লড়াই: প্রত্যয় জীবন সহায়তা কেন্দ্রের রোজনামচার মধ্যেই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন পম্পা গুহ। নিজস্ব চিত্র
মানসিক হাসপাতালের জীবনকে পিছনে ফেলে সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন তিনি। ব্যারাকপুরে মা, বাবা, নাবালিকা কন্যা রয়েছেন স্বামী-বিচ্ছিন্না মহিলার। তাঁরা অবশ্য এখনও বাড়িতে ঠাঁই দিতে গররাজি। রাজ্য সমাজকল্যাণ দফতরের জীবন সহায়তা কেন্দ্র প্রত্যয়ের ঠিকানা থেকে তবু প্রাণপণে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর লড়াই লড়ছেন ৪১ বছরের পম্পা গুহ। কিন্তু এখনও পদে পদে তাঁকে নানা ধাক্কা খেতেই হচ্ছে।
পম্পার ঘটনায় এ দেশে মানসিক স্বাস্থ্য আইনের প্রয়োগ নিয়েই প্রশ্ন উঠছে বলে মনে করছেন মানসিক রোগীদের অধিকার রক্ষা কর্মী রত্নাবলী রায়। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘মনোরোগী তকমা এক বার সেঁটে গেলেই তাঁকে সব কাজে অযোগ্য বলে ধরে নেওয়া হয়। এই ধারণা একেবারেই সেকেলে। তথাকথিত সুস্থ অনেককেই সর্দিকাশির ধাতের মতো মানসিক সঙ্কটের সুরক্ষাতেও নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। তাতে স্বাভাবিক রুজি-রোজগারের জীবনে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবু ব্যক্তি বিশেষকে পদে পদে সমাজের ভুল ধারণার মাসুল গুনতে হচ্ছে।’’
পম্পা নিজেই বললেন বছর দেড়েক আগে তাঁর চরম মানসিক অবসাদের কথা। তাঁর বিয়ে হয়েছিল মুম্বইয়ে। কয়েক বছর হল স্বামীর থেকে আলাদা রয়েছেন তিনি। ব্যারাকপুরে মেয়েকে নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে থাকতে থাকতেই অবসাদের শিকার হয়েছিলেন পম্পা। ‘‘আমার তখন খাওয়ার ও বেঁচে থাকার ইচ্ছেই চলে গিয়েছিল। হাঁটাচলা, ওঠাবসা কিছুই ভাল লাগত না। মনের জোর আর ওষুধে সেই অবস্থা আমি কাটিয়ে উঠেছি।’’— দেড় বছর পাভলভ মানসিক হাসপাতালে কাটানোর পরে গড়গড়িয়ে বললেন পম্পা। চিকিৎসকদের মতেও পম্পা এখন পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু কাজ পাওয়ার পথে বিস্তর কাঁটা। প্রত্যয়ে থেকে জ্বর দেখা, প্রেশার মাপা বা রোগী সেবার খুঁটিনাটি রপ্ত করেছেন তিনি। পম্পা জানাচ্ছেন, গত সপ্তাহে হাতিবাগানে একটি আয়া সেন্টারে গিয়ে তিনি নিজেই বলেছিলেন তাঁর মানসিক হাসপাতালে থাকার ইতিবৃত্ত। এবং তার পরেই পাল্টে যায় নিয়োগকারীদের হাবভাব।
পম্পা বলেন, ‘‘সরাসরি বলা হয়নি যে, আমাকে মানসিক সমস্যার অতীতের জন্য বাতিল করা হল। কিন্তু খুবই ভদ্র ভাবে ওঁরা বললেন, ২৪ ঘণ্টা টানা ডিউটি করতে হবে। কলকাতায় কাজ জুটবে না।’’ হাই কোর্টের আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘২৪ ঘণ্টা ডিউটিতে কোনও কাজের প্রস্তাব আইনত কেউ দিতেই পারেন না। কারও মানসিক রোগের ইতিহাস থাকলে এখনও তাঁকে যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া অপরাধীর মতো দেখা হয়। এটা দুর্ভাগ্যের। মানসিক স্বাস্থ্য আইনে স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে, মনোরোগের চিকিৎসার পরে মূলস্রোতে ফেরার অধিকারের কথা।’’ সিআইআই-এর ইন্ডিয়ান উইমেন নেটওয়ার্কের অন্যতম ভাইস চেয়ারপার্সন প্রিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আজকাল কর্পোরেট নীতিতে ডাইভার্সিটি এবং ইনক্লুশন-এর উপরে জোর দেওয়া হয়। তাতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কারও প্রতি বৈষম্যও থাকার কথা নয়।’’ হাই কোর্টের আইনজীবী শুদ্ধসত্ত্ব বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলছেন, ‘‘২০১৭-র মানসিক স্বাস্থ্য আইন অনুযায়ী, অতীতে মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য কাউকে অসুস্থ বা অযোগ্য সাব্যস্ত করা যায় না। ১৯৯৫-এর প্রতিবন্ধী আইনেও স্পষ্ট, চাকরিতে থাকাকালীন মানসিক সমস্যা হলে কাউকে বরখাস্ত বা কোণঠাসাও করা যায় না।’’ পম্পার কথায়, ‘‘শুকনো সহানুভূতি না-দেখিয়ে আমি পারব, দয়া করে এটুকু আস্থা রাখুন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy