মানুষ কেন সঙ্গীত পছন্দ করে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে যুগে যুগে অজস্র গবেষণা হয়েছে। বহুমুখী বিশ্লেষণ এবং উত্তরকে পাশে সরিয়ে এ কথা বলাই যায়, সঙ্গীত মানুষের মনে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। ভিড়ের মাঝে, লাইভ অনুষ্ঠানে বা ঘরের কোণে একান্ত পরিসরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীত আমাদের মনকে আচ্ছন্ন করে, শান্তি দেয়। নতুন করে ভাবতে শেখায়।
প্রাচীন কালে রাজপাট সামলানোর মাঝে রাজা বা সম্রাটেরা বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে সঙ্গীতকে বেছে নিতেন। সমুদ্রগুপ্ত নিজে বীণা বাজাতে পছন্দ করতেন। নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের সঙ্গীতপ্রীতি তো বহুশ্রুত। বিভিন্ন গবেষণা এবং সমীক্ষা বলছে, কঠিন সময়ে জীবনে নতুন পথের সন্ধান দিতে পারে সঙ্গীত।
সময়ের সঙ্গে ব্যস্ত জীবনে অবসাদে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা যেমন ক্রমবর্ধমান, তেমনই দৈনন্দিন জীবনের ক্রমবর্ধমান ক্লান্তি এবং ইঁদুরদৌড়ে মনকে শান্ত রাখতে এবং নতুন জীবন পেতে নতুন করে সঙ্গীতের সাহায্য নিচ্ছেন অনেকেই। সেখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘মিউজ়িক থেরাপি’। শহরেও এখন রয়েছে সুবিধা।

ছবি: সংগৃহীত।
‘মিউজ়িক থেরাপি’ কী
মানসিক স্বাস্থ্যের অন্বেষণে এখন অনেকেই বিভিন্ন ধরনের থেরাপির সাহায্য নিয়ে থাকেন। ‘মিউজ়িক থেরাপি’র ক্ষেত্রে এক জন মনোবিদ ক্লায়েন্টের থেরাপির জন্য সঙ্গীতের সাহায্য নিয়ে থাকেন। কখনও সেখানে বাদ্যযন্ত্র বা তালবাদ্যের সাহায্যও নেওয়া হতে পারে। সঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের যোগসূত্র সুপ্রাচীন হলেও ‘ক্লিনিক্যাল থেরাপি’ আকারে তার ব্যবহার অপেক্ষাকৃত নবীন প্রয়াস।
কাদের প্রয়োজন
মিউজ়িক থেরাপিস্ট চন্দ্রিমা বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, যে কেউ এই ধরনের থেরাপির সাহায্য নিতে পারেন। সময়ের সঙ্গে ‘মিউজ়িক থেরাপি’র চাহিদাও বেড়েছে। পেশায় ১২ বছরের অভিজ্ঞতাকে সম্বল করেই চন্দ্রিমা বললেন, ‘‘ভাল কথা বা ভাষণ যাকে ‘শব্দ-স্নান’ বলা যেতে পারে, তা আমাদের মনকে প্রভাবিত করে। একই ভাবে সঙ্গীতও আমাদের মনের বন্ধ দরজাগুলো খুলে দিতে পারে। তখন মনের জমা না বলা কথাগুলো বাইরে চলে আসে।’’
তবে জটিল রোগ থেকে সুস্থ হচ্ছেন, ডিমেনশিয়া, অনিদ্রা বা অ্যালঝাইমার্স রোগীদের ক্ষেত্রে এই ধরনের থেরাপি উপকারী। ২০১৭ সালে আমেরিকার ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর কমপ্লিমেন্টারি অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটিভ হেল্থ’ ৪২১ জনকে নিয়ে এই বিষয়ে একটি সমীক্ষা করে। দেখা গিয়েছে, তাঁদের অবসাদ এবং উদ্বেগ দূর করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে সঙ্গীত। অনেকেরই হয়তো স্মরণে থাকবে, ২০২০ সালে হাসপাতালের বিছানায় রোগশয্যায় বর্ষীয়ান অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চিকিৎসায় চিকিৎসকেরা মিউজ়িক থেরাপির সাহায্য নেন। অভিনেতা তাতে সাড়াও দিয়েছিলেন।
আবার বিশেষ ভাবে সক্ষম ব্যক্তির ক্ষেত্রেও এই থেরাপি উপকারী। বিশেষ ভাবে সক্ষম শিশুদের নিয়েই মূলত কাজ করেন মিউজ়িক থেরাপিস্ট কাকলি চক্রবর্তী। তিনি বললেন, ‘‘ওদের মধ্যে কেউ হয়তো কথা বলে না। কেউ মনের কথা ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারে না। সঙ্গীত সেখানে খুব সাহায্য করে।’’
যে কেউ সাহায্য নিতে পারেন
কোনও সমস্যার থেকে মুক্তির জন্য তো বটেই, তবে সাধারণ কোনও ব্যক্তিও মিউজ়িক থেরাপির সাহায্য নিতে পারেন। চন্দ্রিমার কথায়, ‘‘এখন প্রত্যেকের জীবনেই কমবেশি অবসাদ এবং কাজের চাপ রয়েছে। সেগুলি না থাকলেও যে কেউ থেরাপির সাহায্য নিতে পারেন।’’

ছবি: সংগৃহীত।
গান তো সকলেই শোনেন
কমবেশি প্রত্যেকেই গান শুনে থাকেন। কেউ কেউ সঙ্গীত পছন্দ করেন। তা হলে আলাদা করে ‘থেরাপি’ কেন? জানা যাচ্ছে, নিজে গান শুনলেও মন ভাল হয়। কিন্তু সেখানে কথা বলার বা মনের পরিস্থিতি অনুযায়ী সঙ্গীত বেছে দেওয়ার মানুষটি উপস্থিত থাকেন না। আর এক জন মিউজ়িক থেরাপিস্ট সেটাই করে থাকেন। কাকলি যেমন বললেন, ‘‘ভৈরবী রাগটি উচ্চ রক্তচাপ এবং উদ্বেগের ক্ষেত্রে খুব উপকারী। আবার স্মৃতিশক্তি দুর্বল হলে, সে ক্ষেত্রে শিবরঞ্জনী রাগ খুবই কার্যকরী।’’ সঙ্গীত ও সুরের মধ্যে মন ও স্মৃতির পুর্নগঠনের রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। চন্দ্রিমার কথায়, ‘‘সঙ্গীত শক্তিশালী। তবে সমস্যা অনুযায়ী তাকে ব্যবহার করা হয়। কত রোগীকে দেখেছি, সঠিক সঙ্গীতের ব্যবহারে নতুন ভাবে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। কেউ বা হারানো ক্ষমতা ফিরে পাচ্ছেন।’’
কী ভাবে করা হয়
এই থেরাপিতে ব্যক্তিকে সাধারণত বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের রাগাশ্রয়ী সঙ্গীত (যেমন মল্লার, ভৈরবী ইত্যাদি) শোনানো হয়। কখনও বিভিন্ন শ্লোকও ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি, চলতে থাকে থেরাপিস্টের সঙ্গে কথোপকথন। দ্বিতীয়ার্ধে ব্যক্তিকে কোনও গানও শোনানো হতে পারে। সেই গানের তালিকায় বহুশ্রুত হিন্দি বা বাংলা গানও (যার মধ্যে অন্যতম রবীন্দ্রসঙ্গীত) থাকতে পারে। কেউ কেউ নিজে গান গেয়েও শোনান। শৈশবে শিল্পী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন চন্দ্রিমা। তিনি বললেন, ‘‘বিভিন্ন জন বিভিন্ন ভাবে থেরাপি করেন। আমি যেমন নিজেই গান গেয়ে শোনাই।’’ সব শেষে মনোবিদ তাঁর বিশ্লেষণ অনুয়ায়ী ক্লায়েন্টকে পরবর্তী পদক্ষেপ বা সেশন সম্পর্কে অবহিত করেন।
বিশেষ ভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অনেক সময়ে কোনও শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামের মাধ্যমে থেরাপি শুরু হয়। সেখানে ধ্যানও থাকতে পারে। যাঁরা কথা বলতে পারেন, তাঁদের সঙ্গীতের বিভিন্ন সরগম অভ্যাসের পাশাপাশি রাগাশ্রয়ী সঙ্গীত শোনানো হয়। আবার শ্রবণশক্তি এবং প্রতিক্রিয়ার উন্নতিতে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়েও শোনানো হয়। কাকলি বললেন, ‘‘আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বিশেষ ভাবে সক্ষম শিশুরা সঙ্গীত শুনতে বা কোনও বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পছন্দ করে। তাদের মস্তিষ্কে সঙ্গীতের ইতিবাচক প্রভাব অনস্বীকার্য।’’

ছবি: সংগৃহীত।
ক’টা সেশন
‘মিউজ়িক থেরাপি’র প্রতিটি সেশন এক থেকে দেড় ঘণ্টার হতে পারে। ব্যক্তিগত ভাবে বা ছোট ছোট দলেও থেরাপি করানো হয়। ব্যক্তির মানসিক পরিস্থিতির উপরে ‘মিউজ়িক থেরাপি’র সেশনের সংখ্যা নির্ভর করে। কারও কারও ক্ষেত্রে দুই থেকে চারটি সেশনে উপকার পাওয়া যায়। আবার এমন অনেকেই রয়েছেন যাঁরা অন্য কোনও থেরাপির মতোই (যেমন ফিজ়িওথেরাপি) নির্দিষ্ট সময়ান্তরে ‘মিউজ়িক থেরাপি’ নিয়ে থাকেন। যদি কেউ থেরাপি নিয়ে ভাল থাকেন, তা হলে সেশনের সংখ্যাও বাড়তে থাকে।
কোথায় কোথায় হয়
সময়ের সঙ্গে ‘মিউজ়িক থেরাপি’ প্রচারের আলোয় চলে এসেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে, শহরের বিভিন্ন প্রান্তে সেন্টার রয়েছে। একাধিক বড় হাসপাতালেও আলাদা করে রোগীদের জন্য ‘মিউজ়িক থেরাপি’ ব্যবস্থা করা হয়। বাড়িতে আলাদা করে সেশনের পরিষেবাও দিয়ে থাকেন কেউ কেউ।
আরও পড়ুন:
খরচ কেমন
সাধারণত দলগত থেরাপির থেকে একক স্বাধীন থেরাপির খরচ বেশি। জানা যাচ্ছে, ‘মিউজ়িক থেরাপি’র সেশন প্রতি খরচ ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
ভবিষ্যৎ কী রকম
শহরে এখন মিউজ়িক থেরাপির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে কোনও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড না থাকার কারণে এক এক জন এক এক ভাবে থেরাপি করে থাকেন। আগামী দিনে জীবনের ব্যস্ততা এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ সমাজে শান্তির খোঁজে এই ধরনের থেরাপির গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।