প্রাচীন কালে পড়াশোনা এবং শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ‘শ্রুতি’র প্রচলন ছিল। পুঁথি থেকে গুরুরা পাঠ করতেন। সেই পাঠ শুনে স্মৃতিবাহিত হয়ে অন্যদের মধ্যে শিক্ষার বিষয়বস্তু ছড়িয়ে যেত। জন্মের পর থেকে ধীরে ধীরে শিশুর মস্তিষ্ক পরিণত হয়। এই সময়ে পাঠ এবং শ্রুতির গুরুত্ব অপরিসীম। অক্ষরজ্ঞান হওয়ার আগে থেকেই বাড়িতে বড়দের কাছে গল্প শোনার রেওয়াজ তাদের পার্শ্ববর্তী জগৎ সম্পর্কে প্রারম্ভিক জ্ঞান তৈরি করে। কিন্তু সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, নতুন প্রজন্মের অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানকে অল্প বয়সে গল্পের বই পড়ে শোনান না। এই সুপ্রাচীন পারিবারিক রীতি সঙ্কুচিত হতে শুরু করার ফলে ভুগছে শিশুর প্রতিপালন। বয়সের সঙ্গে তাদের একাধিক সমস্যার মোকাবিলাও করতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
বর্তমান পরিস্থিতি
সম্প্রতি ব্রিটেনের একটি সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে, নতুন প্রজন্মের অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের গল্পের বই পড়ে শোনাতে পছন্দ করেন না। নেপথ্যে দৈনিক ব্যস্ততা, বিনোদনে আসক্তি, পাঠের অনভ্যাসের মতো নানা কারণ উঠে এসেছে। এই সমীক্ষায় ৫থেকে ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের এবং তাদের বাবা-মায়েদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সমীক্ষাটি যত জন বাবা-মাকে নিয়ে করা হয়েছিল, তাঁদের অর্ধেকেরও কম বাবা-মা জানিয়েছেন যে, সন্তানকে গল্প পড়ে শোনাতে তাঁরা ভালবাসেন। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, প্রায় ২৯ শতাংশ শিশুর কাছে বই পড়া আনন্দদায়ক বিষয়ের পরিবর্তে হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘শিক্ষার বিষয়’। আরও দেখা গিয়েছে যে, ৫ থেকে ১৩ বছর বয়সি তিন জন শিশুর মধ্যে এক জনকে কখনও গল্প পড়ে শোনানো হয়নি।
শিশুর সমস্যা
এখনকার অধিকাংশ শিশুর সঙ্গী মোবাইল ফোন বা ট্যাব। কার্টুন থেকে শুরু করে বই পড়াও সেখানেই। কিন্তু মা-বাবার মুখে শিশু যদি গল্প না শুনে বড় হয়, তা হলে তার বুদ্ধির বিকাশে সমস্যা হতে পারে। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ জানালেন, এখনকার শিশুদের মূলত দু’টি সমস্যা দেখা যাচ্ছে— কমিউনিকেশন স্কিল এবং কগনিটিভ স্কিল। পায়েল বললেন, ‘‘কোনও নির্দেশ শুনে সেই অনুযায়ী বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা শিশুদের দিনে দিনে কমে যাচ্ছে।’’ ফলে কী ভাবে প্রশ্ন করতে হবে বা কোন পরিপ্রেক্ষিতে কী কথা বলতে হবে, অনেক সময়েই বাচ্চারা সেই খেই হারিয়ে ফেলছে। পায়েলের কথায়, ‘‘ফলে স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরেই সে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে।’’ কারণ সমবয়সিদের মধ্যে অন্যেরা যখন পড়াশোনায় সফল হচ্ছে, তখন তার মনের মধ্যে অনেক সময় রাগের উদ্রেক ঘটছে।

ছবি: ফ্রিপিক।
শ্রুতি এবং বুদ্ধি
কারও মুখ থেকে গল্প শুনলে শিশুমনে প্রশ্ন জাগে, যা নিজে পড়লে সম্ভব নয়। অন্যের মুখে গল্প শুনলে দ্বিমুখী কথোপকথন তৈরি হয়, যা বুদ্ধির বিকাশে সাহায্য করে। কিন্তু নিজে বই পড়লে তা সম্ভব নয়। পায়েলের কথায়, ‘‘ধরা যাক, মায়ের মুখে শিশু শুনল, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটি বাঘ এগিয়ে যাচ্ছে। শিশু তার পর জিজ্ঞাসা করতেই পারে বাঘটিকে কেমন দেখতে। কিন্তু একা একা বই পড়লে এই কথোপকথন তৈরি হয় না।’’ বিষয়টিকে বলা হয় ‘একমুখী কথোপকথন’।
মনোবিদদের একাংশ দাবি করেছেন, শিশুমনে তৈরি প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেওয়া উচিত। তার ফলে তাদের ‘নিউ লার্নিং’ সম্ভব। পায়েল বলছিলেন, ‘‘শিশুর তাৎক্ষণিক প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে তার কল্পনার পরিধিও বিকশিত হয়।’’ কিন্তু নিজে নিজে মোবাইলে বা ট্যাবে বই পড়ার ক্ষেত্রে শিশু তার মনে তৈরি প্রশ্নের উত্তর পায় না। পায়েল জানালেন, এর ফলে শিশুর বাক্যগঠন, কথা বলা-সহ একাধিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। তিনি আরও বলেন, ‘‘এখন ছ’সাত বছর বয়সে বহু বাচ্চাকে স্পিচ থেরাপি করাতে হচ্ছে।’’
কৌতূহল এবং একাগ্রতা তৈরি হচ্ছে না
নিজে নিজে বই পড়ার মাধ্যমে শিশুমনে কৌতূহল তৈরি হয় না। একই সঙ্গে তার একাগ্রতাও নষ্ট হয়। পায়েলের কথায়, ‘‘বাঘের গল্প শুনতে শুনতে বাচ্চাটি এক মনে পরবর্তী অংশ শোনার জন্য অপেক্ষা করবে। কিন্তু নিজে মোবাইলে বা ট্যাবে স্ক্রল করলে সেই আকর্ষণ তৈরি হবে না। পছন্দ না হলেই পরবর্তী গল্পে চলে যাবে সে।’’

ছবি: ফ্রিপিক।
সান্নিধ্য ও নিরাপত্তাবোধ
পায়েলের মতে, মা-বাবার পাশে বসে গল্পের বই বড়া বা তাঁদের মুখ থেকে গল্প শোনার মধ্যে শিশুর যে নিরাপত্তাবোধ কাজ করে, তার কোনও বিকল্প নেই। আগের পরিবারে দাদু-ঠাকুরমারাও ছোটদের গল্প বলতেন। নিউক্লিয়ার পরিবারে তাঁদের অভাব থাকলে মা-বাবাকেই আলাদা করে শিশুর জন্য সময় বার করে নিতে হবে। পায়েল বললেন, ‘‘বাড়ির বড়দের মুখে গল্প শোনার মধ্যে একটা অন্য রকম আবেগ কাজ করে। এখনকার পরিবারে সেটাই অনেক শিশুর উপলব্ধির বাইরে রয়ে যাচ্ছে।’’
সমাধান কোন পথে
সম্ভাব্য বিপদের হাত থেকে শিশুকে রক্ষা করতে পায়েল কতগুলি পরামর্শের দিকে নির্দেশ করলেন—
১) বাচ্চাদের স্ক্রিন টাইম নির্দিষ্ট করে দেওয়া উচিত। মোবাইল বা ট্যাব দেখার সময়ে শিশুর পাশে বড়দের থাকা উচিত।
২) দিনের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময় শিশুর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলার জন্য বরাদ্দ করা উচিত। শুধু গল্পের বই নয়, তখন তার সঙ্গে খোলা মনে কথোপকথন করা উচিত।
৩) শিশুর কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না জানতে তাকে একসঙ্গে একাধিক নির্দেশ দিয়ে দেখা যেতে পারে। যেমন, দূরে রাখা রাখা খাতা এবং পেনসিল নিজের কাছে নিয়ে এসে একটি বৃত্ত আঁকতে বলা।
৪) ছোটদের সামনে অনেক সময়ে কোনও পরিস্থিতি উপস্থাপন করে তাদের মতামত জানতে চাওয়া যেতে পারে। এর ফলে তাদের মধ্যে কল্পনা, বিশ্লেষণ এবং উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।