সময় পাল্টাচ্ছে। পাল্টে যাচ্ছে অভিভাবকত্বের ধরনধারণও। মা-বাবার সঙ্গে সন্তানদের কথা বলার বিষয়বস্তুও আর আগের মতো নেই। তাই সন্তানদের সামলানোর প্রক্রিয়াতেও বদল আনতে হচ্ছে। কেউ কেউ বলেন, আজকের ব্যস্ত জীবনে বাবা-মা হওয়া সহজ কথা নয়। কাজের চাপ, সময়ের অভাব, সন্তানের পড়াশোনা— সব মিলিয়ে দু’তরফেই মানসিক চাপ বেড়েছে। তাই এখন শুধু কঠোর শাসন নয়, দরকার সচেতন ভাবে সন্তানকে বড় করা। যাকে বলা হচ্ছে, ‘মাইন্ডফুল পেরেন্টিং’ অর্থাৎ সন্তান লালনপালনের সময়ে বিশেষ মনোযোগী হওয়া।
রোজকার যাপনে এখন ‘মাইন্ডফুলনেস’ শব্দটির জনপ্রিয়তা বেড়েছে। ‘মাইন্ডফুল’ শব্দটির পরে বসছে খাওয়া, কথা বলা, কাজ করা, সকাল থেকে রাতের রুটিন, হাঁটা— সব রকম ক্রিয়াকলাপ। তেমনই এখন বিশেষ অভিভাবকত্ব নিয়ে কথা চলছে চারদিকে। নতুন যুগের বাবা-মায়েরা অভিভাবকত্বের এমন ধরনের দিকে ঝুঁকছেন, যেখানে শিশুদের উপর চাপ দেওয়া নয়, বরং শিশুদের জীবনে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করছেন তাঁরা। বিষয়টি নতুন নয়, কিন্তু পুরনো ধারণার সঙ্গেই আরও সূক্ষ্মতা যোগ করা হয়েছে।
সন্তানের প্রতি মনোযোগী হওয়ার পন্থা। ছবি: সংগৃহীত।
নতুন যুগের শিশুদের সঙ্গে গভীর ও দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি করতে হলে বিশেষ অভিভাবকত্বের প্রয়োজন বলে মনে করেন মনোবিদ আত্রেয়ী ভট্টাচার্য। তার জন্য প্রয়োজন, এই অভিভাবকত্বের অর্থ বোঝা। তাঁর কথায়, ‘‘মাইন্ডফুলনেস মানে বর্তমানে, এই মুহূর্তে মনোনিবেশ করে নিজের শরীর ও মনের সম্পর্কে সম্পূর্ণ রূপে অবগত হওয়া। নিজের অবস্থান ও অবস্থা সম্পর্কে উপলব্ধি করা। অর্থাৎ যখন আপনি যেখানে আছেন, যে কাজটি করছেন, সেটিতেই সম্পূর্ণ মন দেওয়া। অন্য কোনও দিকে নয়। মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই মাইন্ডফুলনেস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনোবিজ্ঞানের সবচেয়ে সাম্প্রতিক গবেষণার ধারাটি হল পজ়়িটিভ সাইকোলজি। সেখানে মাইন্ডফুলনেসের অভ্যাস খুব জরুরি। আমি কী ভাবছি, কী অনুভব করছি, কোন আবেগ কাজ করছে, সব কিছুর প্রতি যখন আমরা মনোযোগী হই, তখনই মাইন্ডফুলনেসের অনুশীলন শুরু হয়।’’এই ধারণা থেকেই মাইন্ডফুল পেরেন্টিংয়ের সূচনা হয়েছে।
সন্তানের কান্নার কারণ, দুঃখের কারণ, রাগ এবং অভিমানের কারণ ইত্যাদি বুঝতে হলে, তার প্রতি সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করতে হবে। তারা যতটুকু বলবে, তার পরেও আরও অনেক না বলা কথা থেকে যাবে। আর সেখানেই মনোবিদের বক্তব্য, এই প্রত্যেকটি অনুভূতি সম্পর্কে বাবা-মা যখন যত্নবান হবেন, তাঁরা যখন সবটা বুঝতে চাইবেন, আগেই রেগে না গিয়ে ভেবে প্রতিক্রিয়া দেবেন, তখনই এই বিশেষ ধারার অনুসরণ ঘটবে। আজকাল ফোন এবং স্ক্রিনের দাপটে সমস্ত কাজেই বাধা পড়ছে। সে সবের প্রভাব অভিভাবকত্বে ফেলতে দেওয়া চলবে না।
সাম্প্রতিক প্রজন্ম বা জেনারেশন আলফার শিশুদের যখন লালনপালন করা হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে, তারা অনেক বেশি জানে, অনেক বেশি বোঝে। কারণ, বাইরের দুনিয়া তাদের হাতের কাছাকাছি আছে। তারও বেশ কিছু ভাল-মন্দ আছে। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে বড় হচ্ছে তারা। আত্রেয়ী বলছেন, ‘‘এই প্রজন্মের সঙ্গে কী ভাবে বোঝাপড়া করতে হবে, তা বুঝতে ‘মাইন্ডফুল পেরেন্টিং’ সাহায্য করতে পারে মা-বাবাদের। অর্থাৎ আমি কেন আমার সন্তানকে এমন কথা বললাম, আমার সন্তানের এমন আচরণের কারণ কী, সন্তান কী ভাবে সমস্ত প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করবে, এই সমস্ত কার্যকারণ সূত্র সমাধান করতে সাহায্য করবে।’’
এই পদ্ধতিতে বাবা-মায়েরও উপকার হয়। বাবা-মা নিজেদের রাগ ও হতাশা সামলাতে শিখে যান। আগেভাগে বিচার করতে বসার প্রবণতা কমে। সন্তানের সঙ্গে সংযোগ তৈরি হয়, বোঝাপড়া বাড়ে। মনোযোগী অভিভাবক হতে গেলে কিন্তু নিখুঁত হওয়া নয়, বরং শান্ত হয়ে মুহূর্তে উপস্থিত থাকাটাই আসল। যেন সন্তান জানে, সে ভালবাসা পাচ্ছে ও নিরাপত্তার মধ্যে আছে।
‘মাইন্ডফুল পেরেন্টিং’য়ের কয়েকটি উদাহরণ—
১. সন্তানের সঙ্গে সময় কাটান, শুধু একসঙ্গে বসে গল্প করুন। ফোন বা স্ক্রিন দূরে রাখুন।
২. রেগে গেলে সঙ্গে সঙ্গে কিছু না বলে খানিকক্ষণ চুপ করে যান। গভীর নিঃশ্বাস নিন, তার পর কথা বলুন।
৩. সন্তানের অনুভূতি বুঝতে চেষ্টা করুন, যদি সে কষ্ট পেয়ে থাকে, তা হলে তাকে সবটা বলার সুযোগ করে দিন।
৪. ভুল হলে বকাঝকা না করে শেখানোর চেষ্টা করুন।
৫. প্রতি দিন খানিকক্ষণ সন্তানের সঙ্গে এমন কিছু কাজ করুন, যা দু’জনেরই ভাল লাগে। তা ছবি আঁকা, খেলা বা গল্প বলা, যা খুশি হতে পারে।