল, মিষ্টি, নোনতা, সুগন্ধি, ঘি জবজবে— পোলাও যেখানে যেমন, সেখানে তেমন। তার নিরামিষও বন্ধু। আমিষও বন্ধু। সবেতেই সুন্দর মিলেমিশে যাওয়ার মতো দিলখোলা। আলুর দম, পটলের দোলমা, ছানার কোফতা হোক বা মাছের কালিয়া, ডিমের কোর্মা, চিংড়ির মালাইকারি, চিকেন কারি— পোলাওয়ের সঙ্গে সবার দোস্তি। কিন্তু মাটন কষা! ইনি পোলাওয়ের পাশে আবির্ভূত হলে বোঝা যায়, খাবারের থালার ‘জয়-বীরু’ কারা। তখন বাড়তি শব্দের জায়গা থাকে না। শুধু অলক্ষ্যে গুনগুনিয়ে বেজে ওঠে মাউথঅর্গানের সুর, ‘... তোরেঙ্গে দম মগর, তেরা সাথ না ছোড়েঙ্গে।’
চাটনি
চাটনির প্রিয় বন্ধু কে? এ উত্তর খুঁজতে দু’বার ভাবতে হয় না। আজন্ম কাল ধরে এই দুই ‘বন্ধু’ একসঙ্গে। চাটনি এলেই জানা কথা, পাঁপড়ও আসছে। অনেকটা হোমস-ওয়াটসন, অজিত-ব্যোমকেশের মতো। এক জন থাকলে আর এক জনের থাকা নিশ্চিত। এ ব্যাপারে খাদ্যারাসিকেরাও এতটা নিশ্চিত থাকেন যে, অনুষ্ঠান বাড়িতে পাতে চাটনি পড়ার পরেই খেতে শুরু করেন না। তাঁরা অপেক্ষা করতে থাকেন পাঁপড়ের। মেনু কার্ড থাক বা না থাক, আসার আগাম খবর থাকুক বা না থাকুক, তাঁরা জানেন, পাঁপড়ের না এসে উপায় নেই। কারণ, এই বন্ধুত্ব চিরকালীন।