আগমনীর আলোয় সেজে উঠেছে রাস্তাঘাট। দেবীপক্ষের সূচনা আসন্ন। মাকে সাজাতে ব্যস্ততা এখন শীর্ষে। প্রতিমার গলায়-কানে উঠবে ডাকের সাজ, হাতে উঠবে অস্ত্র, মাথার পিছনে বসবে শুম্ভ-নিশুম্ভের যুদ্ধ, মহিষাসুর বধের আধারে তৈরি চালচিত্র। মৃণ্ময়ী মূর্তি থেকে মায়ের সাজ, চালচিত্র, অস্ত্র তৈরি তথা গোটা দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় এক শিল্পজগৎ।
আশ্বিনের শারদপ্রাতে...
দুর্গাপুজোর এই আড়ম্বর আজকে নতুন নয়। শরৎকালীন এই দুর্গাপুজোর সূচনা আন্দাজ ১৬০৬ সালে, অবিভক্ত বাংলায় নদিয়া জেলার ভবানন্দ মজুমদারের হাত ধরে। তারও আগে রাজশাহী জেলার তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণের পুজোয় সপরিবার দুর্গাপ্রতিমার উল্লেখ পাওয়া যায়। আনুমানিক ১৫৮০ সাল নাগাদ প্রায় নয় লক্ষ টাকা ব্যয় করে তিনি দুর্গাপুজো করেন। তবে বঙ্গদেশে মায়ের মূর্তির বর্ণনা পূর্বেও পাওয়া গিয়েছে। পাল যুগে দশভুজা, সিংহবাহিনী রূপে মা দুর্গার পুজোর উল্লেখ পাওয়া যায়।
পরবর্তী কালে ১৭৯০ সাল নাগাদ হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ার বারো জন বন্ধু মিলে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন, সেখান থেকে শুরু হয় ‘বারো ইয়ারি’ বা ‘বারোয়ারি’ পুজোর। যুগ পাল্টেছে, শাস্ত্রমতে পুজোর আচার এক থাকলেও দুর্গাপ্রতিমার রূপ পাল্টেছে। শিল্পীর চেতনায় কখনও মা অসুরদলনী, কখনও বলপ্রদায়িনী, কখনও মা শান্তিপ্রদায়িনী। কুমোরটুলির মৃণ্ময়ী মূর্তিতে এমন অনেক রূপ ফুটে উঠেছে শিল্পীর হাতে। তেমনই মায়ের মূর্তি তৈরির উপাদানও পাল্টেছে। ধাতু, কাঠ, কাগজ, পাথর, পাটের উপরেও মাতৃমূর্তি কল্পনা করেছেন শিল্পীরা।
ওগো আমার আগমনী আলো
অনেক বছর ধরেই প্রতিমা গড়ছেন শিল্পী ভবতোষ সুতার। তিনি বললেন, “আসলে প্রত্যেকটা মেটেরিয়ালের স্মৃতি থাকে। হাতে মাটি নিলে যেমন ভিতর থেকেই একটা বোধ সঞ্চারিত হয়। মৃত্তিকার সঙ্গে প্রকৃতির যোগ রয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই চেতনায় মৃণ্ময়ী মূর্তির একটা ছবি তৈরি হয়ে যায়। তবে শুধু মাটি কেন? কাঠ, পাথর, টেরা কোটা, ধাতু... এমনকি গালার প্রতিমাও তৈরি করেছি।” শিল্পী কী ভাবে সৃষ্টি করছে, তার উপরেই মাতৃমূর্তির রূপ নির্ধারিত হচ্ছে। শিল্পচেতনাই বাঙ্ময় হচ্ছে প্রতিমার রূপে। শিল্পীর কথায়, “মায়ের মূর্তিতেই কি শুধু ঈশ্বর রয়েছেন? সৃষ্টিই সাধনা, সেখানেই ঈশ্বর। এখন আমি কাজ করছি মানুষ ও তাঁর ঐশ্বরিক রূপ নিয়ে। মানুষের ঐশ্বরিক রূপ অন্তর্দৃষ্টিতে ধরা পড়ে, সেটাই শিল্পীর হাতের কাজে ফুটে ওঠে ধাতু, মাটি বা পটে।”
গ্রামবাংলায় এখনও দুর্গার পটচিত্র পূজিত হয়। এ সময় চাহিদা বাড়ে দুর্গা পটের। সেখানে মায়ের রূপ ফুটে ওঠে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশের সঙ্গে। রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত পটশিল্পী কল্পনা চিত্রকর বললেন, “আমরা চণ্ডীপুরের (পূর্ব মেদিনীপুর) পটুয়ারা অনেক দিন ধরেই পটচিত্রে মায়ের রূপ ফুটিয়ে তুলছি। এ বার কলকাতার বৃন্দাবন মাতৃমন্দির লেনের পুজোয় পটচিত্র করছি। আর পটচিত্রের দোসর হল পটের গান। এই গানেই পটের ব্যাখ্যা থাকে।” দিল্লি, মুম্বই, দেশবিদেশ থেকেও পটের দুর্গার বায়না আসে। এ সময়ে চিত্রকরদের হাতের তুলিতে রং শুকোয় না। দিনরাত এক করে তাঁরা দুর্গাপট তৈরির সাধনায় নিমগ্ন।
এ বার পটচিত্রের আঙ্গিকে মায়ের প্রতিমা তৈরি হচ্ছে কাশী বোস লেন দুর্গাপুজো সমিতির মণ্ডপেও। লীলা মজুমদারের ‘পাকদণ্ডী’কে কেন্দ্রে রেখে মণ্ডপ সাজাচ্ছেন শিল্পী অনির্বাণ দাস। তিনি বললেন, “মণ্ডপে আমরা টং লিংয়ের রেলগাড়ি, শব্দছক এমন অনেক কিছুই রাখছি। তবে মাতৃমূর্তি হবে পটচিত্রের আঙ্গিকে। আবার ‘আলিপুর সর্বজনীন’-এর পুজোয় থাঙ্কা পেন্টিংয়ের আদলে আঁকা হচ্ছে মায়ের মুখ।” শিল্পীর কল্পনায় মা কখনও সমতলবাসিনী কখনও বা হিমালয়পুত্রী।
আবার টেরা কোটা, ডোকরাতেও তৈরি হচ্ছে প্রতিমা। বাঁকুড়ার বিকনা গ্রামে যেমন ডোকরার দুর্গামূর্তি তৈরি হয়। কলকাতার মণ্ডপ থেকেও বরাত যায়। শিল্পী শ্যামসুন্দর কর্মকার বললেন, “ডোকরার দুর্গা আমরা পুজোর সময়ে সবচেয়ে বেশি তৈরি করি। অর্ডারের উপরে নির্ভর করে মূর্তি কত বড় হবে। কার্নিভালের সময়ে রাজ্য সরকারের তরফেও অনেক অর্ডার আসে উপহার হিসেবে দেওয়ার জন্য।”
ডাকের সাজ।
ডোকরা, ধাতু, পটের মূর্তি যেমন রয়েছে, এখন বর্জ্য রিসাইকল করেও মাতৃমূর্তি তৈরি হচ্ছে। চার বছর ধরে রিসাইকল সামগ্রী দিয়ে প্রতিমা তৈরি করছেন টেকনো ইন্ডিয়া কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। প্রথম বার স্ক্র্যাপ মেটাল, তার পরের বছর কাপড়, তৃতীয় বর্ষে কাগজের মণ্ড দিয়ে দুর্গামূর্তি তৈরি করেছেন তাঁরা। এ বছর গড়িয়ার টেকনো ইন্ডিয়ার শিক্ষক সৈকত চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে পাট দিয়ে তৈরি হচ্ছে সিংহবাহিনীর রূপ। সৈকতের কথায়, “পাট যেহেতু পরিবেশবান্ধব, সেই জন্যই এই উপাদান বেছে নিয়েছি আমরা। স্কুলের শিক্ষক, ছাত্ররা মিলে এই মূর্তি তৈরি করি। শাস্ত্রমতে এই দেবীমূর্তির পুজো না হলেও শিল্পসৃষ্টিতেই আমাদের সাধনা।”
তব অচিন্ত্য রূপচরিত
মূর্তি গড়ার পরে মায়ের সাজের পালা। মাথার মুকুট, কানের গয়না তৈরিও যেন এক বিশাল শিল্পযজ্ঞ। এই সাজ এখন বেশির ভাগই বানানো হয় কুমোরটুলিতে। নবদ্বীপ থেকেও মায়ের সাজ আসে। এক সময়ে বিদেশ থেকে আমদানি করা হত প্রতিমার সাজের উপকরণ। জমিদারবাড়ির প্রতিমার গয়না জমকালো করে গড়ে তুলতে ব্যবহার হত রুপোর ফয়েলের। সেই রুপো আমদানি করা হত জার্মানি থেকে। ডাকবিভাগের মাধ্যমে তা আসত বলে তার নাম হয়ে গেল ডাকের সাজ। আজও সাবেকি পুজোয় মায়ের বসন-ভূষণ সম্পূর্ণ হয় এই ডাকের সাজে।
এক সময়ে সাগরপাড় থেকে আনা দামি গয়নায় সাজানো হত জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁ বাড়ির দুর্গাপ্রতিমাকে। জার্মানি, ফ্রান্স থেকে দামি পাথর বসানো গয়না বানিয়ে নিয়ে আসা হত প্রতিমার জন্য। দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতীর বেনারসি শাড়ির পাড়েও বসত সোনার জরি। কার্তিক-গণেশের মূর্তিও সোনার জরির পাড়বসানো ধুতিতে সেজে উঠত। এখনও কলকাতার অনেক পুজোয় প্রতিমার জন্য অজমের, অমৃতসর থেকে বস্ত্র আসে। আবার টাকার অঙ্ক বাড়ালে খোদ বারাণসী থেকেও আনা হয় প্রতিমার শাড়ি।
জাগো দশপ্রহরণধারিণী
সবশেষে মায়ের অস্ত্রসজ্জা। কলকাতার কাছেই হাওড়ায় রয়েছে এক অস্ত্রগ্রাম। টিনের পাত কেটে সেখানে তৈরি হয়ে চলেছে দশ হাতের দশ অস্ত্র। ত্রিশূল, খাঁড়া, তির-ধনুকের আকারে প্রথমে কেটে নেওয়া হয় টিনের পাত, তার উপরে রং করে শেষ হয় অস্ত্র তৈরি। এই অস্ত্রেই সেজে ওঠে বিভিন্ন মণ্ডপের ঠাকুর। তবে কিছু অস্ত্র আসে নবদ্বীপ থেকেও। সেখানে আবার অস্ত্র তৈরি হয় পেতলের। সারা বছর পেতল দিয়ে বাসনকোসন বানানো হলেও পুজোর আগে শুধু অস্ত্রই তৈরি করেন নবদ্বীপের পেতল-শিল্পীরা। একে একে তৈরি হয় চক্র, শূল, দণ্ড, খড়্গ, ধনুর্বাণ, অক্ষমালা-কমণ্ডলু, অভেদবর্ম। অস্ত্রসজ্জায় সম্পূর্ণ হয় মা চণ্ডীর রূপ। দেবতারা অস্ত্র দিয়ে যে ভাবে দুর্গাকে সাজিয়ে তুলেছিলেন, ঠিক সে ভাবেই এই ধরাধামে মাকে অস্ত্ররূপে শক্তিপ্রদান করেন তাঁর সন্তানরা।
কিন্তু শিল্পীর সম্মান বা কদর আর ক’জন পান! শ্যামসুন্দর যেমন বললেন, “পেটের দায়ে কাজ করে চলেছি, আমাদের কেউ চিনতেও পারে না।” তবুও বছরের পর বছর অগণিত কারিগরের শিল্পীমন এ ভাবেই মায়ের সাধনায় লিপ্ত। আগমনীর আলোয় যখন উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মায়ের মুখ, আভূষণ-প্রহরণ, ঢাকের আওয়াজে গমগম করে পুজোপ্রাঙ্গণ, তখন নেপথ্যের কারিগরদের আর ক’জন মনে রাখেন! ভক্তের ভক্তিতে মায়ের পায়ের সামনের ফলকে শিল্পীর নামও চাপা পড়ে যায় গন্ধ-পুষ্পে, সচন্দন বিল্বপত্রে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)