সমাজমাধ্যম মুহূর্তে যেমন কাউকে জনপ্রিয় করে দিতে পারে, তেমনই ছুড়ে ফেলতেও দেরি হয় না। অনুরাগীরাই কাউকে তারকা বানান, আবার তাঁকে মুছে ফেলতেও সময় লাগে না। জীবনের উত্থান-পতনের এমন রসায়নের সঙ্গে খুব ভাল ভাবেই পরিচিত তারকারা। না চাইলেও, তাঁদের সন্তানেরা এমন পরিস্থিতির মধ্যে এসে পড়েন।
সেই সত্যিটাকেই ছোট থেকে মেয়ে নাইসা এবং ছেলে যুগকে শিখিয়ে এসেছেন বলিউড অভিনেত্রী কাজল। অজয় দেবগন এবং কাজলের সন্তান বলেই, সুযোগ পেলেই পাপারাৎজ়ি বা ফটোশিকারিরা তাদের ছবি তুলতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। সেই ছবি সামনে আসতেই তাদের নিয়ে নিন্দে, সমালোচনা হয়েছে।
কখনও নাইসাকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে সমাজমাধ্যমে, কখনও মেয়ের আচরণের জন্য অজয় দেবগণকেও নিশানা করা হয়েছে। মেয়ের বিরুদ্ধে অকারণে নিন্দেমন্দ শুনে এক সময় প্রতিবাদও জানিয়েছেন অজয়। তবে কাজল একজন পরিণত মায়ের মতো সন্তানদের সামলেছেন। বুঝিয়েছেন, সব কথা গায়ে মাখার দরকার নেই। কাজলের কথায়, ‘‘আমি ওদের বলি, তুমি মন্দিরে গেলেও লোকে কথা বলবে, ক্লাবে গেলেও কিছু লোকজন নিন্দে করবেই। কারণ, তোমরা অভিনেতা পরিবারের সন্তান। এ সব কথা ভেবে মাথা খারাপ করার কোনও মানেই নেই।’’
আরও পড়ুন:
তারকাদের ক্ষেত্র আলাদা। সব সময়েই তাঁদের এবং তাঁদের পরিবারের উপর লাইমলাইট থাকে। লোকজন তারকাদের প্রতিটি পদক্ষেপ জানতে উৎসাহী হন। কোনও কাজ ঠিক, ভুল যা-ই মনে হোক না কেন, শুরু হয় নিন্দে। বয়স বিবেচনা করার দরকারও হয় না। ধেয়ে আসে কটূক্তি। এমন পরিস্থিতি সকলের পক্ষে সামলানো সহজ নয়। বিশেষত, বেড়ে ওঠার সময় বা যখন মন খুব অনুভূতিপ্রবণ থাকে, তখন এই পরিস্থিতি মনে গভীর রেখাপাত করতে পারে। তবে শুধু তারকাসন্তান নয়, বাস্তবেও বিভিন্ন বয়সের শিশুদের এমন নিন্দে, সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। কখনও তা সমাজমাধ্যমে, কখনও আবার স্কুল, কখনও আত্মীয়দের মধ্যেই।
সন্তানদের এমন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কোন শিক্ষা দেবেন? নিজেও সমালোচনা, নিন্দার সম্মুখীন হলে কী করবেন? মনো-সমাজকর্মী মোহিত রণদীপ বলছেন, "কোনও মানুষের আত্মপ্রত্যয় কতটা, তার উপর নির্ভর করে বাহ্যিক সমালোচনা বা নিন্দা মনে কতটা রেখাপাত করবে। অভিভাবকদের ছোট থেকেই সন্তানের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলতে হবে। ভাল এবং খারাপ— একই সঙ্গে দুই ধরনের মন্তব্যই যাতে সন্তান গ্রহণ করতে পারে, সেই বিষয়ে সচেষ্ট হওয়া দরকার। নিজের ভুল স্বীকার করাও কিন্তু আত্মপ্রত্যয় থেকেই আসে। একই সঙ্গে কোন কথায়, কার কথায় গুরুত্ব দেওয়া দরকার, কোনটায় নয়, সেই বোধটাও তৈরি করা যেতে পারে।"
সন্তানের সমালোচনা করলে, বিনা কারণে ক্রমাগত তাদের নিন্দা করা হলে মা-বাবার মনেও তার গভীর প্রভাব পড়ে। কাজল জানিয়েছেন, মেয়েকে নিয়ে নিন্দের ঝড় ওঠায় কখনও বিরক্ত হয়েছেন, কখনও হতাশ হয়েছেন। একই রকম খারাপ কথা শুনলে শিশু বা কিশোর মনেও তার প্রভাব পড়া স্বাভাবিক।
মনোবিদ রিমা ভান্ডেকর বলছেন, ‘‘কখনও কখনও নিন্দের ভাষা খুবই বেদনাদায়ক হয়। কিন্তু পরিণতমনস্কেরা কখনও তাতে ভেঙে পড়েন না। বরং সমালোচনা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে নতুন ভাবে গড়ে তোলা যায়।’’ তিনি বলছেন, ‘গ্রোথ মাইন্ডেসটের’ কথা। এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন রিমা। দক্ষতা, যোগ্যতা নিয়ে সমালোচনা, নিন্দা হলে কেউ কেউ পরিণতমনস্কতার পরিচয় দিয়ে নিজের ভুলত্রুটির মূল্যায়ন করে পরিস্থিতি অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।
কিন্তু সকলেই তো সব সময় ভুল করেন না। মোহিতের কথায়, ‘‘এই সমালোচনার জবাব দেওয়ার নানা রকম ধরন আছে। কেউ চিৎকার বা ঝগড়া করে নিজের বক্তব্য জাহির করেন। কেউ একেবারে চুপ হয়ে যান। প্রতিবাদ করেন না। কেউ আবার শান্ত ভাবে অথবা দৃঢ়তার সঙ্গে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে দেন।’’ পরিস্থিতি এড়িয়ে গেলে যদি তা থামানো যায়, সেই কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। কিন্তু চুপ করে গেলে যদি সমাজের কাছে ভুল বার্তা যায়, তা হলে প্রতিবাদের দরকার। কিন্তু সেই ভাষা কেমন হবে? অন্যের বক্তব্যকে মান্যতা দিয়েও, নিজের অবস্থানে অনড় থাকার কথা শান্ত কিন্তু দৃঢ় ভাবে বুঝিয়ে দেওয়া যায়। ব্যাক্তিবিশেষকে উত্তর না দিয়ে, সকলের জন্য নিজের অবস্থান স্পষ্ট করা যেতে পারে।
রিমা জানাচ্ছেন, ক্রমাগত সমালোচনায় জর্জরিত হলে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে, এই পরিস্থিতিতে কী করা যায়? নিরপেক্ষ ভাবে ভাবার চেষ্টা করা যেতে পারে। এক জন শান্ত এবং সফল মানুষ হিসাবে কী করা যায়। তা নিয়ে ভাবা দরকার, না কি সমালোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে নিজের বক্তব্য বুঝিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
তবে এমন পরিস্থিতি এক জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যে ভাবে সামাল দিতে পারেন, অপিরণত কারও পক্ষে তা ঠান্ডা মাথায় সামলানো কঠিন হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে দরকার হবে অভিভাবকের সাহায্য। ঠিক যেমন মেয়ের ক্রমাগত নিন্দার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন অভিনেতা অজয় দেবগন, ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সন্তানের পাশে থাকার মানসিকতাই তাদের জোর দেবে।